ভারতের জলবায়ু
জলবায়ু অঞ্চল :- কোনোও বিশেষ জলবায়ু অঞ্চল বলতে কোনও দেশ বা মহাদেশের এমন এক বা একাধিক অঞ্চলকে বোঝায়, যেখানের জলবায়ুর প্রকৃতি বিশেষত উষ্ণতা ও বৃষ্টিপাত মোটামুটি একই ধরনের ।
(১) ভারতের বিভিন্ন জলবায়ু অঞ্চল :-
(২) ভারতের প্রধান ঋতু :-
(৩) ভারতের জলবায়ুর বৈশিষ্ট্য :-
(৪) ভারতের মৌসুমী জলবায়ু:-
বিশাল ভারতের বৈচিত্র্যপূর্ণ ভুপ্রকৃতির জন্য ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত এবং স্বাভাবিক উদ্ভিদের তারতম্যের ওপর ভিত্তি করে আবহাওয়াবিদ কোপেন-এর মত অনুসরণ করে ভারতকে আটটি জলবায়ু অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছে, যথা:- (১) শীতল পার্বত্য জলবায়ু অঞ্চল, (২) উষ্ণ মরু অঞ্চল, (৩) ক্রান্তীয় অতি আর্দ্র মৌসুমি অঞ্চল, (৪) উপক্রান্তীয় আর্দ্র মৌসুমি ও শুষ্ক শীতপ্রধান অঞ্চল, (৫) নাতিশীতোষ্ণ স্বল্প গ্রীষ্ম ও শীতল আর্দ্র অঞ্চল, (৬) ক্রান্তীয় সাভানা অঞ্চল, (৭) মরুপ্রায় ক্রান্তীয় অঞ্চল এবং উপক্রান্তীয় স্টেপস অঞ্চল, (৮) ক্রান্তীয় শুষ্ক গ্রীষ্ম ও শীতকালীন বৃষ্টিপাত অঞ্চল ।
(১) শীতল পার্বত্য জলবায়ু অঞ্চল :- হিমালয়ের উচ্চ পার্বত্য অঞ্চল অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং ও জম্মু-কাশ্মীরের পার্বত্য অঞ্চল; হিমাচল প্রদেশের রোটাংপাস এবং লাহুল ও স্পিটি উপত্যকা; উত্তর প্রদেশের কেদারনাথ, বদ্রী নারায়ণ, গঙ্গোত্রী-গোমুখ অঞ্চল প্রভৃতি শীতল পার্বত্য জলবায়ু অঞ্চলের অন্তর্গত । সারা বছরই এখানে তীব্র শৈত্য থাকে এবং শীতকালে এই অঞ্চলের তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নীচে -১ ডিগ্রি থেকে -৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত নেমে যায় ।
(২) উষ্ণ মরু অঞ্চল:- পশ্চিম রাজস্থানের মরুস্থলী ও থর মরুভূমি এই অঞ্চলের অন্তর্গত । গ্রীষ্মকালে এই অঞ্চলের উষ্ণতা প্রায় ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত পৌঁছায় । এছাড়া এই অঞ্চলের বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ১২ থেকে ২০ সেমি । এই জন্য এই অঞ্চলকে শুষ্ক অঞ্চল বলা হয় ।
(৩) ক্রান্তীয় অতি আর্দ্র মৌসুমি অঞ্চল :– এই জলবায়ু অঞ্চলের বার্ষিক গড় তাপমাত্রা ১৮ ডিগ্রি – ২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং বার্ষিক গড় বৃষ্টি পাতের পরিমাণ ২৫০ থেকে ৩০০ সেমিরও বেশি । ভারতের পশ্চিম উপকূলবর্তী কেরালা, কর্ণাটক এবং গোয়া রাজ্য এই অঞ্চলের অন্তর্গত । এই অঞ্চলগুলি অত্যধিক বৃষ্টিপাত যুক্ত অঞ্চল ।
(৪) উপক্রান্তীয় আর্দ্র মৌসুমি ও শুষ্ক শীতপ্রধান অঞ্চল:- মৌসুমি বাহুর প্রভাবে এই অঞ্চলে জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাসে অর্থাৎ বর্ষাকালে মাঝারি থেকে ভারী ধরনের বৃষ্টিপাত হয় । এছাড়া এই অঞ্চলে গ্রীষ্মকালে অত্যন্ত উষ্ণ ও শুষ্ক এবং শীতকালে শীতল আবহাওয়াযুক্ত হয় । উত্তর ভারতের সিন্ধু-গাঙ্গেয় সমভূমি অঞ্চলে এই জলবায়ু দেখা যায় ।
(৫) নাতিশীতোষ্ণ স্বল্প গ্রীষ্ম ও শীতল আর্দ্র অঞ্চল:– অসমের পূর্বাংশ ও অরুণাচল প্রদেশকে নিয়ে গঠিত এই জলবায়ু অঞ্চলের বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ অত্যধিক । প্রায় ২৪০ সেমি থেকে ৩০০সেমি । এছাড়া স্বল্প স্থায়ী গ্রীষ্মকাল এবং শীতের কিছু দিন বাদ দিলে সারাবছর ধরে নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ু এই অঞ্চলের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য ।
(৬) ক্রান্তীয় সাভানা অঞ্চল :- দক্ষিণবঙ্গ, ওড়িশা, অন্ধ্রপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক, তামিলনাড়ুর কিছু অংশ, গুজরাট প্রভৃতি অঞ্চলে এই ধরনের জলবায়ু দেখা যায় । শুকনো শীতকাল এবং অতি উষ্ণ গ্রীষ্মকাল হল ক্রান্তীয় সাভানা জলবায়ু অঞ্চলের প্রধান বৈশিষ্ট্য । এই ধরনের জলবায়ুতে সাভানা তৃণভূমির সৃষ্টি হয়, তাই এই জলবায়ু অঞ্চলের নাম রাখা হয়েছে ক্রান্তীয় সাভানা অঞ্চল ।
(৭) মরুপ্রায় ক্রান্তীয় অঞ্চল এবং উপক্রান্তিয় স্টেপস অঞ্চল :– পূর্ব রাজস্থান, দক্ষিণ-পশ্চিম পাঞ্জাব এবং ভারতের পশ্চিম উপকূলবর্তী পশ্চিমঘাট পর্বতমালার বৃষ্টিচ্ছায়া অঞ্চলে বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ মাঝারি থেকে বেশ কম প্রায় ২০ থেকে ১০০ সেমি । জলবায়ু চরমভাবাপন্ন অর্থাৎ শীত ও গ্রীষ্ম দুই খুব বেশি ।
(৮) ক্রান্তীয় শুষ্ক গ্রীষ্ম ও শীতকালীন বৃষ্টিপাত অঞ্চল:- ভারতের পূর্ব উপকূলের দক্ষিণ অংশে প্রধানত করমণ্ডল উপকূল অবস্থিত এই জলবায়ু অঞ্চলের গ্রীষ্মকাল শুষ্ক প্রকৃতির এবং সাধারণত শীতকালেই বেশি বৃষ্টিপাত হয় ।
গ্রীষ্মকাল [Summer] :-
(১) এপ্রিল থেকে জুন মাসে ভারতের সর্বত্র বেশি তাপমাত্রা অনুভুত হয়, এই সময়টি তাই গ্রীষ্মকাল নামে পরিচিত ।
(২) মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে ভারতে তাপমাত্রা বাড়তে থাকে এবং জুন মাসের শুরুতে উত্তর ভারতের সমভূমি অঞ্চলে তাপমাত্রা সর্বোচ্চ হয় । উত্তর পশ্চিম ভারতের রাজস্থানে ৪৫ ডিগ্রি থেকে ৫৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং দিল্লি ও মধ্যভারতে ৪০ ডিগ্রি থেকে ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং দক্ষিণ ভারতে ৩৫ ডিগ্রি – ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রা দেখা যায় । এই সময় উচ্চতা এবং সমুদ্রের সমভাবাপন্ন জলবায়ুর প্রভাবে দক্ষিণ ভারতের মালভূমি অঞ্চলে উত্তর ভারতের সমভূমির তুলনায় কিছুটা কম তাপমাত্রা থাকে । মোটামুটি ৩৫ ডিগ্রি থেকে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রা থাকে ।
(৩) গ্রীষ্মকালে উত্তর ভারতের থর মরুভূমি থেকে শুরু করে ছোটনাগপুর মালভূমি পর্যন্ত স্থানের বায়ুতে নিন্মচাপের সৃষ্টি হয় । কিন্তু এই সময় উত্তর ভারতের সমভূমির তুলনায় কিছু শীতল হওয়ায় দাক্ষিণাত্যের মালভূমি অঞ্চলের বায়ুতে খানিকটা উচ্চচাপ বজায় থাকে যা আরব সাগর থেকে ভারতে জলীয়বাষ্পপূর্ণ বায়ুপ্রবাহে বাধা সৃষ্টি করে ।
(৪) এই সময় পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলো থেকে উত্তর ভারতের সমভূমি অঞ্চলে মাঝে মাঝে কালবৈশাখীর মতো প্রবল ঘূর্ণিঝড় ধেয়ে আসে ।
লু (loo) :- গ্রীষ্মকালে বৈশাখ-জৈষ্ঠ্য মাসে ভারতের উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান, বিহার প্রভৃতি অঞ্চলে মাথার উপর লম্বভাবে প্রচন্ড সূর্য কিরণের ফলে ভুপৃষ্ঠ উত্তপ্ত হওয়ার জন্য শোঁ শোঁ শব্দ করে উত্তপ্ত বায়ু প্রবল বেগে প্রবাহিত হয়, তাকে লু বলে । এই বায়ুর প্রচন্ড উত্তাপের ফলে প্রতি বছর বহু মানুষ ও গবাদি পশু মারা যায় ।
বর্ষাকাল [Rainy Season] : ভারতে জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাস হল বর্ষাকাল ।
দক্ষিণ পশ্চিম মৌসুমি বায়ু : গ্রীষ্মকালের শেষের দিকে উত্তর-পশ্চিম ভারতে গভীর নিম্নচাপের সৃষ্টি হলে বঙ্গোপসাগর ও আরব সাগর থেকে আর্দ্র দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু আকস্মিকভাবে ভারতে প্রবেশ করে, ফলে বজ্রবিদ্যুৎসহ প্রবল বৃষ্টিপাতের সূচনা হয় । এইভাবে প্রবল বর্ষণের মাধ্যমে ভারতে বর্ষাকালের সূচনা ঘটে, তাকে মৌসুমি বিস্ফোরণ বলা হয় ।
(১) ভারতে বর্ষা ঋতুটি জুন মাসে শুরু হয় এবং সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত স্থায়ী হয় ।
(২) এই সময় উত্তর ভারতের সমভূমির উপর প্রবল নিম্নচাপের সৃষ্টি হয়, তখন ভারত মহাসাগরের উচ্চচাপ অঞ্চল থেকে জলীয় বাষ্পপূর্ণ মৌসুমি বায়ুপ্রবাহের আগমন ঘটে ।
(৩) এই সময় দক্ষিণ গোলার্ধ থেকে প্রবাহিত দক্ষিণ-পূর্ব আয়ন বায়ু যাকে বাণিজ্য বায়ুও বলা হয়, ফেরেলের সুত্র অনুসারে ডান দিকে বেঁকে ভারতীয় উপমহাদেশে দক্ষিণ–পশ্চিম মৌসুমি বায়ু নামে প্রবাহিত হতে শুরু করে ।
(৪) ভারতবর্ষের ত্রিভুজের মতো আকৃতির জন্য দক্ষিণ–পশ্চিম মৌসুমি বায়ু দুই শাখায় বিভক্ত হয়ে যায় (ক) আরব সাগরীয় শাখা (খ) বঙ্গোপসাগরীয় শাখা ।
(ক) মৌসুমি বায়ুর আরব সাগরীয় শাখা:-
(১) আরব সাগর থেকে প্রচুর জলীয় বাস্প সংগ্রহ করে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর আরব সাগরীয় শাখা জুন মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যেই দক্ষিণ–পশ্চিম দিক থেকে প্রবাহিত হয়ে পশ্চিম উপকূলের পশ্চিমঘাট পর্বতমালায় বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং এই পর্বত ও আরব সাগরের উপকূলের মধ্যবর্তী গোয়া ( পানাজি) ও কেরালার মালাবার উপকূলে প্রবল শৈলোৎক্ষেপ বৃষ্টিপাত ঘটায় । গড় বার্ষিক বৃষ্টিপাত ২৫০ সেমির বেশি হয় ।
(২) এর পর এই বায়ুপ্রবাহ পশ্চিমঘাট পর্বত অতিক্রম করে মধ্যপ্রদেশ ও দাক্ষিণাত্য মাল্ভুমিতে প্রবেশ করে । কিন্তু পশ্চিমঘাট পর্বতের অপর দিক বৃষ্টিচ্ছায়া অঞ্চলে অবস্থিত হওয়ায় জলীয় বাষ্পের ঘাটতি পড়ে বলে এই সব অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেশ কমে যায় । গড় বার্ষিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ১৫০ সেন্টিমিটারেরও কম হয় ।
এই বায়ুপ্রবাহ যতই আরও পূর্ব দিকে অগ্রসর হতে থাকে বৃষ্টিপাতের পরিমাণও ততই কমতে থাকে । যেমন হায়দ্রাবাদে বছরে গড়ে ১০০ সেন্টিমিটারেরও কম বৃষ্টিপাত হলেও পূর্ব দিকে অবস্থিত চেন্নাই -এ বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ৪০ সেন্টিমিটারেরও কম হয় ।
(৩) এই বায়ুর একটি শাখা উত্তরে রাজস্থানের দিকে অগ্রসর হয়, কিন্তু আরাবল্লী পর্বত এই বায়ুপ্রবাহের গতিপথে সমান্তরালভাবে অবস্থিত হওয়ায় এই বায়ুপ্রবাহের ফলে রাজস্থানে বৃষ্টিপাত খুব কম হয় । বছরে ২৫ সেন্টিমিটারেও কম হয় ।
(খ) মৌসুমি বায়ুর বঙ্গোপ সাগরীয় শাখা:-
বঙ্গোপসাগর থেকে প্রচুর জলীয় বাষ্প সংগ্রহ করে মৌসুমিবায়ুর বঙ্গোপসাগরীয় শাখাটি দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে প্রবাহিত হয়, যা মায়ানমারের আরাকান ইয়োমা এবং উত্তর–পূর্ব ভারতের গারো, খাসি ও জয়ন্তিয়া পাহাড়ে বাধা পেয়ে দক্ষিণ-পূর্ব মৌসুমি বায়ু হিসেবে ভারতে প্রবাহিত হয়ে বৃষ্টিপাত ঘটায়, যেমন
(১) দক্ষিণ পূর্ব মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের বদ্বীপ সমভূমি অঞ্চল ও উত্তর–পূর্ব ভারতের পাহাড়ি রাজ্যগুলোতে প্রবল বৃষ্টিপাত হয় । যেমন :- দক্ষিণ–পূর্ব মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে খাসি পাহাড়ের দক্ষিণের বায়ুমুখী ঢালে অবস্থিত চেরাপুঞ্জি–মৌসিনরাম অঞ্চলে পৃথিবীর মধ্যে সর্বাধিক প্রায় ১২৫০ সেমি থেকে ১৪০০ সেমি পর্যন্ত বৃষ্টিপাত হয় । কিন্তু বৃষ্টিচ্ছায়া অঞ্চলে অবস্থিত হওয়ায় এই পার্বত্য অঞ্চলের উত্তর ঢালে (যাকে অনুবাত ঢালে বলা হয় ) অবস্থিত শিলং শহরে বছরে মাত্র ২৫০ সেমি বৃষ্টিপাত হয় ।
(২) দক্ষিণ–পূর্ব মৌসুমি বায়ুপ্রবাহ পূর্ব হিমালয়ে পৌঁছানোর পর পশ্চিমমুখী হয়ে গাঙ্গেয় সমভূমির মধ্য দিয়ে যতই পাঞ্জাব ও রাজস্থানের নিম্নচাপ অঞ্চলের দিকে প্রবাহিত হয়, বৃষ্টিপাত ততই কমতে থাকে । যেমন:- এই বায়ুপ্রবাহের ফলে নিম্নগাঙ্গেয় সমভূমির কলকাতায় বছরে ২০০ সেমি, মধ্যগাঙ্গেয় সমভূমির পাটনায় বছরে ১৫০ সেমি, এবং উচ্চগাঙ্গেয় সমভূমির হরিদ্বারে বছরে প্রায় ১০০ সেন্টিমিটার বৃষ্টিপাত হয় । কিন্তু আরাবল্লী পর্বতের বৃষ্টিচ্ছায়া অঞ্চলে অবস্থিত হওয়ায় রাজস্থানের বিকানিরে বছরে খুবই সামান্য বৃষ্টিপাত হয় । আবার কোনও বছরে একেবারেই বৃষ্টিপাত হয় না ।
শরৎকাল [Autumn] :-
(১) ভারতে এই ঋতুটি অক্টোবর মাস থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত স্থায়ী হয় ।
(২) এই সময়ে কর্কটক্রান্তি রেখার ওপর সূর্যের কিরণ লম্বভাবে পড়ে না । ফলে উত্তর ভারতের সমভূমি অঞ্চলে তাপমাত্রা কমতে শুরু করে । এর ফলে উত্তর ভারতের নিম্নচাপ বলয়টি ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ে । তা ভারতে মৌসুমি বায়ু আকর্ষণ করে আনার পক্ষে যথেষ্ট শক্তিশালী নয় ।
(৩) এই কারনে মৌসুমি বায়ু সেপ্টেম্বর মাসের শেষে উত্তর ভারতের পাঞ্জাব পর্যন্ত, মধ্য অক্টোবরে মধ্য ভারত পর্যন্ত এবং নভেম্বর মাসের প্রথমে দক্ষিণ ভারত পর্যন্ত আসতে পারে ।
(৪) এই সময়ের পর সূর্য মকরক্রান্তিয় অঞ্চলে লম্বভাবে কিরণ দেয় । ফলে ভারত মহাসাগরের জলভাগ ভারতের স্থলভাগের তুলনায় বেশি উত্তপ্ত হয় ও ভারত মহাসাগরে নিন্মচাপের সৃষ্টি হয় । ফলে ভারতের স্থলভাগ থেকে উচ্চচাপের বায়ু দক্ষিণ–পশ্চিম মৌসুমি বায়ু প্রবাহের বিপরীতে ভারত মহাসাগরের নিম্নচাপ অঞ্চলের দিকে প্রবাহিত হতে থাকে । এই ঘটনাকে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর প্রত্যাবর্তন বলে ।
(৫) কিন্তু বঙ্গোপসাগরের উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় সময় কিছু পরিমাণ জলীয় বাস্প সংগ্রহ করে এই বায়ু অন্ধ্র ও করমণ্ডল ( তামিলনাড়ু) উপকূলে শরৎকালে বৃষ্টিপাত ঘটায় । ফলে করমণ্ডল ও অন্ধ্র উপকূলে বছরে দু-বার বৃষ্টিপাত হয় ।
(৬) এই সমর বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হওয়া ঘূর্ণিঝড় ভারতের পূর্ব উপকূল ও বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূল অঞ্চলে প্রবল আঘাত হানে এবং জীবন ও সম্পত্তিনাশের কারণ হয় । পশ্চিমবঙ্গে এই ঘূর্ণিঝড় আশ্বিনের ঝড় নামে পরিচিত ।
শীতকাল (Winter) :-
(১) শীত ঋতুটি ভারতে ডিসেম্বর মাসে শুরু হয়ে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত স্থায়ী হয় ।
(২) এই সময় সমুদ্রের সমভাবাপন্ন প্রভাব থেকে বহুদূরে অবস্থিত উত্তর ভারতের সমভূমি অঞ্চলের পাঞ্জাব, রাজস্থান ও হিমালয় সন্নিহিত স্থানে তাপমাত্রা সবচেয়ে কম থাকায় সেখানকার বায়ুমণ্ডলে উচ্চচাপের সৃষ্টি হয় । অন্যদিকে, সমুদ্রের সমভাবাপন্ন জলবায়ুর প্রভাবে এবং নিরক্ষরেখার নিকটবর্তী হওয়ায় এই সময় দাক্ষিণাত্যের মালভূমি অঞ্চলে কিছুটা বেশি উষ্ণতা পরিলক্ষিত হয় ।
(৩) দক্ষিণ ভারতে তামিলনাড়ুতে শীতকালে তাপমাত্রা যখন ২৫° থেকে ২৬° সেলসিয়াস থাকে, তখন ওই একই সময়ে উত্তর ভারতের পাঞ্জাবের তাপমাত্রা থাকে ১৩° থেকে ১৮° সেলসিয়াস । সর্বনিম্ন তাপমাত্রা অনুভূত হয় উত্তর পশ্চিম ভারতে প্রায় ৫° সেলসিয়াস । অথচ এই সময় দাক্ষিণাত্যের উপদ্বীপ অঞ্চলের তাপমাত্রা ২৪° সেলসিয়াসের নিচে নামে না । শীতকালে উত্তর ভারতের পার্বত্য অঞ্চলের উত্তরপ্রদেশ (গোমুখ ও কেদার-বদ্রী), জম্মু-কাশ্মীর ও হিমাচল প্রদেশের ( মানালী, লাহুল ও স্পিতি অঞ্চল) বিভিন্ন অঞ্চলের তাপমাত্রা প্রায় -১° সেলসিয়াস থেকে -৪০° সেলসিয়াস পর্যন্ত হিমাঙ্কের নিচে নেমে যায় ।
(৪) শীতকালে ভূমধ্যসাগরীয় পশ্চিমাবায়ু পশ্চিম দিক থেকে কাশ্মীরে ও পাঞ্জাবে প্রবেশ করে । ফলে এই অঞ্চলে কিছু বৃষ্টিপাত ও তুষারপাত হয়, একে পশ্চিমী ঝঞ্ঝা বলে । এই বৃষ্টিপাতের ফলে বিশেষত পাঞ্জাব ও হরিয়ানায় গম চাষের সুবিধা হয় । শীতকালে মাঝে মাঝে শৈত্যপ্রবাহ দেখা যায়, এতে তাপমাত্রা খুব কমে যায় । ভোরের দিকে এই কুয়াশা পড়ে ।
ভারতের জলবায়ুর বৈশিষ্ট্য
ভারতের জলবায়ুর নিম্নলিখিত প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি পরিলক্ষিত হয় :-
(১) ঋতু পরিবর্তন :- বছরের বিভিন্ন সময়ে ঋতু পরিবর্তন হল ভারতের জলবায়ুর অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য— (ক) মার্চ মাস থেকে মে মাস গ্রীষ্মকাল (খ) জুন মাস থেকে সেপ্টেম্বর মাস বর্ষাকাল (গ) অক্টোবর মাস ও নভেম্বর মাস শরৎকাল এবং (ঘ) ডিসেম্বর মাস থেকে ফেব্রুয়ারি মাস শীতকাল । এই চারটি প্রধান ঋতু ভারতের জলবায়ুতে চক্রাকারে আবর্তিত হয় । এছাড়া ভারতে (ঙ) শীতের আগে হেমন্ত এবং (চ) শীতের পরে বসন্ত নামে অপর দুটি ঋতুর আভাস পাওয়া যায় ।
(২) মৌসুমি বায়ু বায়ু প্রবাহ :- গ্রীষ্মকালীন দক্ষিণ–পশ্চিম মৌসুমি বায়ু এবং শীতকালীন উত্তর–পূর্ব মৌসুমি বায়ু প্রবাহের প্রভাবে ভারতের ঋতু পরিবর্তন হয় । মৌসুমি বায়ুর দ্বারা প্রভাবিত হওয়ায় ভারতকে “আন্তঃমৌসুমি বায়ুর দেশ” বলা হয় । গ্রীষ্মকালে ভারতে মৌসুমি বায়ু যে দিক থেকে আসে, শীতকালে ঠিক তার বিপরীত দিক থেকে প্রবাহিত হয় ।
(৩) চরমভাবাপন্ন জলবায়ু :- উত্তর ভারতের জলবায়ু দক্ষিণ ভারতের জলবায়ুর তুলনায় অনেক বেশি চরমভাবাপন্ন, অর্থাৎ উত্তর ভারতের শীত ও গ্রীষ্ম দুটোই খুব তীব্র ।
(৪) গ্রীষ্মকালীন তাপমাত্রা :- গ্রীষ্মকালে ভারতের বেশির ভাগ স্থানে মার্চ মাস থেকে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেতে থাকে । এপ্রিল মাসে উষ্ণতা আরো বেশি বেড়ে যায় । এই সময় উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের উষ্ণতা ৩৮ ডিগ্রি থেকে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছায় । গ্রীষ্মকালে মে মাসে উত্তর ভারতের তাপমাত্রা সর্বোচ্চ হয় । এই সময় মধ্যপ্রদেশ ও গুজরাটের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৮ ডিগ্রি থেকে ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছায় । গ্রীষ্মকালে মে মাসে উত্তর-পশ্চিম ভারতের শুল্ক অঞ্চল সবচেয়ে বেশি উত্তপ্ত হয় । গ্রীষ্মকালে সময় সময় পশ্চিম ভারতের থর মরুভূমি অঞ্চলের তাপমাত্রা ৪৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসও ছাড়িয়ে যায় ।
(৫) শীতকালীন তাপমাত্রা :- শীতকালে উত্তর ভারতের তাপমাত্রা দক্ষিণ ভারতের তাপমাত্রার তুলনায় বেশ কম থাকে । এই সময় উত্তর ভারতের তাপমাত্রা গড়ে ১০ ডিগ্রি থেকে ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস হয় । শীতকালে দক্ষিণ ভারতের গড় তাপমাত্রা থাকে ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মতো ।
(৬) বৃষ্টিপাত :-
(ক) ভারতের মোট বৃষ্টিপাতের ৮৪% বৃষ্টিপাত গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালে, ১৩% শরৎকালে, এবং ৩% শীতকালে সংঘটিত হয় ।
(খ) দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে গ্রীষ্মকালে ও বর্ষাকালে অর্থাৎ জুন, জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে ভারতের বৃষ্টিপাতের পরিমাণ সর্বাধিক হয় ।
(গ) উত্তর-পূর্ব মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে ভারতে শীতকালে প্রায় শুকনো থাকে; তামিলনাড়ুর উত্তর পূর্ব দিকে অবস্থিত করমণ্ডল উপকুল ছাড়া ভারতের অন্যত্র শীতকালে তেমন বৃষ্টিপাত হয় না ।
(ঘ) পশ্চিমী ঝঞ্ঝা এবং বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হওয়া নিম্নচাপের ফলে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে শীতকালে কিছুটা বৃষ্টি হয় ।
(ঙ) ভারতের বৃষ্টিপাত একটানা না হয়ে মাঝে মাঝে বৃষ্টিপাতে বিরতি ঘটে ।
(চ) ভারতের মৌসুমি বৃষ্টিপাতের সঠিক সময় এবং পরিমাণ এক এক বছরে এক এক রকমের হয় । মৌসুমি বৃষ্টিপাতের স্বল্পতা কোনও কোনও বছর ভারতে খরার অন্যতম প্রধান কারণ এবং অতিরিক্ত মৌসুমি বৃষ্টিপাত ভারতে বন্যার প্রধান কারণ ।
(ছ) ভারতে আঞ্চলিক বৃষ্টিপাতের অসম বন্টন দেখা যায়— পশ্চিম উপকুল, আন্দামান নিকোবর, উত্তর–পূর্ব রাজ্যসমূহ ও উত্তরবঙ্গে অত্যধিক বৃষ্টিপাত হয়; আবার রাজস্থানের মরুভূমি এবং লাদাখ, কারাকোরাম প্রভৃতি অঞ্চলে বছরে অতি অল্প বৃষ্টিপাত হওয়ায় এদের শুল্ক অঞ্চল বলা হয় ।
ভারতের জলবায়ুতে হিমালয় পর্বতের প্রভাব:- ভারতের সমগ্র উত্তর ভাগ জুড়ে হিমালয় পর্বত শ্রেণি বিস্তৃত থাকায় ভারতের জলবায়ুর উপর হিমালয় পর্বতের অসাধারণ প্রভাব রয়েছে ।
(১) হিমালয় পর্বতের অবস্থান ভারতীয় উপমহাদেশকে মধ্য এশিয়ার হাড় কাঁপানো শীতের হাত থেকে রক্ষা করেছে । হিমালয় পর্বত না থাকলে ভারতেও রাশিয়া ও চিনের মতো তীব্র শীতের প্রাবল্য দেখা যেত ।
(২) সমুদ্র থেকে আগত জলীয় বাস্প পূর্ণ দক্ষিণ–পশ্চিম মৌসুমি বায়ু হিমালয় পর্বতের দক্ষিণ ঢালে বাধা পেয়ে উত্তর ও মধ্য ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটায় । মৌসুমি বায়ু প্রবাহের দ্বারা সংঘটিত বৃষ্টিপাতে হিমালয় পর্বতের অসাধারণ প্রভাব রয়েছে ।
(৩) ভারত এমনিতে উষ্ণ মৌসুমি জলবায়ুর দেশ হলেও উচ্চতার প্রভাবে হিমালয়ের উঁচু পার্বত্য অঞ্চলে অনেকটা তুন্দ্রা অঞ্চলের মতো অতি শীতল জলবায়ু দেখা যায় ।
ভারতের মৌসুমি জলবায়ু
‘মৌসিম’ শব্দে এর অর্থ হল ঋতু । ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মৌসুমি বায়ু প্রবাহেরও পরিবর্তন হয় । স্থলভাগ ও জলভাগের উত্তাপের পার্থক্যের ফলে সমুদ্র বায়ু এবং স্থল বায়ুর মতো মৌসুমি বায়ুরও সৃষ্টি হয় । ভারতের জলবায়ু ও বৃষ্টিপাতে মৌসুমি বায়ুর বিরাট প্রভাব পরিলক্ষিত হয় । এইজন্য ভারতকে মৌসুমি বায়ুর দেশ বলা হয় ।
(১) ভারত ‘আন্তঃমৌসুমি জলবায়ুর দেশ হওয়ায় ভারতের অধিকাংশ বৃষ্টিপাত মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে ঘটে থাকে । বর্ষাকালে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু, শরৎকালে প্রত্যাবর্তনকারী মৌসুমি বায়ু এবং শীতকালে উত্তর–পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর প্রভাব ভারতের জলবায়ু ও বৃষ্টিপাতের উপর সবচেয়ে বেশি থাকে । গ্রীষ্মকালে দক্ষিণ-পূর্ব এবং শীতকালে উত্তর-পূর্ব এই দুটি বিপরীতমুখী বায়ুপ্রবাহের ফলে ভারতে আর্দ্র গ্রীষ্মকাল এবং শুষ্ক শীতকাল এই দুটি প্রধান ঋতুর সৃষ্টি হয়েছে ।
(২) দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে সমুদ্রের উপর দিয়ে আগত মৌসুমি বায়ুতে প্রচুর জলীয় বাস্প থাকে বলে বর্ষাকালের জুন মাস থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত ভারতের বিভিন্ন স্থানে প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটে ।
(৩) বর্ষাকালে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে ভারতে পশ্চিম উপকূলের উত্তরাংশ, অসম, মিজোরাম, পূর্ব হিমালয়, তরাই অঞ্চল এবং আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয় ।
(৪) দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর বঙ্গোপসাগরীয় শাখার প্রভাবে উত্তর–পূর্ব ভারতের গারো, খাসি ও পূর্ব হিমালয়ের পাদদেশবর্তী অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হলেও এই সব অঞ্চলের দক্ষিণ ও পশ্চিম দিকে বৃষ্টিপাত ক্রমশ কমে যেতে থাকে ।
(৫) দক্ষিণ–পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর আরব সাগরীয় শাখার প্রভাবে দক্ষিণ থেকে উত্তর ও উত্তর পশ্চিমে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ক্রমশ কমতে থাকে ।
(৬) মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে খাসি, গারো, পূর্ব হিমালয় এবং পশ্চিমঘাট পর্বতের প্রতিবাত ঢালে প্রবল শৈলোৎক্ষেপ বৃষ্টিপাত হলেও অনুবাত ঢালে বৃষ্টিহীন বা অল্পবৃষ্টিযুক্ত বৃষ্টিচ্ছায় অঞ্চলের সৃষ্টি হয়েছে ।
(৭) অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে শরৎকাল অথবা শীতকালের শুরুতে প্রত্যাবর্তনকারী মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড়ের সৃষ্টি হয় এবং করমণ্ডল উপকূলে বৃষ্টিপাত ঘটে ।
(৮) উত্তর–পূর্ব মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে শীতকালে ভারতে বৃষ্টিপাত খুব একটা হয় না, কেবল মাত্র করমণ্ডল উপকূলে ডিসেম্বর মাসে কিছুটা বৃষ্টিপাত হয় ।
(৯) দক্ষিণ–পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে ভারতে গ্রীষ্মকালীন উষ্ণতা কিছুটা কমে যায় ।
(১০) মৌসুমি বৃষ্টিপাতের ফলে হিমালয় পর্বত সহ ভারতের বিভিন্ন অংশে চিরহরিৎ, পর্ণমোচী এবং সরলবর্গীয় বৃক্ষের গভীর অরণ্যে সৃষ্টি হয়েছে । এইসব অরণ্য থেকে মুল্যবান কাঠ এবং অন্যান্য অরণ্য সম্পদ পাওয়া যায় ।
ভারতীয় কৃষিতে মৌসুমি বায়ুর প্রভাব
ভারতীয় কৃষিতে মৌসুমি বায়ুর বিরাট প্রভাব রয়েছে । মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে ভারতে প্রচুর পরিমাণে ধান, গম, পাট, আখ, তুলা বিভিন্ন ধরনের ডাল, নানান রকম তৈলবীজ, চা, কফি তামাক প্রভৃতি উৎপন্ন হয় ।
মৌসুমি বৃষ্টিপাতের অনিশ্চয়তা — খরা ও বন্যার প্রাদুর্ভাব:- ভারতে মৌসুমি বায়ুর ফলেই প্রধানত বৃষ্টিপাত ঘটে । দেশের মোট বৃষ্টি পাতের প্রায় ৯০ শতাংশ দক্ষিণ–পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে সংঘঠিত হয় । কিন্তু এই মৌসুমি বায়ু খুবই অনিশ্চিত । কারণ প্রতি বছর এই মৌসুমি বায়ু সমপরিমাণে জলীয় বাস্প নিয়ে আসে না । আবার এই মৌসুমি বায়ুর আগমন ও প্রত্যাগমন প্রতি বছর একই সময়ে ঘটে না । এর ফলে কোন বছর কম জলীয় বাস্প আমদানি ও দেরিতে আসার ফলে ভারতে অনাবৃষ্টি বা খরা দেখা দেয় । আবার কোনও বছর অতিরিক্ত পরিমাণ জলীয় বাস্প আমদানি এবং দক্ষিণ–পশ্চিম মৌসুমি বায়ু প্রবাহের খাম খেয়ালিপণার জন্য ভারতে প্রায়ই খরা ও বন্যার প্রাদুর্ভাব লক্ষ্য করা যায় ।
(ক) ভারতে খরার প্রধান কারণ :-
(১) মৌসুমি বৃষ্টিপাতের স্বল্পতা ভারতে খরার প্রধান কারণ ।
(২) ভারতের কোনও স্থানে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বর্ষা দেরিতে আসা সেই স্থানের খরার অন্যতম কারণ
(৩) স্বাভাবিক সময়ের আগে মৌসুমি বায়ু প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেলে খরা সৃষ্টি হয় ।
(৪) কোন স্থান বর্ষাকালের মধ্যেও বেশ কিছুদিন বৃষ্টিহীন অবস্থায় থাকলে খরা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় ।
(৫) বনভুমির অভাবের জন্য সূর্যের প্রচন্ড তাপে গ্রীষ্মকালে প্রচুর পরিমাণে ভৌম জল বাষ্পীভূত হয়ে যায় এবং মাটি ফেটে চৌচির হয়ে খরার সৃষ্টি করে ।
(৬) পরিবেশ দূষণের জন্য বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার ফলে মৌসুমি বায়ু ঘনীভূত না হতে পারলে খরার সৃষ্টি হয় ।
(খ) ভারতে বন্যার প্রধান কারণ :-
(১) কোনও স্থানে একটানা অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত ঘটলে সেই স্থানে বন্যার দেখা দেয় ।
(২) মৌসুমি বৃষ্টিপাত দীর্ঘায়িত হলে অতিবৃষ্টির ফলেও বন্যার সৃষ্টি হয় ।
(৩) নদীর বহন ক্ষমতা কমে এলে বা জলনিকাশী ব্যবস্থা বুজে এলে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত না হলেও বন্যার সৃষ্টি হতে পারে । ২০০০ সালে এই কারণে ভারতের বিভিন্ন স্থানে বিশেষত পশ্চিমবঙ্গে বন্যার সৃষ্টি হয় ।
(৪) বর্ষাকালে বাঁধ বা জলাধার থেকে বাধ্য হয়ে অতিরিক্ত জল ছাড়লে বন্যার সৃষ্টি হয় । এটিও পশ্চিমবঙ্গে বন্যা হওয়ায় অন্যতম প্রধান কারণ ।
(৫) কখনও কখনও ভূমিক্ষয়ও বন্যার অন্যতম প্রধান কারণ হিসাবে দেখা দেয় । ভূমিক্ষয়ের ফলে ক্ষয়ে যাওয়া মাটি নদী গর্ভে জমা হয় এবং নদীর গভীরতা কমিয়ে দেয় । এর ফলে নদীর জল বহন ক্ষমতা কমে গিয়ে বন্যার সৃষ্টি করে ।
ভারতে খরা ও বন্যা নিয়ন্ত্রণের উপায় :-
(১) ভারতের বন্যাপ্রবণ অঞ্চলগুলো নির্দিষ্ট ও উপযুক্ত স্থানগুলোতে ছোটো ছোটো বাঁধ ও জলাশয় তৈরি করে, প্রধান নদী ও উপনদীগুলোর ওপর বড়ো বড়ো বাঁধ ও জলাশয় তৈরি করে বন্যার জলকে ধরে রেখে তার ক্ষতিকর প্রভাব থেকে ভারতের বন্যাপ্রবণ অঞ্চলগুলোর অধিবাসীদের রক্ষা করা যায় ।
(২) গ্রীষ্মকালে খরা জনিত পরিস্থিতির সময় বাঁধ ও জলাশয়ে ধরে রাখা জলকে আধুনিক প্রক্রিয়ার সাহায্যে জলসেচের কাজে লাগিয়ে বন্যাপ্রবণ অঞ্চলের বহুদূরবর্তী খরা প্রবণ অঞ্চলকে খরার প্রকোপ মুক্ত করা সম্ভব ।
(৩) কখনও কখনও ভুমিক্ষয়ও বন্যার অন্যতম প্রধান কারণ হিসাবে দেখা দেয় । ভুমিক্ষয়ের ফলে ক্ষয়ে যাওয়া মাটি নদীগর্ভে জমা হয়ে নদীর গভীরতা কমিয়ে দেয়, ফলে নদীগর্ভ আর বর্ষার জল বহন করতে পারে না বলে বর্ষাকালে নদীতে বন্যা দেখা দেয় । নদীগর্ভ বুঁজে গেলে বর্ষাকালে জল নিকাশের পথ রুদ্ধ হয়ে বন্যার সৃষ্টি হয় । নদীগর্ভে নিয়মিতভাবে ড্রেজিং করে তাদের নাব্যতা বাড়িয়ে বন্যার প্রকোপ অনেকটা কমানো যায় ।
(৪) বনভুমির অভাবের জন্য বৃষ্টিপাত কম হলে বৃক্ষরোপণ প্রকল্পের সাহায্যে প্রচুর গাছ লাগিয়ে আংশিক ভাবে খরা নিয়ন্ত্রন করা যায় ।