মহারাষ্ট্রের সেই রহস্যময় দৌলতাবাদ ফোর্ট

ভয়ঙ্কর দুর্গ

দৌলতাবাদ দুর্গ এক ভয়ঙ্কর দুর্গ। এই দুর্গ এমন এক ভুলভুলাইয়া যেখানে মানুষ একবার প্রবেশ করলে পথ হারিয়ে ফেলে। মহারাষ্ট্রের ঔরঙ্গাবাদের কাছে অবস্থিত এই বিখ্যাত দূর্গ। দৌলতাবাদ দুর্গ দেওগিরি এবং দেবগিরি নামেও পরিচিত। ঔরঙ্গাবাদ এর ১৪ কিলোমিটার দূরে রয়েছে দৌলতাবাদ। খ্রিস্টপূর্বাব্দের অনেক আগে থেকেই এই অঞ্চল ঋষি মুনিদের তপভূমি বলে পরিচিত ছিল। আর সেই কারণেই এই অঞ্চল কে দেবগিরি বলা হত। এরপরে আসে সম্রাট অশোকের রাজত্বকাল। সে সময় সর্বধর্ম সমন্বয়ে এই পর্বতমালা মুনি ঋষিদের মন্ত্র উচ্চারণে গমগম করত।

এই দুর্গটি অনেকটা ত্রিভুজাকৃতি দেখতে। উচু উঁচু দেওয়াল, বিশালাকার সিংহ দরজা, ভয়ংকর খাদ। হঠাৎ করে শত্রুপক্ষের আচমকা হামলা থেকে ধনসম্পদ এবং প্রজাদের বাঁচানোর জন্য এক সময় তৈরি হয়েছিল নিরাপত্তায় মোরা এই কেল্লা।কিন্তু সেই কেল্লা বর্তমানে নির্জন, শান্ত এক ভৌতিক কেল্লায় পরিণত হয়েছে। কেল্লাটির ভেতর এত নির্জন আর অন্ধকার যে সেখান দিয়ে যাওয়ার সময় আজও গা-ছমছম করে ওঠে। কেল্লার ভেতর যেতে যেতে এক জায়গায় দেখতে পাওয়া যায় একটা বিশাল ঘড়া। এক সময় নাকি সেই ঘড়ার মধ্যে ধন-সম্পদ গচ্ছিত রাখা হতো। আজ দুর্গের যে জায়গায় লোহার সেতু দেখা যায় সেখানে আগে লোহার সেতু ছিল না ছিল চামড়ার সেতু। যদি কখনো কোন শত্রুপক্ষ ওই চামড়ার সেতুতে উঠে পড়তো তাহলে অপর পাশ থেকে প্রহরীরা সেই সেতুর দড়ি কেটে দিত। আর শত্রুরা সোজা নিচে খাদের মধ্যে গিয়ে পড়তো। এরপরও যদি কোন শত্রু কোনোভাবে দুর্গের ভেতরে ঢুকে পড়তো তাহলে সঙ্গে সঙ্গে তার মাথা কেটে দেহটা ফেলে দেয়া হতো পাশের পরিখার মধ্যে। আর এই পরিখার মধ্যেই থাকতো কুমির। এই দুর্গের পদে পদে রয়েছে মরন কূপ।

দ্বিতীয় খ্রিস্টাব্দে যখন সাতবাহন সাম্রাজ্যের স্থাপন হয় তখন এই দেবগিরি তাদের সিংহ দরজায় পরিণত হয়। নবম শতাব্দী থেকে ১৪ শতাব্দী এখানে যাদবরা রাজত্ব করত। ১১৮৭ সালে যাদব সাম্রাজ্যের রাজকুমার পঞ্চম ভিল্লম দুর্গ নির্মাণ করেন এবং দেবগিরি কে নিজেদের রাজধানী বানিয়ে নেয়। তখন থেকে এখানকার যাদবরা দেবগিরি যাদব হিসেবে পরিচিতি লাভ করতে থাকেন। দেবগিরি পর্বতে এই রহস্যেময় দুর্গের নির্মাণ করেছিলেন রাজকুমার ভিল্লম। পাহাড়ের চারপাশে অভেদ্য খাদ। আর তারই মাঝে মাঝে কচ্ছপের আকারে তৈরি দুর্গ। আর এই পুরো দুর্গ টাই তৈরি হয়েছিল পাহাড় কেটে। পাহাড় কেটে ১৫০ ফুট উঁচু যে দেওয়াল তৈরি করা হয়েছিল সেটা এতটাই খাড়া আর মসৃণ করা হয়েছিল যে বাইরে থেকে আসা শত্রুপক্ষর কখনোই এই দেয়াল বেয়ে ওঠা সম্ভব ছিল না। এই দেওয়ালের মাঝেই রয়েছে ৭০ ফুট চওড়া এবং ৮০ ফুট গভীর একটি ভয়ংকর পরিখা। আর এখানে থাকতো ক্ষুদার্থ কুমিররা। শত্রুপক্ষরা যদি এই দুর্গে ঢোকার চেষ্টা করত তাহলে তাদের কুমিরের পেটে যেতে হতো। এছাড়াও এই দুর্গের দরজায় বড় বড় কাঁটাওয়ালা বর্ম দেখতে পাওয়া যায়। যদি শত্রুপক্ষ হাতি দিয়ে দরজা ভাঙ্গার চেষ্টা করত তাহলে হাতিগুলো আঘাতপ্রাপ্ত হতো। এত ঘেরাটোপ থাকা সত্ত্বেও দৌলতাবাদ দুর্গটি কয়েকবার হাত বদল হয়েছিল । ১৩০৮ খ্রিস্টাব্দে আলাউদ্দিন খিলজী এই দৌলতাবাদ ফোর্ট কে নিজের দখলে আনেন। আর এরপরে ১৩৮৭ খ্রিস্টাব্দে মোহাম্মদ বিন তুঘলক এই দুর্গের নাম দেবগিরির বদলে দৌলতাবাদ রেখেছিলেন। মোহাম্মদ বিন তুঘলক দিল্লি থেকে তার রাজধানীকে এই দৌলতাবাদে স্থানান্তরিত করেছিলেন। একসময় এই কেল্লা জয় করেছিলেন আওরঙ্গজেব।

