ভারতের ইতিহাস

গুপ্ত সাম্রাজ্য

মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের পর উত্তর ভারতে কুষাণরা ও দাক্ষিণাত্যে সাতবাহন রাজারা কিছুটা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি স্থাপনে সক্ষম হয়েছিল । কিন্তু খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতকের মধ্যভাগে উভয় সাম্রাজ্যের পতন হয় । উত্তর-পশ্চিম ভারতে বৈদেশিক আক্রমণ স্থিতিশীলতার পরিপন্থী ছিল । গুপ্ত সাম্রাজ্যের অভ্যুত্থানের ফলে এই রাজনৈতিক শূন্যতার অবসান হয় । কুষাণ ও সাতবাহন উভয় সাম্রাজ্যের বেশ কিছু অংশ গুপ্ত সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত হলেও আয়তনের দিক থেকে গুপ্ত সাম্রাজ্য মৌর্য সাম্রাজের তুলনায় ছোটো ছিল । গুপ্ত সাম্রাজ্য প্রধানত বিহার ও উত্তর প্রদেশেই সীমাবদ্ধ ছিল । বিহার অপেক্ষা উত্তর প্রদেশই ছিল এই সভ্যতার প্রাণকেন্দ্র এবং গোড়ার দিকে মুদ্রা ও শিলালিপি প্রধানত এখান থেকেই পাওয়া গেছে । গুপ্ত রাজারা সম্ভবত বৈশ্য সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন এবং কুষাণ রাজাদের সামন্ত হিসাবে উত্তর প্রদেশে শাসন করতেন । গুপ্ত সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন শ্রীগুপ্ত । তিনি ২৭৫ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে আরোহণ করেন ।

প্রথম চন্দ্রগুপ্ত (Chandragupta – I) : গুপ্ত সাম্রাজ্যের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন প্রথম চন্দ্রগুপ্ত । ৩১৯/২০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৩৩৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তাঁর রাজত্বকাল ছিল । তিনি লিচ্ছবি রাজকন্যা কুমারদেবীকে বিবাহ করে গাঙ্গেয় উপত্যকায় নিজ প্রাধান্য স্থাপন করেন । তাঁর রাজ্য উত্তর প্রদেশের পূর্বাংশ, বিহার, এমনকি বাংলা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল । মৃত্যুর পূর্বে তিনি পুত্র সমুদ্রগুপ্তকে নিজ উত্তরাধিকারী বলে ঘোষণা করে যান ।

সমুদ্রগুপ্ত (Samudragupta) : গুপ্ত রাজাদের মধ্যে সমুদ্রগুপ্ত ছিলেন শ্রেষ্ঠ । ৩৩৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৩৮০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সমুদ্রগুপ্ত রাজত্ব করেন । শৌর্য-বীর্য, চারিত্রিক দৃঢ়তা ও সংস্কৃতির প্রতি পৃষ্ঠপোষকতার জন্য তিনি ভারত ইতিহাসে একটি অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছেন । তাঁর সিংহাসন আরোহণের সঠিক সময় বলা কঠিন । সম্ভবত তিনি ৩২০ খ্রিস্টাব্দের পর সম্রাট পদে অভিষিক্ত হন । ড. রোমিলা থাপারের মতে, তনি ৩৩৫ সাল নাগাদ পিতৃ সিংহাসন লাভ করেন ।

(১) সমুদ্রগুপ্তের রাজ্যজয় ও সাম্রাজ্য সীমা (Samudragupta as a Conqueror) : সিংহাসনে বসার পরই সমুদ্রগুপ্ত রাজ্যবিস্তারে মনযোগ দেন । অশোকের শান্তি ও অহিংসা নীতি বর্জন করে তিনি সামরিক শক্তির সাহায্যে এক সাম্রাজ্যবাদী নীতি অনুসরণ করেন । সভাকবি হরিষেণের এলাহাবাদ প্রশস্তি থেকে তাঁর বিজয় কাহিনি জানতে পারা যায় । এই লিপিতে অনেক পরাজিত রাজার নামের উল্লেখ আছে । সমুদ্রগুপ্ত যে সব রাজ্য  জয় করেছিলেন, তাদের মোটামুটি পাঁচভাগে ভাগ করা যেতে পারে ।

(ক) প্রথম ভাগে রয়েছে গঙ্গা-যমুনার মধ্যবর্তী এলাকার রাজ্যগুলি । এই অঞ্চলের রাজাদের পরাজিত করে সমুদ্রগুপ্ত তাঁদের রাজ্য সরাসরি গুপ্ত সাম্রাজ্যে অন্তর্ভুক্ত করেন ।

(খ) দ্বিতীয় ভাগে পড়ে পূর্ব হিমালয়স্থিত রাজ্যগুলি এবং নেপাল, বঙ্গ, আসাম প্রভৃতি সীমান্তবর্তী অঞ্চলের রাজ্যসমূহ । এখানকার রাজারা সমুদ্রগুপ্তের বাহুবলের পরিচয় পেয়েছিলেন । পাঞ্জাবের কয়েকটি প্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্রকেও এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা যায় ।

(গ) তৃতীয় ভাগে রয়েছে বিন্ধ্য অঞ্চলের অটবিক রাজ্যগুলি ।

(ঘ) চতুর্থ ভাগে উল্লেখিত হয়েছে দক্ষিণ-ভারতে পরাজিত ১২ জন রাজার নাম ।

(ঙ) সবশেষে পঞ্চম ভাগে শক ও কুষাণ রাজাদের নামের তালিকা ।

(ক) উত্তর ভারতে সমুদ্রগুপ্ত যেসব রাজাকে পরাজিত করেন, তাঁদের মধ্যে অহিচ্ছত্ররাজ অচ্যুত (বেরিলী), মতিল (উত্তরপ্রদেশের পশ্চিমাঞ্চল),  বলবর্মন (অনেকের মতে কামরূপ রাজ), চন্দ্রবর্মণ (বাঁকুড়া জেলার গোলকর্ণ) ও রুদ্রদেবের (বুন্দেলখন্ড) নাম উল্লেখযোগ্য ।

(খ) দক্ষিণ ভারতে যে ১২ জন পরাজিত রাজার নাম পাওয়া গেছে, তাঁরা হলেন (i) কোশলরাজ মহেন্দ্র (মহানদী উপত্যকা), (ii) মহাকান্তারের ব্যাঘ্ররাজ, (iii) কুরলের মন্তরাজ, (iv) পিষ্ঠপুর বা পিঠাপুরমের (গোদাবরী জেলা) মহেন্দ্রগিরি, (v) কোট্টুরের (উত্তর তামিলনাড়ু) স্বামীদত্ত, (vi) এরন্ডপল্লের (উত্তর তামিলনাড়ু) দমন, (vii) কাঞ্চীর পল্লবরাজ বিষ্ণুগোপ,  (viii) অবমুক্তর নীলরাজ (কাশ্মীর নিকটবর্তী অঞ্চল), (ix) বেঙ্গীর (কৃষ্ণা ও গোদাবরীর মধ্যাঞ্চল) হস্তিবর্মণ, (x) পালক্করাজ (নেলোর) উগ্রসেন, (xi) দেবরাষ্ট্রের (ভিজাগাপত্তম) কুবের ও (xii) কুন্তলপুরের (উত্তর আর্কট) ধনঞ্জয় । এই রাজাদের পরাজিত করে সমুদ্রগুপ্ত তাঁদের রাজ্য ফিরিয়ে দেন । তাঁদের মৌখিক অনুগত্য ও করদানের সম্মতির বেশি অতিরিক্ত কিছু দাবি করেন নি । তিনি বুঝতে পেরেছিলেন উত্তর ভারত থেকে সুদূর দক্ষিণ ভারত শাসন করা সম্ভব নয় ।

সভাকবি হরিষেণ এলাহাবাদ প্রশস্তি রচনা করেন, সেজন্য এর মধ্যে কিছু অতিশয়োক্তি থাকতে পারে বলে অনেকে মনে করেন । পশ্চিম ভারতে তিনি শকদের ক্ষমতা বিনষ্ট করতে পারেন নি বলে মনে হয় । কুষাণ রাজাদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কও সঠিকভাবে জানা যায় না । চৈনিক সূত্রে জানা যায় সিংহলের রাজা মেঘবর্ণ বা মেঘবর্মণ তাঁর কাছে উপহার পাঠান এবং গয়াতে একটি বৌদ্ধমঠ নির্মাণের অনুমতি চান । অনেকে মনে করেন, যে দ্বীপের কথা চৈনিক সূত্রে বলা হয়েছে, তা আদৌ সিংহল নয় । এই সব সূত্রে কিছু অতিশয়োক্তি থাকলেও সমুদ্রগুপ্ত তাঁর দীর্ঘ ৪০ বছরের রাজত্বকালে অনেকগুলি বিজয় অভিযানে অংশ নিয়ে এক বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন । তাঁর সাম্রাজ্য উত্তরে হিমালয়ের পাদদেশ থেকে দক্ষিণে নর্মদা তীর পর্যন্ত ও পূর্বে ব্রহ্মপুত্র নদী থেকে পশ্চিমে চম্বল ও যমুনা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল । অন্যান্য অঞ্চলের রাজারা তাঁর অধীন না হলেও কর দিতেন । তাঁর বিজয় নীতির ফলে গঙ্গা-যমুনা দোয়াব, রহিলখন্ড, পূর্ব মালবের কিছু অংশও তাঁর সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল । তা ছাড়া সমতট (পূর্ববঙ্গ), দাবাক (সম্ভবত আসামের নওগাঁও), কামরূপ, নেপাল, যৌধেয়, মদ্রক, আভীর প্রভৃতি উপজাতিও তাঁর বশ্যতা স্বীকার করেছিলেন ।

(২) সমুদ্রগুপ্তের কৃতিত্ব (Achievement of Samudragupta) : সমুদ্রগুপ্ত তাঁর সামরিক অভিযানে সাফল্য লাভের কারণে ভারতের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় স্থান দখল করে আছেন ।

(ক) তাঁর অসাধারণ প্রতিভার জন্যই তিনি গাঙ্গেও উপত্যকার একটি ক্ষুদ্র রাজ্য থেকে বিশাল সাম্রাজ্য স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিলেন । আর্যাবর্ত থেকে সুদূর দাক্ষিণাত্য পর্যন্ত সফল সামরিক অভিযান তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষর বহন করে । বিভিন্ন রাজাকে পরাজিত করে তিনি অশ্বমেধ যজ্ঞ করেন । ঐতিহাসিক ভি. স্মিথ তাঁকে ভারতের নেপোলিয়ান আখ্যা দিয়েছেন ।

(খ) তিনি কেবল সুদক্ষ যোদ্ধাই ছিলেন না, তিনি সাহিত্যিক, শাস্ত্রজ্ঞ, সংগীতজ্ঞ ও শিল্প-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক হিসেবেও চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন । সংস্কৃত পন্ডিত হরিষেণ ও বৌদ্ধ পন্ডিত বসুবন্ধু তাঁর পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিলেন । ড. রমেশ চন্দ্র মজুমদারের মতে, সমুদ্রগুপ্তের অনন্যসাধারণ ব্যক্তিত্ব ও প্রতিভা ভারতের ইতিহাসে এক নব যুগের সূচনা করেছিল ।

দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত (Chandragupta II Vikramaditya) : সমুদ্রগুপ্তের পুত্র দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের রাজত্বকাল গুপ্তযুগের ইতিহাসে এক গৌরবময় অধ্যায় । তাঁর রাজত্বকাল ৩৮০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৪১৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ছিল । “দেবীচন্দ্রগুপ্তম্‌” নাটক থেকে জানা যায় সমুদ্রগুপ্তের মৃত্যুর পর তাঁর বড় ছেলে রামগুপ্ত সিংহাসনে বসেন । তিনি একজন শক রাজার হাতে পরাজিত হয়ে নিজ স্ত্রী ধ্রুবদেবীকে তাঁর হাতে সমর্পণ করেন । তখন দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত সেই রাজাকে হত্যা করে রানির মর্যাদা রক্ষা করেন । পরে রামগুপ্তকে হত্যা করে ও ধ্রুবদেবীকে বিবাহ করে সিংহাসন দখল করেন । অনেকে এই কাহিনি সত্য বলে মনে করেন ।

(১) রাজ্যজয় নীতি : দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত পিতার দিগ্বিজয়ী নীতি অনুসরণ করেন । তিনি কেবলমাত্র বাহুবলের দ্বারাই রাজ্য জয় করেন নি ।  তিনি ইউরোপের হ্যাপস্‌বার্গ ও বুঁরবো রাজাদের মতো বৈবাহিক সম্বন্ধ স্থাপন করেও রাজ্য বিস্তার করেন । তাঁর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব হল শকদের যুদ্ধে পরাজিত করা । যুদ্ধ জয়ের স্মৃতিতে তিনি এক রৌপমুদ্রা প্রচলন করেন । শকদের পরাজয়ের ফলে ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত সুরক্ষিত হয় । তাছাড়া এর ফলে ভূমধ্যসাগর অঞ্চলে ভারতীয় বণিকদের প্রসার ঘটে । তিনি বাকাটক রাজ দ্বিতীয় রুদ্রসেনের সঙ্গে নিজ কন্যা প্রভাবতীর বিবাহ দিয়ে দাক্ষিণাত্যের পশ্চিম অঞ্চলে নিজ প্রাধান্য স্থাপন করেন । বিবাহের পাঁচ বছর পর রুদ্রসেনের মৃত্যু হলে প্রভাবতী নিজ পুত্রের অবিভাবক রূপে রাজত্ব করেন । ফলে বাকাটক রাজ্য কার্যত গুপ্ত সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয় ।

(২) বিক্রমাদিত্য বতর্ক : চন্দ্রগুপ্ত বিভিন্ন মুদ্রায় বিক্রমাদিত্য উপাধি ব্যবহার করেছেন । শকদের পরাজিত করে তিনি “শকারি” উপাধি গ্রহণ করেছিলেন । তাই অনেকের মতে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত হচ্ছেন বিক্রমাদিত্য শকারি, যাঁর রাজসভা কালিদাস ও বরাহমিহিরসহ নয়জন রত্ন অলঙ্কৃত করতেন । অবশ্য নবরত্নের সবাই তাঁর সমসাময়িক ছিলেন কিনা, এবং বিক্রমাদিত্য ও চন্দ্রগুপ্ত একই ব্যক্তি ছিলেন কি না তা সুনিশ্চিতভাবে বলা কঠিন । চন্দ্রগুপ্তের রাজত্বকালেই বিখ্যাত চৈনিক পর্যটক ফা-হিয়েন ভারতে আসেন । তাঁর রাজত্বকাল সংস্কৃতির ক্ষেত্রে চরম উৎকর্ষতার জন্য ভারতের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে ।

(৩) মূল্যায়ন (Evaluation) : সমুদ্রগুপ্তের পাশে চন্দ্রগুপ্তকে অনেকাংশে ম্লান বলে মনে হতে পারে । সমুদ্রগুপ্তের মতো চমকপ্রদ সামরিক প্রতিভা তার অবশ্যই ছিল না । নতুন করে রাজ্য জয় করার খুব একটা প্রয়োজন হয় নি । কিন্তু শকদের পরাজিত করে এবং পশ্চিম মালব ও গুজরাট জয় করে তিনি তাঁর সামরিক প্রতিভার পরিচয় দিয়েছিলেন । উজ্জয়িনী ছিল মালবের রাজধানী । সমুদ্রগুপ্তের রাজ্যজয় নীতি সামরিক শক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল । কিন্তু দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত সামরিক শক্তির সঙ্গে বৈবাহিক সম্বন্ধ নীতি গ্রহণ করেছিলেন । তিনি তাঁর পিতার রাজ্যজয় নীতির সম্পূর্ণতা দিতে পারেন নি । উত্তরাধিকার সূত্রে যে সাম্রাজ্য পেয়েছিলেন, মোটের উপর তা নিয়েই সন্তুষ্ট ছিলেন । কিন্তু সেই সাম্রাজ্য যাতে সুশাসিত হয়, সে দিকে তাঁর নজর ছিল । সাহিত্য ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক হিসাবে তাঁর পিতার চেয়ে কোনো অংশে কম ছিলেন না; বরং অনেকটাই এগিয়ে ছিলেন । তবে রোমিলা থাপারের মতে, গুপ্ত সভ্যতা ও সংস্কৃতির উৎকর্ষতা ও সুফল কেবল মাত্র সমাজের উঁচু তলার মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল ।

পরবর্তী গুপ্তরাজন্যবর্গ :

(১) দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের পর তাঁর পুত্র কুমারগুপ্ত (Kumaragupta I) ৪১৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৪৫৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মগধের সিংহাসনে আরোহণ করেন । তিনি গুপ্ত সাম্রাজ্যের সীমানা অক্ষুন্ন রাখেন । নতুন করে কোনো রাজ্য জয় না করলেও তিনি অশ্বমেধের যজ্ঞ করেছিলেন । তাঁর সময়ে উত্তর-পশ্চিম ভারতে হুন আক্রমণ হয় । যুবরাজ স্কন্দগুপ্ত হূনদের পরাজিত করে আসন্ন বিপদ থেকে ভারতকে রক্ষা করেন ।

(২) গুপ্তযুগের শেষ শক্তিশালী সম্রাট ছিলেন স্কন্দগুপ্ত (Skandagupta) । তিনি ৪৫৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৪৬৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন । হুন আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য তিনি বিক্রমাদিত্য উপাধি গ্রহণ করেছিলেন । হুন আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য রমেশচন্দ্র মজুমদার তাঁকে “ভারতের রক্ষাকারী” বলে অভিহিত করেছেন । তিনি সুশাসক ও প্রজাবৎসল নৃপতি ছিলেন । জুনাগড় লিপি থেকে জানা যায় তিনি সৌরাষ্ট্রের সুদর্শন হ্রদ সংস্কার করেন । তাঁর মৃত্যুর পর গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতন শুরু হয় ।

গুপ্তসাম্রাজ্যের পতনের কারণ (Cause of Decline of Gupta Dynasty) :

(১) অন্যান্য স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের মতো গুপ্ত শাসনের স্থায়িত্ব নির্ভরশীল ছিল সম্রাটের সামরিক ও প্রশাসনিক দক্ষতার উপর । কিন্তু স্কন্দগুপ্তের পরবর্তী গুপ্তরাজাদের সেই যোগ্যতা না থাকায় পতন শুরু হয় ।

(২) পরবর্তীকালে সিংহাসনকে কেন্দ্র করে উত্তরাধিকারীদের মধ্যে যে কলহ ও বিরোধ দেখা দেয়, তা গুপ্ত সাম্রাজ্যের ভিত দুর্বল করে দিয়েছিল ।

(৩) প্রাদেশিক শাসক ও সামন্ত প্রভুরা এই দুর্বলতার সুযোগ গ্রহণ করেন । ফলে বিচ্ছিন্নতাকামী প্রবণতা শক্তি সঞ্চয় হতে থাকে । কাথিয়াবাড়ের শাসনকর্তা বুধগুপ্ত মহারাজ উপাধি ধারণ করে স্বাধীনভাবে রাজত্ব করতে শুরু করেন । দক্ষিণ কোশল ও নর্মদা অঞ্চলের রাজারা নামে মাত্র গুপ্ত সম্রাটের অধীনে ছিলেন । বাংলাও স্বাধীন হয়ে যায় । পরবর্তী গুপ্ত সম্রাটরা সামরিক শক্তিকে অবহেলা করে বৌদ্ধধর্মের প্রভাবে অহিংস নীতি গ্রহণ করেন । ফলে হূনরা যখন আক্রমণ করে, তখন সেই আক্রমণ প্রতিহত করার মত ক্ষমতা আর তাদের ছিল না ।

(৪) অর্থনৈতিক সংকট গুপ্ত সাম্রাজ্যের ভিত্তিকে দুর্বল করে দেয় । নানা কারণে গুপ্তযুগে ভারতের বহির্বাণিজ্য উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায় । ফলে বিদেশ থেকে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ ভারতের অর্থনীতিকে একদা শক্তিশালী করত, তার ঘাটতি দেখা দেয় । রাজস্বের পরিমাণ কমে যায় । মুদ্রা ব্যবস্থায় ক্রমাবনতি দেখা দেয় । অর্থনৈতিক বিপর্যয় গুপ্ত সাম্রাজ্যের প্রাণশক্তি নিঃশেষ করে দেয় ।

(৫) এই পরিস্থিতিতে বৈদেশিক আক্রমণ গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনকে ত্বরান্বিত করে ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *