সিন্ধু সভ্যতা
হরপ্পা সভ্যতা হলো ভারতের প্রাচীনতম নগরকেন্দ্রিক সভ্যতা। আনুমানিক 5000 বছর আগে বিকশিত হওয়া এই সভ্যতার আনুমানিক 1500 খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ পতন ঘটে। হরপ্পা সভ্যতার পতনের পিছনে সঠিক কারণ কি ছিল তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মত পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। তবে খননকার্যের ফলে প্রাপ্ত বিভিন্ন ঐতিহাসিক তথ্য বিশ্লেষণ করে অনুমান করা হয় যে কোন একটি কারণে এই সভ্যতার পতন হয়নি। এই সভ্যতার পতনের পিছনে ছিল একাধিক কারণের সমাবেশ।
সেগুলি হল-
সিন্ধু সভ্যতার পতনের কারণ
১)নাগরিক জীবনের অবক্ষয় হরপ্পা সভ্যতার পতনের অন্যতম কারণ। আর এই অবক্ষয়ের সবচেয়ে বড় কারন হলো হরপ্পা সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য। হরপ্পা সভ্যতার নিচের স্তরগুলিতে যে উন্নত নাগরিক সভ্যতার ছাপ পাওয়া যায়, উপরের স্তরগুলিতে তার পরিবর্তে অবক্ষয়ের চিত্র পষ্ট ধরা পড়ে।উপরের স্তরগুলিতে দেখা যায় বৃহৎ অট্টালিকা সমূহের স্থান দখল করেছে পুরানো ইটের তৈরি ছোট ছোট বাড়ি, জল সরবরাহ ব্যবস্থা সংস্কারের অভাবে ভেঙে পড়েছে, রাস্তা দখল করে ইঁটের পাঁজা ও বাড়িঘর তৈরি হয়েছে এবং ব্যবসা বাণিজ্য ও কৃষিকাজের অবক্ষয় ঘটেছে। দীর্ঘদিন ধরে এই অবক্ষয় ঘটার কারণে হরপ্পা সভ্যতার পতন ঘটেছে।
২)অনেক ঐতিহাসিকের মতে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে বিশেষত ভূমিকম্পের কারণে হরপ্পা সভ্যতার পতন ঘটেছে। মহেঞ্জোদারো এলাকায় জলবিজ্ঞান বিষয়ে গবেষণার পর অনেকে বলেছেন যে অতীতে এই নগরের কাছে ভূমিকম্পের উৎসস্থল ছিল। ফলে ভূমিকম্পের কারণে এই নগরী ধ্বংস হয়েছিল বলে মনে করা হয়। মহেঞ্জোদারোয় প্রাপ্ত ক্ষতবিক্ষত নর কঙ্কাল দেখে মনে করা হয় যে ভূমিকম্পের কারণে ঘরবাড়ি ভেঙে পড়ায় তাদের শরীরে ক্ষতচিহ্নগুলি তৈরি হয়েছিল।
৩)অনেক ঐতিহাসিক হরপ্পা সভ্যতার পতনের জন্য জলবায়ুর পরিবর্তনকে দায়ী করেছেন। তাদের মতে নগর সভ্যতা সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে ইট পড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় কাঠের চাহিদা মেটাতে প্রচুর পরিমাণে গাছপালা কাটা হয়। এর ফলে সমগ্র অঞ্চলটি ধীরে ধীরে বৃক্ষহীন হয়ে পড়ে। ফলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে যায়, মরুভূমি প্রসার লাভ করে এবং অঞ্চলটি মনুষ্য বসবাসের অনুপযোগী হয়ে ওঠে।
৪)হরপ্পা সভ্যতার পতনের একটি সম্ভাব্য কারণ হল নদীর গতিপথ পরিবর্তন। সিন্ধু নদের গতিপথ পরিবর্তনের ফলে জলপথ পরিবহনের মাধ্যম হিসাবে মহেঞ্জোদারো তার গুরুত্ব হারায়, কৃষিতে জলের অভাব দেখা দেয় ও মানুষের দারিদ্র বৃদ্ধি পায়। শুধু সিন্ধুই নয়, শতদ্রু, যমুনা, সরস্বতী ইত্যাদি নদীগুলিও গতিপথ পরিবর্তন হরপ্পা সভ্যতার পতনকে অনিবার্য করে তোলে।
৫)অনেক ঐতিহাসিক বন্যাকে হরপ্পা সভ্যতার পতনের প্রধান কারণ হিসেবে দায়ী করেছেন। তাদের মতে পলি জমে সিন্ধুসহ অন্যান্য নদী গর্ভ ভরাট হয়ে গেলে প্রতিবছর বর্ষায় শহরগুলিতে বন্যা সৃষ্টি হয়। কৃষিকাজ ও জনজীবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এইভাবে বারবার বন্যার ফলে হরপ্পা সভ্যতার পতন ঘটে।
৬)কোন কোন ঐতিহাসিক হরপ্পা সভ্যতার পতনের কারণ হিসাবে খরাকে দায়ী করেছেন। ইট পোড়ানোর প্রয়োজনে অনিয়ন্ত্রিত ভাবে গাছপালা কাটার ফলে এই সভ্যতার বনভূমি ধ্বংস হয়ে যায়। এর ফলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ হ্রাস পায়। একসময় টানা দীর্ঘদিন অনাবৃষ্টির কারণে খরা সৃষ্টি হয়। ফলে কৃষি কাজ বন্ধ হয়ে যায়, খাদ্যশস্যের ঘাটতি দেখা দেয় এবং হরপ্পা সভ্যতার পতন ঘটে।
৭)হরপ্পা সভ্যতার অধিবাসীদের রক্ষণশীল চরিত্র এই সভ্যতার পতনকে ত্বরান্বিত করে। এই সভ্যতার অধিবাসীদের নতুন কোন কিছু শেখার প্রতি কোন আগ্রহ ছিল না। ফলে সময়ের সঙ্গে প্রতিযোগিতায়, কৃষি প্রযুক্তির উন্নতিতে ও ভারী অস্ত্রশস্ত্র নির্মাণে তারা পিছিয়ে পড়েছিল।
৮)অনেক ঐতিহাসিকের মতে হরপ্পা সভ্যতার পতন ঘটেছিল গৃহযদ্ধের মাধ্যমে রক্তপাতের মধ্য দিয়ে। মহেঞ্জোদারোয় প্রাপ্ত স্তূপীকৃত নর কঙ্কাল এবং একটি কুয়োর ধারে সিঁড়ির উপর পাওয়া নারী কঙ্কাল তাদের অস্বাভাবিক মৃত্যু তথা গৃহযুদ্ধের স্বাক্ষর বহন করে। অবশ্য অনেক ঐতিহাসিক এই গৃহযুদ্ধের তত্ত্ব অস্বীকার করেছেন।
৯)হরপ্পা সভ্যতার পতনের কারণ হিসাবে অনেক ঐতিহাসিক বৈদেশিক আক্রমণকে দায়ী করেন। তাদের মতে মহেঞ্জোদারোয় প্রাপ্ত স্তূপীকৃত নর কঙ্কাল এবং একটি কুয়োর ধারে সিঁড়ির উপর পাওয়া নারী কঙ্কাল তাদের অস্বাভাবিক মৃত্যুর স্বাক্ষর বহন করে। ঐতিহাসিক মার্টিমার হুইলার, গর্ডন চাইল্ড, স্টুয়ার্ড পিগট প্রমুখ ঐতিহাসিক এই অস্বাভাবিক মৃত্যুর কারণ হিসাবে বৈদেশিক আক্রমণের কথা বলেছেন এবং আক্রমণকারী হিসাবে আর্য জাতিকে চিহ্নিত করেছেন।
১০)পরিশেষে বলা যায় কোন একটি বৃহৎ সভ্যতার পতন কখনোই কোনো একটি কারণে আকস্মিকভাবে ঘটতে পারে না। হরপ্পা সভ্যতার পতনের ক্ষেত্রেও এই নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটেনি। ঠিক কি কারণে হরপ্পা সভ্যতার পতন ঘটেছিল সে বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া না গেলেও একথা অনুধাবনযোগ্য যে এই সভ্যতার বিভিন্ন কেন্দ্র বিভিন্ন কারণে ধ্বংস হয়েছিল। আর এই ধ্বংসের ক্ষেত্রে হরপ্পা সভ্যতার অধিবাসীদের রক্ষণশীল মানসিকতা ইন্ধন জুগিয়েছিল।