ওঁরা বীর, ওঁরা আকাশে জাগাত ঝড়

“কেউ বলে ডাকাত, কেউ বলে বিপ্লবী” 

বিপ্লবী নায়ক অনন্ত সিংহ

ভারতবর্ষের বিপ্লববাদী আন্দোলনের অন্যতম নায়ক এবং নিঃসন্দেহে একজন ‘প্রোটাগনিস্ট’ বিপ্লবী অনন্ত সিংহ। রোমাঞ্চে ভরপুর তাঁর জীবনকথা যে কোনও হলিউড ক্লাসিককে লজ্জা দেবে। আবার বিতর্কের উপাদানও তাঁর জীবনে নেহাত কম নেই। আলোচ্য নিবন্ধে আমরা সেই অগ্নি-স্নাতকের স্মৃতিতর্পণ করবো; তুলে ধরবো এই বিস্মৃত দেশনায়কের জীবনের নানা বিচিত্র কাহিনী।

বাল্য ও কৈশোরঃ

অনন্ত সিং বা অনন্ত লাল সিং ১৯০৩ সালের, ১লা ডিসেম্বর  চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পূর্বপুরুষগণ রাজপুত; তাঁরা আগ্রা অঞ্চলের অধিবাসী ছিলেন। অনন্ত সিংহের পিতার নাম গোলাপ সিং (গুলাব সিং)। অনন্ত সিং ছোটবেলা থেকেই খেলাধুলা ও শরীরচর্চায় পারদর্শী ছিলেন। সার্কাসে বিখ্যাত ব্যায়াম-বীর রামমূর্তিকে বুকের ওপর দিয়ে হাতি চড়াতে দেখে, খালি হাতে চলন্ত মোটর থামাতে দেখে সেই অবিশ্বাস্য কাজ নিজে করতে সচেষ্ট হন অনন্ত। হাতির অভাবে বুকের ওপর বেঞ্চ নিয়ে তার ওপর তুলে দেন আটটি ছেলেকে; মোটরগাড়ির অভাবে শারীরিক সক্ষমতার পরীক্ষায় অনায়াসে কুড়ি জনকে হটিয়ে দেন  দড়ি টানাটানিতে। এমনই সব অবিশ্বাস্য শারীরিক ক্ষমতার পরিচয় দিয়ে চট্টগ্রামের যুব সমাজে আলোড়ন তোলেন তিনি।

বিপ্লবী জীবনঃ 

অনন্ত সিং-এর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা খুব বেশি ছিল না। চট্টগ্রাম মিউনিসিপাল বিদ্যালয়ে পড়ার সময় তিনি অন্তরঙ্গ সহপাঠী প্রমোদের সাহায্যে বিপ্লবী সূর্য সেনের (মাষ্টারদা) সংস্পর্শে আসেন। প্রথম দিনে প্রমোদের সঙ্গে চট্টগ্রাম শহরের কর্ণফুলীর তীরে ভোরবেলায় এক কুটিরে যে লোকটিকে শেডীণ দেখেছিলেন অনন্ত, তাঁকে দেখলে আর যাই হোক বিপ্লবী নেতা বলে ভুল হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। অথচ এই ক্ষীণকায় লোকটি সমস্ত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে যে একদিন ভাবিয়ে তুলেছিল। ইনিই ‘চট্টল সূর্য’ সূর্য সেন। অথচ অনন্ত সিং প্রথম দিন এই লোকটির সাধারণ আকর্ষণবিহীন চেহারা দেখে হতাশই হয়েছিলেন। মাস্টারদার কাছে কোনো রিভলভার নেই এবং তখন পর্যন্ত একজন সাহেবকেও মারেন নি শুনে তিনি রীতিমতো দমে গিয়েছিলেন । তবে ধীরে ধীরে মাস্টারদা ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে এসে অনন্ত সিংহের মনে স্বাধীনতার স্পৃহা জেগে উঠল। নতুন নতুন সদস্য সংগ্রহের কাজ শুরু হল বাড়ি থেকেই। প্রথমেই দলে এলেন অনন্তের দাদা ও দিদি ইন্দুমতী সিংহ । বাড়ির সবার পরোক্ষ সমর্থন রইল বিপ্লবের হোম শিক্ষা প্রজ্বলনে । ক্লাসের ভালো ছাত্র আফসারউদ্দিন এবং গণেশ ঘোষও একদিন যুক্ত হলেন তাঁদের সাথে। অনন্তর অসাধারণ সাহস, সাংগঠনিক দক্ষতা, বুদ্ধিমত্তা, কর্মোদ্যোগ দেখে অচিরেই  সূর্য সেন তাঁকে  একজন ঘনিষ্ঠ ও বিশ্বাসভাজন সহকর্মীর মর্যাদা দেন।

১৯২১ সালে অনন্তর ‌উদ্যোগেই তাঁর স্কুলের ছেলেরা অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেয়। এই আন্দোলন প্রত্যাহার করা হলে তিনি বিপ্লবী আন্দোলনকে জোরদার করার জন্য সচেষ্ট হন।  বিপ্লবীদের জন্য অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে আসাম-বাংলা রেলওয়ে কোম্পানীর অর্থ লুঠ করার সময় তিনি ও তাঁর সঙ্গীরা পুলিসের সাথে সরসরি সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। ১৯২৪ সালে বিপ্লবী কাজকর্মের জন্য গ্রেপ্তার হয়ে চার বছর কারাগারে থাকেন। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে তিনি ব্যয়ামাগার স্থাপন করে বিপ্লবী সংগঠনকে শক্তিশালী করার জন্য ও তরুণদের দলে আনার জন্য সচেষ্ট হন। ব্যায়াম, বক্সিং, যুযুৎসু ইত্যাদির অনুশীলন চলতে লাগল। সাথে সাথেই চলতে লাগল স্বাধীনতার সেনানীদের চরিত্র গঠনের কাজ।

চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনঃ

১৯৩০ সনের ১৮ এপ্রিল। রাত তখন দশটা। সর্বাধিনায়ক মাস্টারদার পূর্ব পরিকল্পনা মতো সবার আগে এগিয়ে এলেন যুব বিদ্রোহের অন্যতম দুর্ধর্ষ দুই নায়ক অনন্ত সিংহ ও গণেশ ঘোষ। সঙ্গে বিধু ভট্টাচার্য ,হরিপদ মহাজন ,হিমাংশু সেন আর সরোজ গুহ। প্রত্যেকের পরিধানেই সামরিক পোশাক।সামনে রয়েছে পুলিশ লাইন। যেভাবেই হোক জেলার অন্যতম ঘাঁটি এই পুলিশ লাইনের অস্ত্রাগারটি দখল করতে হবে। অতর্কিত আক্রমণে অস্ত্রাগারের  প্রহরীরা পালিয়ে প্রাণ বাঁচাল। বড়ো বড়ো হাতুড়ির ঘায়ে ম্যাগাজিন কক্ষের শক্ত তালা ঝন ঝন করে ভেঙ্গে পড়ল। একটি দুটি নয় শত শত পুলিশ মাস্কেটি রাইফেল, সেই সঙ্গে অসংখ্য রিভলভার আর কার্তুজ। বিপ্লবীদের আনন্দের আর সীমা রইল না। ওদিকে জেনারেল লোকনাথ বল ও নির্মল সেনের নেতৃত্বে তখন আর এক অধ্যায় শুরু হয়ে গেছে অক্সিলারি আর্মারিতে। প্রয়োজন মতো অস্ত্রশস্ত্র সঙ্গে নিয়ে পেট্রোল ঢেলে অস্ত্রাগারে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হল। সঙ্গে সঙ্গে একটা মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটে গেল। হিমাংশু সেনের জামাকাপড়ে কিছু পেট্রোল পড়ে যাওয়ায় আগুন ধরাতে গিয়ে সমস্ত শরীর দাউদাউ করে জ্বলে উঠল। সে এক বীভৎস অবস্থা। পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য অনন্ত সিংহ ও গণেশ ঘোষ হিমাংশুকে গাড়িতে তুলে নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটে চললেন। ফলস্বরূপ তাঁরা মূল বাহিনী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লেন।

২২ এপ্রিলের রাত আটটায় চট্টগ্রাম থেকে আট মাইল দূরে পুঁটিয়ারি রেল স্টেশনে কাউন্টারের সামনে অনন্ত সিংহকে দেখা গেল সঙ্গে আরও তিনজন। রাজভক্ত স্টেশন মাস্টার অশ্বিনী ঘোষ তাঁদের চিনতে পারলেন। গাড়ি প্ল্যাটফর্মে ঢুকতেই গার্ডকে নিজের সন্দেহের কথা জানিয়ে দিলেন, পরবর্তী স্টেশন গুলিতেও টেলিগ্রামে টিকিট নম্বর জানিয়ে সংশ্লিষ্ট যাত্রীদের সন্দেহজনক গতিবিধির উপর নজর রাখতে বললেন। রাত দুটোয় ট্রেন ফেনী স্টেশনে ঢুকতেই কামরায় উঠে এল এক বিরাট সশস্ত্র পুলিশবাহিনী। দুঃসাহসী বিপ্লবী অনন্ত সিংহ, জীবন ঘোষাল ও আনন্দ গুপ্তের রিভলভারের দাপটে সে’দিনও পর্যুদস্ত হল ব্রিটিশ বাহিনী। অন্ধকারে গা-ঢাকা দিয়ে বিপ্লবীরা তাৎক্ষণিক ভাবে দলছুট হয়ে পড়লেও পরে সবাই চন্দননগরের আশ্রয়স্থলে মিলিত হয়েছিলেন।

 

আত্মসমর্পণ ও কালাপানিঃ

দীর্ঘ সময় আত্মগোপন কোড়ে ছিলেন বিপ্লবী অনন্ত সিংহ। অথচ সহকর্মীদের ওপরে পুলিশি নির্যাতন আটকাতে এবং ব্রিটিশ পুলিশের পোড়-খাওয়া কর্মীদের লাগাতার জেরার মুখে অল্পবয়সী রাজবন্দীদের কেউ যাতে দলের গোপন খবর ফাঁস না করে ফেলে তা নিশ্চিত করতে ২৮ জুন ১৯৩০ সালে অকুতোভয় অনন্ত সিংহ নিজেই গোয়েন্দাবিভাগের হেড কোয়ার্টার ইলিসিয়াম রো’তে স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করলেন। লোম্যানকে লেখা এক চিঠিতে তিনি এই আত্মসমর্পণকে সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত এবং গোপনীয় বলে জানালেন। তাঁর প্রভাবেই তরুন বিপ্লবীরা পুলিশি জেরার মুখে অটল ছিলেন বলে মনে হয়। ফলে বিখ্যাত চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন মামলায়  আসামী পক্ষের উকিল শরৎ দাস,বীরেন্দ্রনাথ,শ্রীশ বসু,অখিল দত্ত,কালীচরণ ঘোষ,এন সি মুখার্জী,সন্তোষ বসু প্রমুখ বিপ্লবীদের প্রান বাঁচাতে পেরেছিলেন।ইতিহাসের পাতায় পাথুরে প্রমাণ না থাকলেও এই বিষয়ে ব্রিটিশ পুলিশও এক রকম নিশ্চিত ছিলেন। এই সময় মাস্টারদার ডিনামাইট চার্জ করে কোর্টভবন বা জেলখানার দেওয়াল উড়িয়ে দেবার দুঃসাহসী পরিকল্পনাটিও সহসা ১৯৩১ সনের ২ জুন একটি কিশোর কর্মীর আকস্মিক গ্রেপ্তারে ফাঁস হয়ে গেল।

