ভারতের ভূগোল

ভারতের মৃত্তিকা

মাটি বা মৃত্তিকা হলো পৃথিবীর উপরিভাগের নরম আবরণ। পাথর গুঁড়ো হয়ে সৃষ্ট খনিজ পদার্থ এবং জৈব যৌগ মিশ্রিত হয়ে মাটি গঠিত হয়। জৈব পদার্থের উপস্থিতিতে ভূমিক্ষয় আবহবিকার, বিচূর্ণিভবন ইত্যাদি প্রাকৃতিক ও রাসায়নিক পরিবর্তনের মাধ্যমে পাথর থেকে মাটির উদ্ভব হয়েছে। ভারতে প্রকৃতির বৈচিত্র্যের জন্য এখানে বিভিন্ন ধরনের মাটি দেখা যায়। উৎপত্তি, বৈশিষ্ট্য, উদ্ভিদ, রং ও জলবায়ুর তারতম্য অনুসারে ভারতের মাটিকে Indian Council of Agricultural Research (ICAR) আটটি প্রধান বিভাগে ভাগ করেছে।

ভারতের মৃত্তিকার শ্রেণীবিভাগ :

১) পলিমৃত্তিকা

২) কৃষ্ণমৃত্তিকা

৩) লোহিত মৃত্তিকা

৪) ল্যাটেরাইট মৃত্তিকা

৫) মরু মৃত্তিকা

৬) লবণাক্ত মৃত্তিকা

৭) পিট ও জলাভূমি অঞ্চলের মাটি

৮) পার্বত্য মৃত্তিকা

১) পলিমৃত্তিকা (Alluvial Soil) :

অবস্থান :

এই মাটি উত্তরের সমভূমি, শতদ্রু-গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র সমভূমি, মহানদী-গোদাবরী-কৃষ্ণা-কাবেরী নদীর উপত্যকা ও ব-দ্বীপ এবং উপকূলবর্তী অঞ্চলে পাওয়া যায়। পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খন্ড, বিহার, উত্তর প্রদেশ, হরিয়ানা, পাঞ্জাব প্রভৃতি স্থানে সাধারণত এই মাটি পরিলক্ষিত হয়।

বৈশিষ্ট্য :

◾ এই মাটিতে পলি, বালি ও কাদার ভাগ বেশি থাকে।

◾ এই মাটিতে সাধারণত পটাশ, ফসফরিক অ্যাসিড, চুন এবং জৈব পদার্থ মিশ্রিত থাকে।

◾ এই মাটি খুব উর্বর হওয়ায় কৃষিকাজে এটি খুব উপযোগী।

এই মাটিতে ধান, গম, ইক্ষু, পাট, আলু প্রভৃতি উৎপন্ন হয়।

◾ এই মৃত্তিকার রং গাঢ় হয়।

আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য অনুসারে পলিমাটিকে বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন নাম দেওয়া হয়েছে –

১) ভাঙ্গর :

➥ পুরাতন পলি মাটিকে ভাঙ্গর বলা হয়। এটি মূলত কাদামাটি নিয়ে গঠিত। এই জায়গা নদী থেকে দূরে অবস্থিত হয়।

২) খাদার :

➥ নবীন পলি মাটিকে খাদার বলা হয়। এটি গাঙ্গেয় সমভূমিতে পাওয়া যায় এবং এই মাটি খুব উর্বর হয়।

৩) ভাবর :

➥ হিমালয়ের পাদদেশে নুড়ি ও কাঁকর মিশ্রিত পলিমাটিকে ভাবর বলে। এই অঞ্চল কৃষিকাজের পক্ষে অনুপযুক্ত।

৪) তরাই :

➥ উচ্চ বৃষ্টিপাতের কারণে এই অঞ্চল জলাকীর্ণ এবং স্যাতসেতে প্রকৃতির হয়। এটি কৃষির পক্ষে উপযুক্ত। এই অঞ্চল নাইট্রোজেন এবং জৈব পদার্থ দ্বারা সমৃদ্ধ কিন্তু ফসফেটের অভাব দেখা যায়।

২) কৃষ্ণমৃত্তিকা (Black Soil) :

অবস্থান :

দাক্ষিণাত্য মালভূমির মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ, কর্ণাটকের অংশবিশেষ, অন্ধ্রপ্রদেশ, গুজরাট ও তামিলনাড়ু জুড়ে এই মৃত্তিকা দেখা যায়।

বৈশিষ্ট্য :

◾ এই মৃত্তিকা রেগুর মৃত্তিকা বা কার্পাস মৃত্তিকা বা Black Cotton Soil নামেও পরিচিত।

◾ লাভা গঠিত ব্যাসল্ট শিলার আবহবিকারের ফলে এই মৃত্তিকা সৃষ্টি হয়েছে।

◾ এই মাটিতে টাইটানিয়াম অক্সাইড এর পরিমাণ বেশি থাকে।

◾ এই মাটিতে সাধারণত চুন, লোহা, ম্যাগনেসিয়াম, অ্যালুমিনিয়াম এবং পটাস মিশ্রিত থাকে।

◾ এই মাটি কার্পাস তুলা চাষের পক্ষে আদর্শ। এছাড়াও তামাক, গম, জোয়ার, তৈলবীজ, মিলেট প্রভৃতি চাষ হয়।

৩) লোহিত মৃত্তিকা (Red Soil) :

অবস্থান :

এই মৃত্তিকা সাধারণত সমগ্র তামিলনাড়ু, কর্নাটকের অংশবিশেষ, মহারাষ্ট্রের দক্ষিণ-পূর্ব, অন্ধ্রপ্রদেশ ও মধ্যপ্রদেশের পূর্বাংশ, ছোটনাগপুর অঞ্চল, পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া ও বীরভূম জেলায় লক্ষ্য করা যায়।

বৈশিষ্ট্য :

◾ এই মৃত্তিকা আর্কিয়ান, প্রিক্যাম্বিয়ান যুগের গ্রানাইট, নিস ও কোয়ার্টজাইট শিলা দ্বারা সৃষ্টি হয়েছে।

◾ লোহিত মৃত্তিকায় লৌহের পরিমাণ বেশি থাকায় এই মৃত্তিকা লাল রঙের হয়।

◾ এই মৃত্তিকায় অতি অল্প পরিমাণে নাইট্রোজেন, জৈব পদার্থ এবং ফসফরাসের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।

◾ এই মৃত্তিকা অনুর্বর তবে বর্তমানে রাসায়নিক সার প্রয়োগ করে এই মৃত্তিকায় চিনাবাদাম, আলু, ভুট্টা, ধান, রাগি, গম, বাজরা, ডাল, আখ, তৈলবীজ এবং কমলালেবু, আম এবং শাকসবজি প্রভৃতি ফসল উৎপাদিত হয়।

৪) ল্যাটেরাইট মৃত্তিকা (Laterite Soil) :

অবস্থান :

সাধারণত পশ্চিমঘাট পর্বতের শীর্ষদেশে, পূর্বঘাট, রাজমহল পাহাড়, অসম ও মেঘালয়ের পাহাড়ি অঞ্চলে দেখতে পাওয়া যায়।

বৈশিষ্ট্য :

◾ উচ্চ তাপমাত্রা এবং উচ্চ বৃষ্টিপাত যুক্ত অঞ্চলে সাধারণত এই মৃত্তিকা লক্ষ্য করা যায়।

◾ এই মৃত্তিকাতে আয়রন অক্সাইড, বিভিন্ন ধরনের জৈব পদার্থ, ফসফেট এবং ক্যালসিয়ামের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।

◾ কাঁকরে পরিপূর্ণ বলে এই মৃত্তিকার জল ধারণ ক্ষমতা খুব কম।

◾ ল্যাটেরাইট মৃত্তিকা কাজুবাদাম চাষের জন্য বিশেষভাবে উপযোগী। এছাড়াও তুলা, চা, নারকেল ও ডাল ইত্যাদি চাষ করা হয়।

৫) মরু মৃত্তিকা (Desert Soil) :

অবস্থান :

এই মৃত্তিকা দেখা যায় প্রধানত রাজস্থানের মরুভূমি, গুজরাটের উত্তরাংশে, কচ্ছ অঞ্চলে, হরিয়ানার পশ্চিমাংশে এবং পাঞ্জাবের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশে।

বৈশিষ্ট্য :

◾ এই মৃত্তিকাকে সিরোজেম মৃত্তিকা বলা হয়।

◾ এই মৃত্তিকা বাদামি হলুদ বা হালকা হলুদ বর্ণের হয়।

◾ এই মৃত্তিকা সাধারণত বালি পূর্ণ ও লবণাক্ত প্রকৃতির হয়।

Version 1.0.0

◾ এই মৃত্তিকা অল্প পরিমাণে নাইট্রোজেন ও জৈব পদার্থ দিয়ে গঠিত হয়।

◾ এই মৃত্তিকা সাধারণভাবে কৃষিকাজের পক্ষে অনুপযোগী, তবে উপযুক্ত পরিমাণে জলসেচ ও রাসায়নিক সার প্রয়োগ করলে মিলেট, বার্লি শস্য উৎপাদন করা যায়।

৬) লবণাক্ত ও ক্ষারীয় মৃত্তিকা (Saline & Alkaline Soil) :

অবস্থান :

বিহার, উত্তর প্রদেশ হরিয়ানা, পাঞ্জাব, সুন্দরবন অঞ্চল ও কচ্ছের রণ অঞ্চলে এই মৃত্তিকা লক্ষ্য করা যায়।

বৈশিষ্ট্য :

◾ এই প্রকার মৃত্তিকা বিভিন্ন নামে পরিচিত যেমন – রে, ঊষর, কন্নার, থুর প্রভৃতি।

◾ এই মৃত্তিকাতে সোডিয়াম, পটাশিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়ামের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।

◾ এই মৃত্তিকা কৃষিকাজের পক্ষে অনুপযুক্ত।

৭) পিট ও জলাভূমি অঞ্চলের মাটি (Peat Soil) :

অবস্থান :

সাধারণত কেরালার উপকূলসহ, পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা, তামিলনাড়ুর উপকূল অঞ্চলে এই মৃত্তিকা দেখা যায়।

বৈশিষ্ট্য :

◾ অধিক বৃষ্টিপাত এবং উচ্চ আর্দ্রতা যুক্ত অঞ্চলে এই মৃত্তিকা লক্ষ্য করা যায়।

◾ এই মৃত্তিকায় জৈব পদার্থের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।

◾ এই প্রকারের মৃত্তিকা সাধারণত ধান ও পাট চাষের জন্য উপযোগী।

৮) পার্বত্য মৃত্তিকা (Mountain and Forest Soil) :

অবস্থান :

এই মৃত্তিকা প্রধানত পর্বতের ঢাল যুক্ত অঞ্চলে যেখানে প্রচুর পরিমাণে বৃষ্টিপাত হয় সেই অঞ্চলে লক্ষ্য করা যায়।

বৈশিষ্ট্য :

◾ এই মৃত্তিকায় জৈব পদার্থের পরিমাণ বেশি থাকে।

◾ এই মৃত্তিকায় পটাশ, ফসফরাস এবং চুনের পরিমাণ কম থাকে। তাই এই মৃত্তিকা অনুর্বর প্রকৃতির। তবে সার প্রয়োগে উর্বর হয়।

◾ এই মৃত্তিকা অনুর্বর হলেও চা, কফি, বিভিন্ন ঔষধিদ্রব্য, বিভিন্ন প্রকার ফল প্রভৃতির চাষ হয়।

ভারতের মৃত্তিকা সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য :

◾ পলিমাটি চাষের উপযোগী ও অত্যাধিক উর্বর।

◾ পলিমাটি হল নদী অববাহিকার মাটি।

◾ ভারতের সবচেয়ে বেশি অঞ্চল জুড়ে পলিমাটির অবস্থান লক্ষ্য করা যায়।

◾ কারেওয়া মাটি হলো কাশ্মীর উপত্যকার পলিমাটি।

◾ কৃষ্ণ মৃত্তিকাকে রেগুর, কার্পাস মৃত্তিকা, Black Cotton Soil বলা হয়।

◾ কৃষ্ণ মৃত্তিকায় তুলা চাষ ভালো হয়।

◾ লালমাটি গ্রানাইট থেকে সৃষ্ট, অল্প বৃষ্টি-অধিক উষ্ণতা অঞ্চলে দেখা যায়।

◾ পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া, বীরভূম জেলায় লোহিত মৃত্তিকা দেখা যায়।

◾ মরু মৃত্তিকা রাজস্থানে দেখা যায়।

◾ মরু মৃত্তিকাকে সিরোজেম বলে।

◾ মরুকরণ বলতে বোঝায় মরুভূমির সম্প্রসারণ ও ক্ষয় বৃদ্ধি।

◾ পডসল মৃত্তিকা হলো পার্বত্য মাটি, আম্লিক, অনুর্বর মাটি।

◾ ঝুমচাষ উত্তর-পূর্ব ভারতে পাহাড়ি অঞ্চলে দেখা যায়।

◾ ধাপ চাষ মৃত্তিকা ক্ষয় নিয়ন্ত্রণ করে।

◾ ভূমিধস দেখা যায় পাহাড়ি ঢালে।

◾ মেঘালয় মালভূমি অঞ্চল এবং পশ্চিমঘাট পার্বত্য অঞ্চলে ল্যাটেরাইট মাটি দেখা যায়।

◾ ল্যাটেরাইট হল ইটের মতো শক্ত মাটি।

◾ ভারতের মৃত্তিকা গবেষণাগার অবস্থিত দেরাদুনে।

◾ ভারতের মরু গবেষণা কেন্দ্র অবস্থিত যোধপুরে।

◾ সোলাম শব্দের অর্থ মেঝে বা ভূমি।

◾ মৃত্তিকা সৃষ্টির প্রক্রিয়াকে পিডোজেনেসিস বলে।

◾ মৃত্তিকা সৃষ্টির পূর্ব শর্ত হলো আবহবিকার ও বিচূর্ণীভবন।

◾ রোগলিথ হলো মৃত্তিকা সৃষ্টির আগের পর্যায়।

◾ ছোটনাগপুর মালভূমি, মেঘালয় ও পশ্চিমঘাট পার্বত্য অঞ্চলে ল্যাটেরাইট মাটি দেখা যায়।

◾ কারেওয়া মাটিতে জাফরান চাষ ভালো হয়। কারেওয়া কাশ্মীর উপত্যকার পলিমাটি।

◾ ভারতের 25 শতাংশ অঞ্চল ভূমিক্ষয় প্রবণ।

◾ মৃত্তিকা ক্ষয়ের ফলে মৃত্তিকার উপরের পুষ্টি মৌলের (N, P, K, Ca, Mg) অপসারণ ঘটে ফলে উর্বরতা কমে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *