ভারতীয় সংবিধান
একটি রাষ্ট্রপরিচালনার জন্য সুনির্দিষ্ট কিছু নিয়ম কানুন আছে , এই নিয়মগুলিকে সাধারণত সংবিধান বলা হয় । ১৯৫০ সালের ২৬ শে জানুয়ারি ভারতের সংবিধান কার্যকর হয় । ভারতীয় সংবিধানকে “Bag of Borrowings” অ্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে কারন ভারতীয় সংবিধান বিভিন্ন দেশের সংবিধান থেকে কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য সংগ্রহ করে রচনা করা হয়েছিল ।
ভারতীয় সংবিধানের বৈশিষ্ট্য :
বিশ্বের সব দেশের সংবিধানেরই কিছু নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রয়েছে । এই বৈশিষ্ট্যগুলি অনুধাবন করলে প্রতিটি দেশের সংবিধানের পার্থক্য বোঝা যায়। ভারতের সংবিধানের প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি নীচে উল্লেখ করা হল –
(ক) পৃথিবীর সর্ববৃহৎ লিখিত সংবিধান :
ভারতীয় সংবিধানকে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ লিখিত সংবিধান বলে আখ্যা দেওয়া হয় । 1950 সালের 26 শে জানুয়ারি ভারতীয় সংবিধান কার্যকর হয় ।
সে সময়ে 395 টি ধারা এবং 8 টি তপশিল নিয়ে ভারতীয় সংবিধান রচিত হয়েছিল । বিভিন্ন সময়ে সংবিধান সংশোধনের পর বর্তমানে ভারতীয় সংবিধানের সর্বমোট ধারা প্রায় 450 এবং তফসিলের সংখ্যা 12 টি ।
(খ) যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা :
ভারতীয় সংবিধানে যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছে । ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রে কেন্দ্রীয় সরকার এবং রাজ্য সরকারের মধ্যে শাসন ক্ষমতা বন্টিত হয়েছে ।
(গ) সংবিধানের প্রাধান্য স্বীকৃত :
ভারতীয় সংবিধান হল দেশের সর্বোচ্চ আইন এবং সর্বপ্রকার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও নাগরিক অধিকারের উৎস ।
সংবিধান দেশের আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ, শাসন বিভাগ এবং সর্বপ্রকার সরকারি প্রতিষ্ঠানের উর্ধ্বে।
সংবিধান-বিরােধী কোনাে আইন প্রবর্তিত হলে সুপ্রিম কোর্ট তা বাতিল করে সংবিধানের পবিত্রতা ও প্রাধান্য রক্ষা করে।
(ঘ) সংবিধানের প্রস্তাবনা :
ভারতীয় সংবিধানের উল্লেখযােগ্য একটি বৈশিষ্ট্য হল সংবিধানের সঙ্গে প্রস্তাবনার সংযুক্তি।
প্রস্তাবনাকে সংবিধানের মুখবন্ধ বলা হয়। এতে সংবিধানের নৈতিক আদর্শ, দর্শন, মূল উদ্দেশ্য প্রভৃতি ব্যক্ত করা হয়েছে।
(ঙ) সংসদীয় শাসন ব্যবস্থা :
ইংল্যান্ডের অনুকরণে ভারতে সংসদীয় শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়েছে। এখানে তাই দুই ধরনের শাসক দেখা যায়।
নামসর্বস্ব শাসক (রাষ্ট্রপতি) এবং প্রকৃত শাসক (প্রধানমন্ত্রী)। আবার এখানে মন্ত্রিপরিষদ তার সমস্ত কাজের জন্য যৌথভাবে দায়িত্বশীল থাকে।
(চ) ধর্মনিরপেক্ষতা :
ধর্মনিরপেক্ষতা ভারতীয় সংবিধানের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য । ভারত ধর্মের ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ । এখানে কোনো বিশেষ ধর্মকে রাষ্ট্র প্রাধান্য দেয় না । প্রতিটি ধর্মকে সমানভাবে স্বীকার করা হয়।
(ছ) একনাগরিকত্ব :
ভারতীয় সংবিধানে ভারতীয়দের এক নাগরিকত্বের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে । এখানে প্রতিটি নাগরিক ভারতীয় নাগরিক হিসেবে এক নাগরিকত্বের অধিকার ভোগ করবে ।
(জ) মৌলিক অধিকার :
ভারতীয় সংবিধানের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হল সংবিধানে নাগরিকদের জন্য মৌলিক অধিকার । ভারতীয় সংবিধানে ১২-৩৫ ধারার মধ্যে ৬টি গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এগুলি হল
- (i) সাম্যের অধিকার,
- (ii) স্বাধীনতার অধিকার,
- (iii) শােষণের বিরুদ্ধে অধিকার,
- (iv) ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার,
- (v) সংস্কৃতি ও শিক্ষাবিষয়ক অধিকার এবং
- (vi) শাসনতান্ত্রিক প্রতিবিধানের অধিকার।
(ঝ) মৌলিক কর্তব্য :
ভারতের সংবিধানের 51 নং অনুচ্ছেদে নাগরিকদের মৌলিক কর্তব্য উল্লেখিত হয়েছে। যেমন- জাতীয় পতাকা ও সঙ্গীতের প্রতি শ্রদ্ধা , ভারতের সার্বভৌমিকতা রক্ষা , দেশের সম্পদ রক্ষা , হিংসার পথ ত্যাগ করা ইত্যাদি ।
(ঞ) সর্বজনীন ভােটাধিকার :
পৃথিবীর মধ্যে সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হল ভারতবর্ষ । তাই ভারতের সংবিধানে সর্বজনীন ভােটাধিকারের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।
জাতি-ধর্ম-বর্ণ-স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে ১৮ বছর বয়সি প্রতিটি ভারতীয় নাগরিকের ভােটদানের অধিকারকে ভারতীয় সংবিধানে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক অধিকাররূপে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে ।
(ট) নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থা :
ভারতীয় সংবিধানের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল স্বাধীন বিচার বিভাগের উপস্থিতি। স্বাধীন বিচার বিভাগ গড়ে তোলার জন্য সংবিধানে যেসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় লিপিবদ্ধ করা হয়েছে, সেগুলি হল –বিচার বিভাগের রায় নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলা যায় না , বিচারপতিদের গুরুতর কারণ ছাড়া পদচ্যুত করা যায় না ।
(ঠ) রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য নির্দেশমূলক নীতিসমূহ :
আয়ারল্যান্ডের সংবিধানের অনুকরণে রাষ্ট্র পরিচালনার নির্দেশমূলক নীতিগুলি ভারতীয় সংবিধানের চতুর্থ অধ্যায়ে ৩৬ থেকে ৫১ ধারার মধ্যে লিপিবদ্ধ হয়েছে।
এই নীতিগুলির মধ্যে উল্লেখযােগ্য হল কাজের অধিকার, বার্ধক্য ও বেকার অবস্থায় সরকারি সাহায্য পাওয়ার অধিকার, স্ত্রী-পুরুষ উভয়ের সমান কাজের জন্য সমান মজুরি পাওয়ার অধিকার, ১৪ বছর পর্যন্ত বালক বালিকাদের অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা প্রবর্তনের প্রয়াস গ্রহণ ইত্যাদি ।
(ড) সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্র :
সংবিধানের প্রস্তাবনায় ভারতকে একটি সার্বভৌম গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ সাধারণতন্ত্র বলে বর্ণনা করা হয়েছে। সংবিধানের প্রস্তাবনায় দুটি তাৎপর্যপূর্ণ শব্দ 1976 খ্রিস্টাব্দের 42 তম সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে সংযোজিত হয়। এই সংশোধন অনুসারে ভারতকে একটি সমাজতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার কথা ঘোষিত হয়েছে।