ভারতবর্ষের প্রাচীন দুর্গ গুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে এই দৌলতাবাদ দুর্গ। ইট কাঠ বালি দিয়ে নয় পাহাড় কেটে তৈরি হয়েছিল এই দুর্গ। এই দুর্গটি যে পাহাড়ে করা হয়েছে সেই পাহাড়ের আশেপাশে আর কোন পাহাড় নেই। আর এই কেল্লার ওপর থেকে তাকালে অনেক দূর পর্যন্ত নজরে আসে। এই কারণে এই কেল্লার ওপর থেকে শত্রুদের গতিবিধি সহজেই লক্ষ্য করতে পারতো তৎকালীন শাসকরা। কেল্লার চারপাশে প্রায় ৮ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে রয়েছে সুবিশাল প্রাচীর। যে প্রাচীর টপকে শত্রুপক্ষের ভেতরে আসা ছিল অসম্ভব একটা ব্যাপার। যদিও কেউ যদি কোন ভাবে চলে আসতো তাহলে তাদের সামনে পড়তো সেই বিশাল পরীখা। যেটা সেই সময় কুমির এবং বিষাক্ত সাপে পরিপূর্ণ ছিল। সেই সময় দৌলতাবাদ দুর্গে বসবাস করত তাদের চলাচলের জন্য একটি মাত্রই রাস্তা ছিল। সেই রাস্তা সোজা চলে গিয়েছিল পরীখা অব্দি। এই দৌলতাবাদ দুর্গে প্রবেশের একমাত্র প্রবেশপথ টির নাম হচ্ছে মহাকোট। দৌলতাবাদ দুর্গ এক ভয়ঙ্কর দুর্গ।

দৌলতাবাদ দুর্গটি ঘিরে রয়েছে অনেকগুলো ভুতুড়ে গল্প । তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে রানী মহলের গল্প। কথিত আছে এখানে একজন রানী তার স্বামীর হাতে খুন হয়েছিলেন। আর তারপর থেকে নাকি সেই রানীর ভূত এই দুর্গের মধ্যে ঘুরে বেড়ায় এবং কাঁদে।অনেক পর্যটকই নাকি এখানে রানীর ভূত দেখেছেন। দুর্গের আরও একটি জনপ্রিয় ভুতুড়ে গল্প হচ্ছে চাঁদ মিনারের গল্প। জনশ্রুতি অনুযায়ী এই মিনারের নিচে কোন এক শ্রমিক চাপা পড়ে মারা গিয়েছিল। আর তারপর থেকে নাকি সেই শ্রমিকের ভূত এই অঞ্চলে তান্ডব চালায়। বহু পর্যটক জানিয়েছেন তারা নাকি এই মিনারের দেয়ালে কারোর কান্না ও আচরের আওয়াজ শুনেছেন। পূর্ণিমার রাতে দুর্গটি আরো ভুতুড়ে হয়ে ওঠে। চাঁদনী রাতে দুর্গের ভেতর থেকে নানা ধরনের চিৎকার নাকি ভেসে আসে আজও। এছাড়াও নাকি পর্যটকরা এই দুর্গের ভেতর পায়ের আওয়াজ, ফিসফিসানি, হাসির মতন অনেক অদ্ভুত আওয়াজ শুনতে পান। তবে দৌলতাবাদ দুর্গটি ঘিরে ভৌতিক অনুভূতি কতটা সেটার মাপকাঠি জানা না থাকলেও দুর্গটি ঘিরে আছে গা ছমছমে ভয়ঙ্কর অনুভূতি। আসলে এই দৌলতাবাদ দূর্গ হচ্ছে ইতিহাসের সব থেকে ভয়ংকর দুর্গ। এই দুর্গের ভেতরটা এতটাই অন্ধকার যে সেখানে পা ফেলতেও ভয় লাগে। আর তাই ভূতের ভয় না পেলেও দুর্গের ভয়ংকর রূপ দেখার জন্য একবার না একবার যেতেই হবে দৌলতাবাদ দূর্গে।