হিমালয় পর্বত শ্রেণী
ভারতের উত্তর সীমা বরাবর বিস্তৃত হিমালয় পর্বত পৃথিবীর উচ্চতম পর্বত শ্রেণী। এই হিমালয় পর্বতেই রয়েছে পৃথিবীর সুউচ্চ পর্বত শৃঙ্গ গুলি, যেমন – মাউন্ট এভারেস্ট, গডউইন অস্টিন, কাঞ্জনজঙ্ঘা প্রভৃতি।
ধারণা করা হয়, বর্তমানে যে অঞ্চলটিতে হিমালয় পর্বতমালা অবস্থান করছে, সেখানে আজ থেকে প্রায় সাত কোটি বছর আগে টার্সিয়ারি যুগে টেথিস নামক এক অগভীর সমুদ্র বা মহীখাত ছিল। এই অগভীর সমুদের উত্তরে আঙ্গারাল্যান্ড নামক এবং দক্ষিণে গঙ্গোয়ানাল্যান্ড নামক বিশাল ভূখন্ড দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিল। কোটি কোটি বছর ধরে এই দুটি প্রাচীন ভূখন্ড থেকে ক্ষয়প্রাপ্ত পলি টেথিস মহিখাতে সঞ্চিত হতে থাকলে সেই সঞ্চিত পলির চাপে টেথিস মহিখাতে ভূ -আন্দোলনের সৃষ্টি হয়। এই ভূ – আন্দোলনের ফলে গণ্ডোয়ানা ল্যান্ডের তলদেশে ভারতীয় পাত এবং আঙ্গারাল্যান্ড এর তলদেশের এশীয় পাত সচল হয়ে পড়ে। ভারতীয় পাতের গতিবেগ বেশি হওয়ায় তা এশীয় পাতের দক্ষিণে প্রবল আঘাত করে। ফলে এই দুটি বিশাল ভূখন্ড এর মধ্যবর্তী স্থা
নে সঞ্চিত পলি প্রবল পার্শ্ব চাপের ফলে ভাঁজ খেয়ে সুবিশাল হিমালয় পর্বতের সৃষ্টি হয়। ভাঁজ প্রাপ্ত হয়ে সৃষ্টি হয় বলে হিমালয় কে নবীন ভঙ্গিল পর্বতও বলা হয়।
বিশ্বের সর্বোচ্চ ও সর্বাপেক্ষা নবীন পর্বতশ্রেণী। এটি কোন একক শ্রেণী বা মালা নয়, বরঞ্চ একটি ধারা
বাহিক শ্রেণী, একে অন্যের প্রায় সমান্তরাল ধারায় লম্বা দূরত্ব স্থাপন করেছে। আবার কোথাও দুটি ধারা এক সঙ্গে মিশে গেছে। এরই মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য উপত্যকা, অধিত্যকা আর বালিয়াড়ি। সমভূমি থেকে সারিবদ্ধ অনুচ্চ পাহাড়ের ভিত ধরে উচ্চ থেকে আরও উচ্চে উঠে গেছে হিমালয়ের শ্রেণী আর তার অভ্রবেদী চূড়াশৃঙ্গ, যেগুলোর মধ্যে রয়েছে সুবিখ্যাত মাউন্ট এভারেস্ট (৮,৮৪৮ মি), মাউন্ট K2 (৮,৬১০ মি), কাঞ্চনজঙ্ঘা (৮৫৮৫ মি) ইত্যাদি। এর মধ্যে কিছু পর্বতমালার গতি প্রধান হিমালয় বলয়ের অনুপ্রস্থ বা আড়াআড়ি। এগুলো হচ্ছে আসাম রেঞ্জ, মণিপুর রেঞ্জ, আরাকান ইয়োমা
হিমালয় ও অন্যান্য মধ্য এশীয় পর্বত পৃথিবীর ছাদ অর্থাৎ পামীর মালভূমি থেকে উত্থিত হয়ে বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে গেছে। পামীর মালভূমি থেকে হিমালয় ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তর, পশ্চিম ও পূর্ব দিক বেষ্টন করে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে বিস্তৃত হয়েছে। এই পর্বতশ্রেণীর পূর্বাঞ্চল পশ্চিমাঞ্চলের তুলনায় সংকুচিত এবং পরস্পরের খুব কাছাকাছি।
