মেহেরগড় সভ্যতা

পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন মেহেরগড় সভ্যতা

★প্রখ্যাত ফরাসি প্রত্নতাত্বিক জঁ ফ্রাঁসোয়া যারিজ (Jean-François Jarrige) ১৯৭৪ সালে ময়েঞ্জোদাড়োর পাশ্ববর্তী অঞ্চলে এই সভ্যতার শেকড় খুঁজতে গিয়ে খুঁজে পান এই অমূল্য রত্ন। আমার আপনার সবার শেকড় , পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন , ময়েঞ্জোদাড়োর থেকেও প্রাচীন , প্রস্তর যুগের (নিও লিথিক ) এই নগর কেন্দ্রিক সভ্যতার সন্ধান। এই জায়গার নাম মেহেরগড় ,বালুচ ভাষায় মেহের অর্থ ভালোবাসা /প্রেম আর গড় হলো স্বর্গ । দুটো মিলিয়ে ভালোবাসার স্বর্গ।

★প্রায় চল্লিশ বছরের আগেও আমরা জানতাম না এর কথা । জঁ খেয়াল করেন মহেঞ্জোদাড়ো যেন বড্ড সাজানো গোছানো একটা সভ্যতা। এই নগরকেন্দ্রিক সভ্যতার শুরু কি এইখানেই ? প্রশ্ন থেকেই তিনি পুরো অঞ্চলের উপর খোঁজাখুঁজি শুরু করেন। মূলতঃ তাদের মানে জঁ আর তার স্ত্রী ক্যাথরিন ফ্রান্সের প্রত্নতাত্বিক বিভাগের অধীনে পাকিস্তানের প্রত্নতাত্বিক বিভাগের সাথে সহযোগিতার মাধ্যমে এই কাজ শুরু করেন ১৯৭৪ এ। এই কাজের মেয়াদ ছিল ২০০০ সাল পর্যন্ত। প্রসঙ্গত এই মানুষটি একজন সিন্ধু দেশের উপর বিশেষজ্ঞ ও বটে।
এরপরের ঘটনা ইতিহাসের এক নতুন অধ্যায় এর সূচনা , পাকিস্থান আর ইরানের সংযোগ বোলান পাস অঞ্চলে মেহেরগড় গ্রামে এই মানুষটি খুঁজে পেলেন মহেঞ্জোদাড়োর হারানো সূত্র। এই অঞ্চল মানে বোলান পাস হলো পারস্য উপত্যকা –মধ্যএশিয়া- মহেঞ্জোদাড়োর একটি সংযোগ রাস্তা। ছয়টি জায়গায় ৩০০ হেক্টর জায়গা নিয়ে এই সুবিশাল কর্মকান্ড সফল করেন এই ফরাসী প্রত্নতাত্ত্বিক। এই গোটা কর্মকান্ড চলে ২৫ বছর ধরে। অজস্র প্রত্নতাত্ত্বিক সামগ্রীর সন্ধান পাওয়া যায় মূলত এই সভ্যতার একেকটি স্তরের উপর .ধারণা করা হয় এই অঞ্চলের মানুষরা ও একটু করে নিজেদের বসতি পরিবর্তন আর বিস্তার করছিল ফলত এই নানান স্তরের সূত্রপাত।
জঁ এবং তার দলের কাজের দুটো সময় দেখতে পাই :

★১৯৭৪ থেকে ১৯৮৬
এই সময় তিনি ওই মূল অঞ্চলটি খুঁজে পান .১৯৭৭ এ এই সফলতা পান যার প্রজেক্ট নাম দিয়েছিলেন MR3 , এরপর ১৯৮৫ থেকে ৮৬ সালে তিনি পাশের অঞ্চল নৌশেরার দিকে নজর দেন খননের জন্য।

