মধ্য যুগে বিশ্ববিদ্যালয়গুলি গড়ে ওঠার কারণ
আধুনিক বিশ্ব যে কয়েকটি বিষয়ে মধ্যযুগের ইউরোপের কাছে ঋণী, তার মধ্যে অন্যতম হলো বিশ্ববিদ্যালয়৷ থমসন ও জনসন’ ‘An Introduction to Medieval Europe’ গ্রন্থে লিখেছেন ”Of all the institutions handed down to us from the Middle Ages,the Catholic Church alone excepted ,this(University) is perhaps the one that has changed the least, at any rate in so far as organization is concerned.”
ল্যাটিন শব্দ ‘Universitas’ থেকে ইংরেজি ইউনিভার্সিটি শব্দের উৎপত্তি, যার বাংলা প্রতিশব্দ হলো বিশ্ববিদ্যালয়৷ প্রথম দিকে Universitas বলতে লোকসংঘ বোঝাত৷ পরে শুধুমাত্র জ্ঞান-অন্বেষী বা শিক্ষার্থী সম্প্রদায়ের পরিজ্ঞাপক শব্দ রূপে ব্যবহৃত হতে থাকে৷
বিশ্ববিদ্যালয় এর উৎপত্তি সম্পর্কে সঠিক তারিখ জানানো সম্ভব নয় তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান আকাশ এসেছিল দ্বাদশ শতকে৷ তবে কেবল মাত্র একটি পথেই এই সংস্কৃতির শ্রীবৃদ্ধি ঘটেনি থমসন ও জনসন তাদের গ্রন্থ লিখেছেন ” The oldest of the universities were those at Salerno, Bologna paris ,And Oxford, though at just what date each of them was embodied in a definite corporation it is impossible to say.”

কোন একটি বিশ্লেষণী ব্যাখ্যা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলির উৎপত্তির কারণ অনুসন্ধান অসম্ভব৷ নানা কারণে মধ্য যুগে বিশ্ববিদ্যালয় গুলির উদ্ভব হয়েছিল৷
প্রথমত, সপ্তম শতকে পশ্চিম ইউরোপে বৌদ্ধিক জীবনে অবক্ষয় দেখা দিয়েছিল৷ গির্জা ও মঠ স্কুল গুলোতে মূলত ধর্ম শিক্ষা দেওয়া হত৷ কিন্তু যুগ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষার চাহিদা বৃদ্ধি পেল ওই বিদ্যালয় গুলি সেই চাহিদা মেটাতে ব্যর্থ হয়৷ দশম শতক থেকে মঠের বিদ্যালয় গুলি ক্রমশঃ নষ্ট হয়ে গেল এবং ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও ইউরোপের অন্যান্য দেশে বিশপদের পরিচালনায় ক্যাথিড্রাল স্কুল গড়ে ওঠে৷ এই ক্যাথেড্রাল স্কুল পরবর্তীকালে বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়৷
দ্বিতীয়ত, নগরজীবনের প্রসারতা, গির্জা ও রাষ্ট্রে নতুন নতুন বৃত্তিমূলক চাকরির চাহিদা এবং গ্রিক ও ইসলামী শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রভাব ইত্যাদি নানা কারণে একাদশ শতকের শেষে ও দ্বাদশ শতকের প্রথমে ইউরোপের বৌদ্ধিক জগতে এক পরিবর্তন এলো৷ ক্রমশ দর্শন, চিকিৎসা, আইন, গণিত, রাজকার্য ইত্যাদি নানা বৃত্তিমূলক শিক্ষার চাহিদা বৃদ্ধি পেল৷ এই প্রয়োজন মেটাবার জন্য মানুষ বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তুলল৷ ঐতিহাসিক কমপ্যারি বলেন, জ্ঞানের নানা বিভাগের শিক্ষালাভের এই ক্রমবর্ধমান চাহিদা থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সৃষ্টি হল৷
তৃতীয়তঃ রাসডল এর মত কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে বণিক ও কারিগরি সংঘ গুলির অনুসরণে বিশ্ববিদ্যালয়ের সৃষ্টি হয়েছিল৷ নগরের উৎপত্তি ও বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে বণিক ও কারিগরেরা নিজেদের স্বার্থ নিরাপত্তা রক্ষার জন্য সংঘ বা গিল্ড গড়ে তুলেছিল৷ ছাত্র ও শিক্ষকরাও প্রবাসে নিজেদের জীবন ধারণ ও নিরাপত্তার জন্য সঙ্ঘবদ্ধ হয়েছিল৷ উদাহরণস্বরূপ বোলোনা বিশ্ববিদ্যালয় জার্মান, ফরাসি, ইংরেজ ছাত্রদের সংস্থা হিসেবে গড়ে উঠেছিল৷ থমসন ও জনসন বলেন, ”শিক্ষক ও ছাত্র সমাজের প্রয়োজন পূরণের তাগিদ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মত সুসংঘবদ্ধ ও সুগঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি স্বাভাবিক হয়ে উঠেছিল”৷
চতুর্থত, দ্বাদশ শতকের রেনেসাঁস বিশ্ববিদ্যালয়গুলির উদ্ভবের পটভূমি তৈরি করেছিল৷ রেনেসাঁসের ফলশ্রুতি স্বরূপ ইউরোপের বৌদ্ধিক জগতে যে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল তারই ফলশ্রুতি হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় উদ্ভবের সহায়ক পরিস্থিতি তৈরি হয়৷

পঞ্চমত, পশ্চিম ইউরোপের জ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে যে পরিবর্তন এসেছিল তাকে চার্চ সুনজরে দেখেনি৷ কিন্তু দ্বাদশ শতকে চার্চের নিজস্ব প্রয়োজনে ক্যাথলিক ধর্ম বিরোধী আন্দোলন থেকে চার্চকে মুক্ত রাখার জন্য প্রয়োজন ছিল সুশিক্ষিত যাজক সম্প্রদায়ের৷ আর এই যাজকদের সুশিক্ষিত করার জন্য প্রয়োজন ছিল উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের৷ চার্চ এর প্রভাব ও প্রতিপত্তি এবং আর্থিক সমৃদ্ধি সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষিত,আইনজ্ঞ ও সম্পত্তি তদারকি করার জন্য শিক্ষিত মানুষের প্রয়োজন ছিল৷ সেই কারণে চার্চ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনে আগ্রহী হয়৷
ষষ্ঠত, ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলে রাজা, সামন্ত প্রভু এবং নব্য স্থাপিত নগর গুলির প্রশাসনিক ও বাণিজ্যিক স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য বহু আইনজ্ঞ, কূটনীতিজ্ঞ, চিকিৎসক, হিসাব সংরক্ষণে দক্ষ ও দলিল লেখার মত শিক্ষিত মানুষের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছিল৷ এই চাহিদা থেকেই বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছিল৷
সপ্তমত, মধ্যযুগীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলির উৎপত্তির পিছনে ইউরোপের দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উপর ধ্রুপদী ইসলাম ও ইহুদী সংস্কৃতির প্রভাব অনস্বীকার্য৷ 632 CE থেকে 732 CE মধ্যে পারস্য থেকে স্পেন মুসলিম অধিকার এসেছিল এবং একাদশ শতকে স্পেনের সেভিল, কর্ডোভা, মালাগা, ভ্যালেন্সিয়া, সারগোসার মুসলিম রাজসভা গুলি ধর্মনিরপেক্ষ ও বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতির কেন্দ্রে পরিণত হয়৷ ক্রুসেড এর মাধ্যমে ইউরোপীয়রা আরবি ও সভ্যতার সংস্পর্শে আসে৷ গ্রিক, আরবীয় সংস্কৃতির সংস্পর্শে পশ্চিম ইউরোপে গভীর মননে আলোড়ন সৃষ্টি হয়৷ আর এই জ্ঞান পিপাসা থেকেই বিশ্ববিদ্যালয় জন্ম৷
অষ্টমত, জ্ঞান লাভের জন্য শিক্ষার্থীরা দূরদূরান্ত থেকে এসে বিভিন্ন পণ্ডিতের কাছে এসে সমবেত হত৷ এইসব পণ্ডিতরা যে ক্ষুদ্র বিদ্যালয় শিক্ষাদান করতেন হাজারো ছাত্রের জমায়েতে কাল ক্রমে তো বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়৷ এমনিভাবে অক্সফোর্ড, কলোন, বাসেল, প্রাগ, ভিয়েনা ইত্যাদি স্থানে বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছিল৷

নবমত, রাজ অনুজ্ঞাপত্রের মাধ্যমে কোন কোন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছিল৷ বিশেষ করে স্পেনের প্যালেন্সিয়া, ভাল্লাডোলিড, সালমানকা ইত্যাদি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম উল্লেখযোগ্য৷
দশমত, সুসংগঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের নমুনা দেখে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের আকাঙ্ক্ষাও যে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পশ্চাতে সক্রিয় ছিল এই যুক্তি কেও অস্বীকার করা যায় না৷ মধ্যযুগের বিশ্ববিদ্যালয় গুলি সাধারণত দুটি মডেল কে অনুসরণ করে গড়ে উঠেছিল যথা দক্ষিণ ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয় গুলি বোলানো বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুকরণে গড়ে উঠেছিল৷ এখানে মূলত আইন ও চিকিৎসা শাস্ত্র পড়ান হত৷ উত্তর ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয় গুলি অনুসরণ করেছিল প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয় কে৷ এই বিশ্ববিদ্যালয় গুলিতে আইন, চিকিৎসাশাস্ত্র ছড়াও ধর্মশাস্ত্র, কলাবিদ্যা ও শেখানো হতো