অনন্ত সিংহ নিজেও  জেলের ভিতর সুড়ঙ্গ তৈরি করে বিস্ফোরক দিয়ে জেল উড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন, যদিও তা সফল হয় নি। কিন্তু জেলের ভিতরে এমন পরিকল্পনায় ভীত হয়ে সরকার  বিপ্লবীদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে বাধ্য হলো। কোনও কোনও মতে, এই আলোচনার ফলেই চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের মামলায় কারও ফাঁসি হয়নি। বিচারে অনন্ত সিংহ  সহ লোকণাথ বল, গণেশ ঘোষ, লালমোহন সেন, সুবোধ চৌধুরী, ফণিভূষণ নন্দী, আনন্দ গুপ্ত, ফকির সেন, সহায়রাম দাস, বনবীর দাসগুপ্ত, সুবোধ রায়(ঝুংকু) এবং সুখেন্দু দস্তিদারের যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর হল। ১৯৩২ সালে আন্দামান সেলুলার জেলে অনন্ত সিংহ প্রমুখের নেতৃত্বে অনশন ধর্মঘট শুরু হলে রবীন্দ্রনাথ, গান্ধীজী প্রমুখের চেষ্টায় বন্দীদের আন্দামান থেকে স্বদেশে ফিরিয়া আনা হয়। অনন্ত সিং ১৯৪৬ সালে মুক্তিলাভ করেন। প্রসঙ্গতঃ  তাঁর বিপ্লবী কর্মকান্ডে সহায়তা করার জন্য তাঁর জ্যেষ্ঠা ভগিনী ইন্দুমতী সিংহও জেল খেটেছেন।

শেষ জীবনঃ

জেলে থাকাকালীন অনন্ত সিংহ প্রমুখরা মার্কসবাদী দর্শনে  আকৃষ্ট হন ও বাইরে এসে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান করেন। কারামুক্তির পর কিছুদিন তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণ ও মোটর গাড়ির ব্যবসা করেন।  তার প্রযোজিত অন্যতম জনপ্রিয় চলচ্চিত্র ‘যমালয়ে জীবন্ত মানুষ’। তবে সম্ভবতঃ স্বাধীন ভারতের রাজনৈতিক-সামাজিক পরিস্থিতি তাঁকে বিচলিত করেছিলো। তাই ‘৭০ দশকে তিনি গড়ে তোলেন ‘এম. এম. জি’ বা ‘ম্যান মানি গান’ নামক একটি উগ্রপন্থী বিপ্লবী গ্রুপ। এই গ্রুপ নিয়ে  ১৯৬০ সালে কলকাতায় ধারাবাহিক ব্যাংক ডাকাতির অভিযোগে তাঁকে ঝাড়খণ্ডের জদুগড় থেকে গ্রেপ্তার করা হয় ও আট বছর (১৯৬৯ – ১৯৭৭) কারাবাস করতে হয়। ফলে রাজনৈতিক জীবনের শেষ পর্বে তিনি নিশ্চিত একজন বিতর্কিত চরিত্র, কিন্তু তাই বলে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা কণামাত্র খর্ব হয় না।  ১৯৭৯ সালের ২৫শে জানুয়ারি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মহান বিপ্লবী নায়ক অনন্ত সিংহ  প্রয়াত হন।

অনন্ত সিংহের জীবনের রোমাঞ্চকর  অভিজ্ঞতা ধরা পরেছে তাঁর লেখা  ‘চট্টগ্রাম যুববিদ্রোহ’ (দুই খন্ড), ‘অগ্নিগর্ভ চট্টগ্রাম’ (দুই খন্ড), ‘মাস্টারদা’, ‘স্বপ্ন ও সাধনা’, ‘আমি সেই মেয়ে’, ‘কেউ বলে ডাকাত, কেউ বলে বিপ্লবী’ (আত্মজৈবনিক রচনা) ইত্যাদিতে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *