ভালো থেকোঃ মানসিক অবসাদের বিরুদ্ধে চলুক লড়াই
আজকের দ্রুতগতির জীবনে অবসাদ এক ভয়াবহ সমস্যা।প্রত্যেক ব্যক্তির জীবনে বিভিন্ন সময়ে বিরক্ত বা দুঃখী হতে পারেন। এটি সাধারণত বিশেষ কোনও কারণে হয়, দৈনন্দিন জীবনে খুব বেশি প্রভাব ফেলে না না এবং সাধারণত এক বা দুই সপ্তাহের বেশি স্থায়ী হয় না। এমন ক্ষেত্রে বিশেষ দুশ্চিন্তার কারন নেই, কারন এই সাময়িক অবসাদ দ্রুতই কেটে যায়।
তবে এই অনুভূতিগুলো যদি দীর্ঘস্থায়ী হয়, অর্থাৎ কয়েক সপ্তাহ বা মাস ধরে চলে, অথবা এমন খারাপ পর্যায়ে যায় যে আপনার জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রেই প্রভাব ফেলছে, তাহলে আপনার মধ্যে সম্ভবত ডিপ্রেশন বা মানসিক অবসাদ তৈরি হয়েছে,সেক্ষেত্রে আপনার সতর্ক হওয়া দরকার।
মানুষের মানসিক অবসাদ বিভিন্ন মাত্রার হতে পারে; আবার সেই অভিজ্ঞতা তাদের সাংস্কৃতিক পটভূমি বা/এবং তাদের ব্যক্তিগত মূল্যবোধ, বিশ্বাস ও ভাষা দ্বারাও প্রভাবিত হয়।
মানসিক অবসাদের লক্ষণঃ
মানসিক লক্ষণঃ
- অসুখী, হতভাগা, নিরাশ, অবসাদের দীর্ঘস্থায়ী অনুভূতি, যা কোন বিশেষ সময়ে আরও তীব্র হতে পারে।
- কোন কিছু উপভোগ করতে না পারা।
- মানুষের সাথে মেশার আগ্রহ কমে যাওয়া।
- মনোনিবেশ করা এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা হ্রাস।
- আত্মবিশ্বাসের অভাব।
- নিজেকে দায়ী করার প্রবনতা বৃদ্ধি।
- নৈরাশ্যবাদ।
- চূড়ান্ত পর্বে আত্মহননের ভাবনা।
শারীরিক লক্ষণঃ
- অস্থিরতা, উদ্বেগ অনুভব
- ক্লান্তি অনুভব
- নিদ্রাহীনতা
- মাথা ব্যথা বা পেটের সমস্যা
- যৌনতার প্রতি আগ্রহ হ্রাস
পরিচিতরাও এই সমস্ত ক্ষেত্রে অবসাদ্গ্রস্থ মানুষের কিছু লক্ষণ অবশ্যই অনুভব করবেন।
যেমন আপনি দেখলেন আপনার বন্ধু কিছুদিন ধরে-
- কাজে ভুল করছেন বা মনোনিবেশ করতে পারছেন না
- অস্বাভাবিকভাবে শান্ত এবং অনাগ্রহী, অথবা লোকেদের এড়িয়ে চলছেন
- স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন
- স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি খিটখিটে
- স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বা কম ঘুমাচ্ছেন
- অস্পষ্ট শারীরিক সমস্যা সম্পর্কে অভিযোগ করছেন
- সঠিকভাবে নিজের যত্ন নিচ্ছেন না
- নিজের বা নিজের চারপাশে পরিচ্ছন্নতা সম্পরকে উদাসীন
আধিকাংশ ক্ষেত্রে নিজের বা নিজের পাশের মানুষটির মধ্যে এই ধরনের পরিবর্তনগুলো অত্যন্ত ধীরে ধীরে আসে; ফলে এমনকি নিজেও আমরা সমস্যাটা চিহ্নিত করতে পারিনা। অনেক সময় হয়তো বন্ধু বা পরিচিতরাই এই সমস্যাগুলো আগে চিহ্নিত করতে পারেন। আবার অনুভব করার পরেও আলস্য বা ইচ্ছাশক্তির অভাবে রোগী ( অর্থাৎ অবসাদ্গ্রস্থ ব্যক্তি) সমস্যার সমাধান করতে পারেন না। তাই এই ধরনের সমস্যার ক্ষেত্রে একজন নির্ভরযোগ্য বন্ধু আশীর্বাদ স্বরূপ, যিনি অবসাদ্গ্রস্থ মানুষটিকে সমস্যার স্বরূপ বোঝাতে এবং প্রয়োজনে পরামর্শ দিতে পারবেন।
আপনার যে কিছু সমস্যা আছে তা আপনাকে বিশ্বাস করাতে এবং সাহায্য চাওয়ার ব্যাপারে আপনাকে পরামর্শ দিতে অনেকসময় একজন বন্ধু বা সঙ্গীর প্রয়োজন হয়।
অনেকের ধারণা যে মানসিক অবসাদ দুর্বল ব্যক্তিত্বের বহিঃপ্রকাশ। একেবারেই তা নয়। সবচেয়ে দৃঢ়চেতা ব্যক্তিরা, এক জন সফল ক্রীড়াবিদ বা রাষ্ট্রনায়ক, বিভিন্ন তারকারাও মানসিক অবসাদে ভুগতে পারেন।
কখনও কখনও মানসিকভাবে অবসাদগ্রস্ত হওয়ার একটি স্পষ্ট ও নির্দিষ্ট কারণ পর্যন্ত না-ও থাকতে পারে। হতাশা, ভয়, বা আপনার প্রিয় কোনও বস্তু বা ব্যক্তিকে হারানোর কারণে, এমনকি কোন আপাততুচ্ছ কারনেও এটা হতে পারে। প্রিয় জনকে হারানোর বেদনা, কোন রকম মানসিক অভাদবোধ, সৃজনশীল মানুষদের ক্ষেত্রে বা বিভিন্ন প্রফেশনালদের ক্ষেত্রে কাজের জগতের চাপ বা আপন প্রত্যাশা অনুযায়ী সাফল্যের অভাবও অবসাদ তৈরি করতে পারে৷ এমনকি নিজের বা প্রিয়জনের যন্ত্রণাও অনেকের মানসিক অবসাদের কারণ হয়। সামাজিক বা বৌদ্ধিক একাকীত্বও মানুষকে কখনও কখনও অবসাদগ্রস্থ করে। শৈশবের অভিজ্ঞতা, বিকৃত চেতনা, মাদকাসক্তি, যৌন পছন্দ, সামাজিক আকাঙ্ক্ষা এমনকি হরমোনাল ডিসঅর্ডারও মানসিক অবসাদের কারণ হতে পারে।
মানসিক অবসাদ থেকে মুক্তির উপায়ঃ
সুখবর হলো, মানসিক অবসাদে ভোগা বেশিরভাগ মানুষই নিজেদের জন্য কিছুটা সময় বার করতে পারলে এবং নিজের পছন্দ মতো কাজ করার সুযোগ পেলে নিজ থেকে সুস্থ হয়ে উঠতে পারেন। এবং আপনি যখন তা পারবেন, তখন তা আপনাকে মানসিকভাবে আরও অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী করে তুলবে। তাই এই ধরনের কোন সমস্যা আনুভব করলে আপনার যদি মনে হয় যে কারও সাথে কথা বলা উচিত, নিজেকে আটকে রাখবেন না, কারণ এটাই আপনাকে দ্রুত স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে সাহায্য করবে।এমনকি যদি অন্যদের আপনার অনুভূতি বোঝাতে বেগ পেতে হয় তাহলেও হাল ছাড়বেন না এবং নিরাশ হবেন না।
যদি কোন শারীরিক সমস্যা না থাকে তাহলে নিয়মিত ব্যায়াম করুন, যোগাভ্যাস করুন, খোলা হাওয়ায় কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করুন।এ সময় ক্ষুধাহীনতা দেখা দিতে পারে। তবে মনে রাখবেন যে সুষম খাদ্যাভাস, বেশি বেশি ফল ও সবজি খাওয়া আপনার শরীর ও মনকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করবে।
এসময় মাদকাসক্তি একটা অত্যন্ত সাধারন ও বিপজ্জনক প্রবনতা। মনে রাখবেন, মাদক সাময়িকভাবে আপনার মনকে অবসাদ্মুক্ত করলেও দীর্ঘ মেয়াদে আপনাকে আরও বেশি মানসিক অবসাদগ্রস্ত করে ফেলবে।
অনিদ্রাও এই সময়ের একটা স্বাভাবিক প্রবনণতা। এর হাত থেকে রক্ষা পেতে প্রতি রাতে নির্দিষ্ট সময়ে শুয়ে পড়ুন। শোওয়ার আগে আপনার পছন্দ মতো বই পড়ুন বা গান শুনুন। সঙ্গীতের কিন্তু আশ্চর্য মানসিক শান্তি দেওয়ার ক্ষমতা আছে ।
এই সময় দুশ্চিন্তা দূর করতে প্রশান্তিদায়ক কিছু করুন যেমন যোগ ব্যায়াম, ম্যাসাজ, অ্যারোমাথেরাপি কিংবা এমন কোনও কাজ যা আপনাকে প্রশান্তি এনে দেয়।
আপনার শখগুলির পরিচর্যা করুন। নিজেকে আবিষ্কার করার মধ্যে দিয়েই আপনার সমস্যার সমাধান সম্ভব।
প্রয়োজনে নিজেকে দৈনন্দিন রুটিনের বাইরে নিয়ে যান। পছন্দের মানুষের সাথে ঘুরতে যাওয়া বা নিজের সাথে সময় কাটানো — দুটোই কিন্তু চমৎকার বিকল্প।
মনে রাখবেন, অন্য অনেক মানুষও মানসিক অবসাদগ্রস্ত ছিলেন এবং তারা সুস্থ হয়েছেন। এমনকি তারা অনেকেই আপনার থেকে অনেক বেশি অসুবিধেজনক অবস্থায় ছিলেন; সুতরাং তারা যখন সংকট কাটিয়ে উঠতে পেরেছেন তখন আপনিও তা পারবেন।
উপরে বলা যে কোন সমস্যা আমাদের পরিচিত মানুষদের সাথে ঘটতে পারে। সেক্ষেত্রে আমাদের কিন্তু তাদের পাশে দাঁড়াতেই হবে। আর যদি বঝেন সমস্যা আরেক্তু জটিল তাহলেও ঘাবড়াবার কিচ্ছু নেই। একজন পেশাদার মনস্তত্ব চিকিৎসক আপনাকে সাহায্য করবার জন্য সর্বদা প্রস্তুত। এমনকি তিনি হয়তো নিছক কথা বলেই অবসাদ্গ্রস্থ একজন মানুষের সমস্যা দূর করতে পারবেন। দয়া করে এটাও মনে রাখুন অন্য যে কোন রগের মতই এই রগের চিকিৎসাও যত দ্রুত সম্ভব শুরু করাই ভাল। সুতরাং আর অবসাদের অন্ধকারে একা গুমরানোর প্রয়োজন নেই; আমরা সবাই সবার পাশে থেকে , হাতে হাত রেখে অবসন্নতা কাটিয়ে উঠবো, উঠবোই। কারণ “Life is BEAUTIFUL”.