হিমালয়ের প্রধান প্রধান শ্রেণীমালা আফগানিস্তান ও মায়ানমারের সীমান্ত মধ্যবর্তী প্রায় ৩০০০ কিমি স্থান জুড়ে বিরাজমান।
ভৌগোলিকভাবে হিমালয় পর্বত পাকিস্তানের গিলগিটে সিন্ধু নদী থেকে শুরু করে ভারত, তিববত, নেপাল, পূর্ব ভারত ও ভুটান হয়ে দক্ষিণপূর্ব তিববতে ব্রহ্মপুত্র নদের দক্ষিণাঞ্চলীয় বাঁক পর্যন্ত বিপুল স্থলভাগ জুড়ে রয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ কিছু নদী, যেমন সিন্ধু (Indus), শতদ্রু (Sutlej), কালি, তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্র আড়াআড়িভাবে হিমালয়ের বুক চিড়ে ছুটে চলেছে। সিন্ধু ও শতদ্রু নদীর মধ্যবর্তী হিমালয়ের অংশটুকু পাঞ্জাব ও কাশ্মীর হিমালয় নামে পরিচিত (৫৬৩ কিমি)। শতদ্রু ও কালি নদীর মধ্যবর্তী পরবর্তী অংশটি কুমায়ূন হিমালয় (৩২২ কিমি) এবং কালি ও তিস্তা নদীর মধ্যবর্তী তৃতীয় অংশটি নেপাল হিমালয় নামে পরিচিত। তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্র মধ্যবর্তী চতুর্থ অংশটির নাম আসাম হিমালয় (৭২৪ কিমি)।
ভূতাত্ত্বিকভাবে হিমালয় পর্বতবলয়কে উপ-হিমালয় (শিওয়ালিক অবক্ষেপে গঠিত); নিম্ন হিমালয় (Lower Himalaya- উচ্চতা ১৫০০ থেকে ৩০০০ মিটার); উচ্চ হিমালয় (Higher Himalaya- উচ্চতা ৩০০০ থেকে ৮০০০ মিটার), সিন্ধু- জেইনবো (Zangbo) সন্ধি বলয় ও আন্তঃহিমালয় (Trans-Himalaya) – এ কয়টি ভাগে ভাগ করা যায়। উচ্চ হিমালয়ে ৮০০০ মিটারের ঊর্ধ্বে বেশ কয়েকটি বরফাচ্ছাদিত শৃঙ্গ রয়েছে, যেমন এভারেস্ট, অন্নপূর্ণা, মানাসলু।
মূলত ভারতীয় পেট ও এশিয়ান পেটের মধ্যে এক সংঘর্ষের ফলে হিমালয়ের সৃষ্টি। আজ থেকে প্রায় ৪ কোটি বছর আগে গন্ডোয়ানাল্যান্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ভারত পূর্বমুখে ভাসমান অবস্থায় এশীয় স্থলভাগের সঙ্গে ধাক্কা খায়। মধ্যবর্তী টেথিস সাগর দক্ষিণ তিববতের গর্ভে উত্তরমুখী অধোগমনের (subduction) দ্বারা হারিয়ে যায়, আর এই সংঘর্ষ হিমালিয় গিরিজনি বলয়ের সৃষ্টি করে। বিগত ৪ কোটি বছর ধরে প্রতিবছর প্রায় ৫ সেমি হারে ভারতীয় পেটের অব্যাহতভাবে উত্তরমুখী বিচলন একে এশিয়ান পেটের ভিতর ঠেলে দিয়েছে এবং ভারতের উত্তর প্রান্তের প্রচন্ড সংঘট (thrusting), হিমালয় পর্বতমালায় ও চীনে চ্যুতি ও ভূমিকম্প, তিববতে ফাটল ও চ্যুতি এবং হিমালয়ের উত্থান, যা আজও বছরে কয়েক মিলিমিটার হারে উঠছে, এসব কিছুই ফলত ব্যাপক সংকোচনের প্রতিফলন।
মহাদেশীয় সংঘর্ষ আনুমানিক ৬ কোটি ৫০ লক্ষ বছর থেকে ৪ কোটি ৫০ লক্ষ বছর আগে সংঘটিত হয়েছিল। মহাদেশীয় সংঘর্ষের পর হিমালয়ের উত্থান ও নগ্নীভবন কালের ধারায় কোন একরকম (uniform) ঘটনা ছিল না, বরং একটি সুদীর্ঘ ঘটনার অন্তর্গত উপাখ্যানমূলক (episodic) ছিল। প্রাপ্ত তথ্যাদির সংশেষণে যে ছবি ফুটে ওঠে তা হচ্ছে: প্রাক-মায়োসিন (২ কোটি ১০ লক্ষ থেকে ১ কোটি ৭০ লক্ষ বছর আগে) উত্থান-নগ্নীভবন পর্ব; উত্তর-মায়োসিন (১ কোটি ১০ লক্ষ থেকে ৭০ লক্ষ বছর আগে) উত্থান-নগ্নীভবন পর্ব এবং কোয়াটারনারি উত্থান-নগ্নীভবন পর্ব।
বাংলাদেশের বঙ্গীয় অববাহিকা উত্তরে পূর্ব হিমালয় ও পূর্বে ইন্দো-বার্মা শ্রেণীমালা থেকে প্রধানত আহূত গিরিজনি অবক্ষেপে পূর্ণ। পূর্ব হিমালয় থেকে একটি ব্যাপক প্রাচীন জলনিকাশ ব্যবস্থা (Paleo-drainage system) শিওয়ালিক বা ইন্দোব্রাহ্ম নদী নেমে এসে আজকের আসামের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে পূর্বদিক থেকে সিলেট খাদে (সুরমা অববাহিকা) গিরিজনি অবক্ষেপ এনে ফেলেছে। চট্টগ্রাম অঞ্চলের অবক্ষেপ এসেছে ইন্দো-বার্মা পর্বতশ্রেণী থেকে। যদিও বঙ্গীয় অববাহিকার মায়োসিন স্তরের গুরুত্বপূর্ণ অবক্ষেপের উৎস ছিল সম্ভবত হিমালয়ের পূর্বাঞ্চলের প্রথম দিককার উত্থানসমূহ।
হিমালয়ের ওপর সবিস্তার অনুসন্ধান ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে শুরু হলেও, পর্বতমালাটি সম্পর্কে প্রাপ্ত তথ্যের অধিকাংশই ১৯৫০ সালের পর থেকে অর্জিত। স্যার এডমন্ড হিলারী ও তেনজিং নরগে ১৯৫৩ সালে প্রথম পৃথিবীর সর্বোচ্চ গিরিশৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্টে আরোহণ করেন।
হিমালয় পর্বতমালার আত্মপ্রকাশ আমাদের গ্রহের নবজীবীয় (সিনোজোয়িক) ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা- শুধু এর ভূতাত্ত্বিক সংশেষের কারণেই নয়, বরং এশিয়ার প্রতিবেশগত ভারসাম্যে এর প্রভাবের কারণেও। বিশাল এই উপমহাদেশে তুষার-হিমবাহের একটিই আস্তানা, আর তা হচ্ছে হিমালয়- যার গগনস্পর্শী সুউচ্চ চূড়াগুলো স্থায়িভাবে জমাট বরফের বিস্তীর্ণ আস্তরণে ঢাকা; যেখান থেকে নেমে আসছে অসংখ্য ছোট-বড় হিমেল রসনা (tongues of ice) যেগুলো হিমবাহ (glacier) নামে পরিচিত। বাংলাদেশের সীমান্তের কাছে চিত্তাকর্ষক কয়েকটি হিমবাহ হচ্ছে ২৬ কিমি দীর্ঘ জেমু (সিকিম) ও কাঞ্চনজঙ্ঘা (দৈর্ঘ্য ১৬ কিমি)। হিমালয়ের আকাশ ছোঁয়া রংধনু চূড়াগুলো পর্বতারোহীদের হাতছানি দিয়েছে যুগ যুগ ধরে। প্রায় অগম্য এই সুউচ্চ চূড়ায় ভ্রমণের সুবিধা নেই, এমনকি বিমানপথেও নয়। কেবলমাত্র দক্ষিণাঞ্চলীয় পর্বত পাদদেশে যাওয়ার রেল সংযোগ রয়েছে। কাশ্মীর ও চীনের মধ্যে এবং ভারত থেকে নেপাল ও সিকিম হয়ে চীন পর্যন্ত রয়েছে পাকা রাস্তা। কাঠমান্ডু আর শ্রীনগরে রয়েছে বড় বিমানবন্দর। বরফ ঢাকা আর দারুণভাবে হিমায়িত হিমালয়ের দক্ষিণ ঢাল ভারত উপমহাদেশের গুরুত্বপূর্ণ নদীসমূহের উৎসভূমি, যার মধ্যে রয়েছে সিন্ধু, শতদ্রু, গঙ্গা আর ব্রহ্মপুত্রের মতো আন্তর্জাতিক সব নদী।
বন্ধুরতার জন্য হিমালয় পর্বতমালায় মানুষের বসবাসযোগ্য অঞ্চলের পরিমাণ কম। অপ্রধান হিমালিয় শ্রেণীর একটি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ বৈচিত্র্য এই যে, ভারতের সমভূমির দিকে মুখ করে থাকা এর দক্ষিণাঞ্চলীয় ঢালসমূহ এর উত্তরাঞ্চলীয় ঢালসমূহের চেয়ে অনেক বেশি খাড়া। আবার উত্তরাঞ্চলীয় এই ঢালগুলো প্রায় সর্বত্রই ঘন জঙ্গলাবৃত, যা উপরের দিকে ক্রমশই পাতলা হতে হতে এমন উচ্চতায় পৌঁছেছে, যেখানে ঠান্ডায় উদ্ভিদরাজির বেuঁচ থাকা সম্ভব নয়। সে স্থানে পর্বতমালা তুষার আর কঠিন বরফের প্রলেপে আচ্ছাদিত। দক্ষিণাঞ্চলীয় ঢালগুলো খুব খাড়া এবং সূর্যের কড়া অাঁচে এতই তপ্ত যে, সেখানে যেমন কোন উদ্ভিদ বাড়তে পারে না তেমনি বরফ জমতে পারে না। দক্ষিণের পর্বত পাদদেশীয় তরাই সমভূমি ঘনজঙ্গল আর জলাভূমিতে আবৃত। সেখানে অসংখ্য বন্যপ্রাণীর বাস। পর্বতের যে অংশ বঙ্গোপসাগর থেকে ধেয়ে আসা মৌসুমি বায়ুর আওতার মধ্যে সেখানে গাছ-গাছালির প্রাচুর্য খুবই বেশি, যেমন সিকিম। গ্রীষ্মমন্ডলীয় মৌসুমি বনাঞ্চলের গাছপালা থেকে আদ্র, স্যাঁতসেঁতে ও শুষ্ক পর্ণমোচী (deciduous) শাল বনের গাছপালার পার্থক্য লক্ষণীয়। আবার সিন্ধু ও কুনার উপত্যকায় মরুভূমির দেখা পাওয়া যায়। ঢাল যেখানে অল্প, সেখানে পশুচারণ ভূমি গড়ে উঠেছে। উপত্যকাময় অঞ্চলে চলেছে কৃষিকাজ। বাংলাদেশের সীমান্ত সংলগ্ন পূর্ব ভারতের প্রাণিকুলের মধ্যে রয়েছে বানর, হাতি, গন্ডার, বাঘ, চিতা, নকুল, লালপান্ডা ইত্যাদি। হিমালয়ের পক্ষিজগৎ খবুই সমৃদ্ধ। সর্পকুলের মধ্যে অজগর আর কেউটে উলেখযোগ্য। পর্বতের পশ্চিমাঞ্চলে সীমিত পরিমাণে আকরিক লৌহ, স্বর্ণ ও নীলকান্তমণি পাওয়া যায়। হিমালিয় নদীসমূহ থেকে পর্যাপ্ত জলবিদ্যুৎ উৎপাদন ও সেচ উন্নয়নের সম্ভাবনা প্রচুর। সিমলা, নৈনীতাল, মুসৌরী ও দার্জিলিংয়ের মনোরম আবহাওয়ার কারণে ভারতের সমভূমি অঞ্চলের তাপদগ্ধ মানুষদের কাছে এগুলো স্বাস্থ্যনিবাস হিসেবে খুবই জনপ্রিয়। সুন্দর পরিষ্কার শীতের সকালে বাংলদেশের রংপুর ও পঞ্চগড় জেলা থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার তুষারাবৃতি চূড়াগুলো চোখে পড়ে।
Post Views: 33