★১৯৯৭ থেকে ২০০০
দ্বিতীয় পর্যায়ের খনন এই সময় শুরু হয় , এই সময়ের গুরুত্বপূর্ন আবিষ্কার হলো এই সভ্যতা প্রস্তর যুগের সময়ের আর এর সংযোগের পুরো ছবি খুঁজে পাওয়া :
এই বিষয়ে পুরো ছবি তুলে ধরেন জঁ ফ্রাঁসোয়ার স্ত্রী ক্যাথরিন। তার মতে এই অঞ্চলের (বোলান বেসিনের ) সভ্যতার সাথে পূর্ব ইরানের সাথে আফগানিস্থান ,মধ্যএশিয়া এবং সিন্ধু সভ্যতার সংযোগ ছিল অর্থাৎ একটি আদি পর্যায়ের মানুষের চলাচল অথবা বসবাস করার জন্য চলে আসার সূত্র দেখা যায়।

★এই সভ্যতার মানুষদের জীবনযাত্রা আর প্রযুক্তির ব্যবহার :

★এই সভ্যতা প্রশ্নাতীত ভাবে সিন্ধু সভ্যতার পূর্বসূত্র তুলে ধরেছে , পাকিস্থানের কায়েদে আজম বিশ্ববিদ্যালয় এর অধ্যাপক আহমেদ হাসান দানির ভাষ্যমতে পুরো সিন্ধু সভ্যতার উৎস নিয়ে ধারণার পরিবতর্ন করে দিয়েছে এই মেহেরগড় এর আবিস্কার।

★এই খনন এর আটটি স্তরের প্রত্যেকটিতে এই অঞ্চলের মানুষের নিজস্ব সভ্যতার ক্রমবর্ধমান একটা ছবি ফুটে উঠেছে । প্রথমদিকে একদম সরল কোনরকমে তৈরী কাদামাটির বাড়ি এমনকি ইট বা পোড়ামাটির ব্যবহার ও দেখা যায় না . এই সময়ের মানুষরা শস্য সঞ্চয় করতে পারলেও মূলত বুনো গম , যব, বার্লি আর খেজুর খেত .গবাদি পশু পালন ও প্রচলিত ছিল দেখা যায় . পরবর্তিতে লক্ষনীয় উন্নতি দেখা যায় . এই পর্যায়ে পোড়ামাটির ব্যবহার , ইটের ব্যবহার ,শস্য রাখার জায়গার উন্নয়ন,পাথরের যন্ত্রের উন্নতি করে ফেলে . এছাড়া পোড়ামাটির জিনিসপত্র ,চামড়ার ট্যানারি প্রযুক্তি , রুটি তৈরী ,ধাতুর ব্যবহার (ব্রোঞ্জ এবং তামা )করতে শুরু করে।
বিবরন :-

★খ্রিস্টপূর্ব ৭০০০ থেকে ৫৫০০ সাল :
এই সময়টি ফরাসী দম্পতির খনন আর পর্যবেক্ষন অনুযায়ী একদম শুরুর সময় বলা যায় .আট স্তরের প্রথম দিকের স্তরের থেকেই পশুপালন ,কৃষির প্রচলন , সামুদ্রিক জিনিস এর ব্যবহার এর সূচনা দেখা যায় .তার মতে এই সময়েই মানুষ তার ভ্রাম্যমান অবস্থার থেকে স্থিতিশীল অবস্থায় পরিবর্তিত হচ্ছিল এই সময়েই সরল ধাচের গয়না , লাইম স্টোন এর ব্যবহার ছাড়াও কিছু রীতিনীতির প্রয়োগ দেখা যায় .এর উদাহরন হিসাবে মৃতদেহ কবর দেওয়া ,নারী পুরুষ এর কবরের শ্রেণী বিভাজন ও দেখা যায় . একটি মহিলার কবরে কিছু গয়না আর একটি ছাগল এর কঙ্কাল এবং পুরুষের কবরে পাথরের নানান ব্যবহার্য জিনিস আর পাথরের ফলার বর্শা দেখে মনে হয় পারলৌকিক রীতি নীতির প্রচলন শুরু হয়েছিল।

★খ্রিস্টপূর্ব ৫৫০০ থেকে ৩৫০০ সাল বা দ্বিতীয় এবং তৃতীয় স্তরের বিবরণ
এই পর্যায়ের তিনটি ধাপে আবার ভাগ করেন এই প্রত্নতাত্বিক। তার খোঁজ থেকে জানতে পারি সিরামিক প্রযুক্তির উন্নতি , পোড়া মাটির জিনিসে রঙের ব্যবহার শুরু হয়। এছাড়া তামার জিনিসের উপর কাজ করার যন্ত্রপাতি , ধাতু আলাদা করার ব্যবস্থা শুরু হয়েছিল। আরো শুরু হয়েছিল জ্যামিতিক নকশার ব্যবহার। ত্রিভুজ ,নকশা করার পদ্ধতি , চতুর্ভুজীয় নকশা ইত্যাদির ব্যবহার দেখা যায়। এছাড়া পারলৌকিক কাজের উপাচার বেড়েছিল , কবরে রঙের ব্যবহার ও শুরু হয়েছিল। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন হলো ধাতুর ব্যবহার বেড়েছিল প্রচুর।

★খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০০ থেকে ২০০০ সাল অথবা চতুর্থ থেকে অষ্ঠম স্তর এর বিবরণ :
এই পর্যায়ে পাথরের ব্যবহার যৎসামান্য হয়ে যায়। ধাতুর বহুল ব্যবহার এবং বসবাস এর ধাঁচ আরো কাছাকাছি হয়ে আসে। গুরুত্বপূর্ণ হলো এর শেষ ধাপ, ওই ধাপ মহেঞ্জোদারোর সমসাময়িক। এই সময়ে মেহেরগড় থেকে ক্রমশ পাশ্ববর্তী নৌশেরু অঞ্চলে এই জনবসতি সরে আসে।
পুরো সভ্যতার নানাবিধ বৈশিষ্ট :
এই সভ্যতার উন্নতির সাথে সাথে অনেক গুলো বৈশিষ্ট ফুটে উঠেছিল।

★সাধারনের বাড়ি গুলো হতো আয়তাকার

★শস্যাগার এর বহুল প্রচলন আর সঙ্গে ধাতু বা অন্য প্রয়োজনের জন্য চুল্লির প্রচলন

★সেচ ব্যবস্থার প্রচলন এবং নানান ফসল বিশেষতঃ গমের বেশ কিছু আলাদা জাতির খোঁজ পায়। পশু আহারের প্রচলন ও বাড়ে ফলে খাদ্য বৈচিত্র আসতে শুরু করে।

★এই সভ্যতার চতুর্থ ধাপ থেকে ব্যবহারের জিনিসের উপর শিল্পের ছোঁয়া দেখতে পাওয়া যায়।

★ মূর্তি এমনকি শুধু একটি মাতৃমূর্তি থেকে নারী রূপে ঈশ্বরের উপাসনার ধারণা করা হয়

★ একটি জায়গায় বেশ কিছু কবরের সন্ধান পাওয়া যায় যাতে ২ থেকে ৩ বছরের কিছু শিশুর কবর পাওয়া যায় , দেহগুলো সমাধি দেওয়ার রীতি ছিল পূর্ব পশ্চিমে দিক করে আর দেহ গুলো ভাঁজ করে রাখা ছিল। অর্থাৎ একটি পারলৌকিক রেওয়াজ তৈরির প্রমান পাওয়া যায়।

★খ্রিস্টপূর্ব ১৯০০ এবং শেষ পর্বের মেহেরগড় :
এই সময়ের ধাপে এই পটারির কাজ আর মাটির এবং জ্যামিতিক কাজের উপকরণ গুলো পাওয়া যায় মধ্য এশিয়া , পারস্য আর ময়েঞ্জোদাড়োর কাজগুলোর সাথে মিল পাওয়া যায়। এই সময়ের হাজার হাজার প্রত্নতাত্বিক জিনিস , চুল্লির প্রমান , বাড়ির নকশা , শস্যের ধাঁচ আর বৈচিত্র পুরো ইতিহাসের ধারা বদলে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *