ভারতের সংবিধান

ভারতের সংবিধান প্রণয়নের পটভূমি

ব্রিটিশ ভারতের বিভিন্ন আইনের সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা

1.ভারতশাসন আইন, ১৮৫৮ : (The Government of India Act, 1858)
(a) ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী কর্তৃক অধিকৃত ভারতের ভূখণ্ড ইংল্যাণ্ডের মহারাণী ভিক্টোরিয়ার হাতে ন্যস্ত হয়। ভারতীয় ভূখণ্ডের উপর সমস্ত ক্ষমতার অধিকারী হলেন রাণী। উক্ত আইনের মাধ্যমে ঘােষণা করা হয় রাণীর নামেই শাসনকার্য পরিচালিত হবে।
(b) কোম্পানীর অধীন স্থলবাহিনী ও নৌবাহিনীর উপর অধিকার ও কর্তৃত্ব ইংল্যাণ্ডের রাজা বা রাণীর উপর ন্যস্ত হয়।
(c) এই আইনে একজন ভারতসচিব (Secretary of State for India) পদের সৃষ্টি করা হয়। উক্ত সচিব ভারতের শাসনকার্য সম্পর্কিত যাবতীয় কাজকর্মের জন্য ব্রিটিশ পার্লামেন্টের কাছে দায়িত্বশীল থাকবেন।

2. ভারতীয় পরিষদ আইন, ১৮৬১ : (The Indian Councils Act, 1861)
(a) এই আইনের মাধ্যমে আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে ভারতবাসীর অংশ গ্রহণের সুযােগ সৃষ্টি করা হয়।
(b) এই আইনে সমগ্র দেশের বিচারব্যবস্থার মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের ব্যবস্থা করা হয়। এই উদ্দেশ্যে কলিকাতা, বােম্বাই ও মাদ্রাজে হাইকোর্ট প্রতিষ্ঠিত হয়। অর্থাৎ ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দের এই আইনের মাধ্যমে ভারতে বিচারব্যবস্থার ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারসাধন করা হয়।
(c) এই আইনের মাধ্যমে সীমিতভাবে হলেও, প্রাদেশিক আইনসভাগুলিকে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা দেওয়া হয়।

3. ভারতীয় পরিষদ আইন, ১৮৯২ : (The Indian Councils Act, 1892)
(a) ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের চাপে ব্রিটিশ সরকার কার্যনির্বাহী পরিষদে বেসরকারী সদস্য নিযুক্তির ক্ষেত্রে নির্বাচন ব্যবস্থাকে মেনে নেয়।
(b) প্রাদেশিক আইন পরিষদগুলিতেও পরােক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়।
(c) এই আইনে সীমিতভাবে প্রাদেশিক আইন পরিষদের ক্ষমতা বাড়ানাে হয়।

4. ভারতীয় পরিষদ আইন, ১৯০৯ : (The Indian Councils Act, 1909)
(a) এই আইনের দ্বারা কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইন পরিষদের সদস্যসংখ্যা বাড়ানাে হয়।
(b) এই আইনে নির্বাচন ব্যবস্থাকে স্বীকার করা হয়। কিন্তু সেই সঙ্গে সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে নির্বাচন প্রথা প্রবর্তন করা হয়। এই উদ্দেশ্যে পৃথক প্রতিনিধিত্বের পদ্ধতি প্রবর্তন করা হয়।
(c) এই আইনটি প্রণয়নের ক্ষেত্রে সমকালীন ভারতসচিব লর্ড মর্লি (Lord Morley) এবং ভাইসরয় লর্ড মিন্টো (Lord Minto) উদ্যোগী ভূমিকা গ্রহণ করেন। এই কারণে এই আইনটি ‘মর্লি-মিন্টো সংস্কার আইন’ (The Morley-Minto Reforms Act) নামে পরিচিত।

5. ভারতশাসন আইন, ১৯১৯ : (The Government of India Act, 1919)
(a) এই আইনের মাধ্যমে ভারতের শাসনকার্যের সঙ্গে ভারতীয়দের ক্রমশ অধিক যুক্ত করা ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসাবে দায়িত্বশীল শাসনব্যবস্থা চালু করার কথা ঘােষণা করা হয়।
(b) ভারতে স্বায়ত্তশাসনমূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে তােলার জন্য প্রাদেশিক সরকারগুলিকে অধিকতর স্বাধীনতা প্রদানের কথা বলা হয়।
(c) এই আইনে কেন্দ্রীয় আইনসভাকে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট এবং অপেক্ষাকৃত প্রতিনিধিত্বমূলক করা হয়।

6. ভারত শাসন আইন, ১৯৩৫ : (The Government of India Act, 1935)
(a) ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ভারতশাসন আইনই হল ভারতের শাসনতান্ত্রিক সংস্কার সাধনের ইতিহাসে ব্রিটিশ সরকারের শেষ পদক্ষেপ। অধ্যাপক জে. সি. জোহারী বলেছেন, “It should be treated as the last political gift of the British Imperialism”. এই আইনটি স্বাধীন ভারতের শাসনতান্ত্রিক বিকাশকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছে। ভারতের বর্তমান সংবিধানের রূপরেখা বহুলাংশে এই আইনটির পটভূমিতে রচিত হয়েছে।
(b) এই আইনে কেন্দ্রীয় আইনসভা দ্বিকক্ষবিশিষ্ট হয়। এর উচ্চকক্ষের নাম রাজ্য পরিষদ (Council of States) এবং নিম্নকক্ষের নাম যুক্তরাষ্ট্রীয় আইনসভা (Federal Assembly)।
(c) এই আইনটির মাধ্যমে ভারতে যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা গড়ে তােলার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। উক্ত আইনে বিভক্তিকরণ বা বিকেন্দ্রীকরণ (decentralization) পদ্ধতিতে এদেশে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়।
(d) এই আইনের সপ্তম তালিকায় তিনটি তালিকার মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্যসরকারগুলির মধ্যে ক্ষমতা বণ্টন করা হয়। এই তিনটি তালিকা হল—(i) কেন্দ্রীয় তালিকা (Central List), (ii) প্রাদেশিক তালিকা (Provincial List) এবং (iii) যুগ্ম তালিকা (Concurrent List)।
(e) এই আইনে একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালত (Federal Court) এর ব্যবস্থা করা হয়।

4. মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা : (Mountbatten Plan)
(a) ভারত বিভাগ ও পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
(b) ভারত ও পাকিস্তান উভয় রাষ্ট্রকেই ডােমিনিয়ন মর্যাদা দেওয়া।
(c) উভয় রাষ্ট্রেরই কমনওয়েলথ পরিত্যাগ করার অধিকার থাকবে।
(d) ভারতে ও পাকিস্তানে যােগদানে অনিচ্ছুক অঞ্চলসমূহের অধিবাসীদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রদান করা হয়।

5. ভারতীয় স্বাধীনতা আইন, ১৯৪৭ : (Indian Independence Act, 1947)
(a) এই আইনের মাধ্যমে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটে।
(b) ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনার প্রস্তাবগুলিকে বিধিবদ্ধ রূপ দেওয়ার জন্য এই আইনটি প্রণীত হয়।
(c) ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৮ই জুলাই রাজার সম্মতির পর বিলটি আইনে পরিণত হয়।
(d) এই আইনের মাধ্যমে অবিভক্ত ভারত বিভক্ত হয় এবং সৃষ্টি হয় ভারতীয় ইউনিয়ন ও পাকিস্তান।
(e) এই আইনের মাধ্যমে স্থির হয় নতুন সংবিধান প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত উভয় ডােমিনিয়ন এবং তাদের অন্তর্ভুক্ত প্রদেশগুলির শাসনকার্য ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ভারতশাসন আইন অনুসারে পরিচালিত হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *