ভারতের ইতিহাস বাংলায় জৈন ও বৌদ্ধ ধর্ম: উত্থান ও অবলুপ্তি

বাংলায় জৈন ও বৌদ্ধ ধর্ম

বাংলার বিভিন্ন জেলায় জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মের উদ্ভব খ্রীস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে ঘটেছিল বলে ঐতিহাসিকরা অনুমান করে থাকেন। জৈন ধর্মের চতুর্বিংশ তীর্থঙ্কর ‘মহাবীর’, বৌদ্ধধর্মের প্রবর্তক ‘গৌতমবুদ্ধের’ পূর্ববর্তী ছিলেন। তাঁর সেই পূর্ববর্তিত্ব ন্যূনতম পাঁচশো বছর হওয়ায়, বাঁকুড়া জেলায় জৈনধর্মের উদ্ভবকালও বৌদ্ধধর্মের তুলনায় প্রাচীনতর বলে অনুমান করা হয়। জৈন ধর্মগ্রন্থ ‘আচারাঙ্গসূত্রে’ মহাবীরের রাঢ় দেশ ভ্রমণের বিবরণ সংক্ষেপে লিপিবদ্ধ থাকার জন্য জৈনধর্মের অস্তিত্বের পূর্ববর্তিত্বের বিষয়টি প্রমাণিত হয়। মহাবীর ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যে রাঢ় পরিভ্রমণ করেছিলেন। রাঢ়ের দক্ষিণাংশে অবস্থিত বর্তমান বাঁকুড়া জেলার ভৌগোলিক পরিসীমায় তিনি ‘পরিব্রজন’ করেছিলেন কিনা – সে বিষয়ে সংশয় উত্থাপন করা গেলেও, তাঁরই অনুপ্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে জৈন ভিক্ষুগণ যে দক্ষিণ-পশ্চিম রাঢ়েও প্রবেশ তথা অবস্থান করেছিলেন – এবিষয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে কোনো সন্দেহ নেই।

গবেষকদের মতে আচারাঙ্গসূত্র সম্ভবতঃ

খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে রচিত হয়েছিল। সুতরাং বাঁকুড়ায় জৈনধর্মের প্রবেশকাল খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতক হওয়াই যুক্তিসঙ্গত। এই প্রসঙ্গটির উপরে আলোপাত করতে গিয়ে সুখ্যাত বাঁকুড়াবিদ ‘শ্রী অমিয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়’ লিখেছিলেন, “The earliest reference to the country of which Bankura now forms a part is found in the Jaina Acharanga Sutra. The Sutra tradition, according to some scholars, dates from 6th or 5th century B.C., i.e. approximately from the time of Vardhaman Mahavira, is being assumed that parts of it were written around the 3rd Century B.C. According to the first book of the jaina Scriptures, the 24th Tirthankar Mahavira travelled Suhma-Bhumi and Vajai-Bhumi is the country of the Ladhas ( = Radhas).” আচারাঙ্গসূত্রের বিবরণ থেকে জানা যায় যে, রাঢ় অঞ্চলের মানুষ আতিথ্যপরায়ণ ছিলেন না, তাঁদের ব্যবহার ছিল রুক্ষ, তাঁরা সন্ন্যাসী বা ভিক্ষুদের ভিক্ষা দিতেন না; এমনকি ভিক্ষুদের পেছনে হিংস্র কুকুর লেলিয়ে দিতেও তাঁরা দ্বিধা করতেন না৷ এই উল্লেখের যাথার্থ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে।

কেননা, বাঁকুড়া জেলায় প্রধানতঃ

দিগম্বর সম্প্রদায়ের জৈন ভিক্ষুগণ এসেছিলেন এবং তাঁদের বস্ত্রহীন আকৃতি কুকুরদের বিরক্তির কারণ হয়ে থাকতে পারে। তাছাড়া, রাঢ়ের সেই অঞ্চলের সাধারণ মানুষ যদি পরমতসহিষ্ণু তথা ধর্মনিরপেক্ষ না হতেন, তাহলে জৈনধর্মের ব্যাপক বিকাশ সেই জেলায় বাস্তবায়িত হতে পারত না। বঙ্গের প্রতিবেশী রাজ্য মগধে খ্রিস্টপূর্ব ৫ম/৬ষ্ঠ শতক থেকেই জৈনধর্মের উদ্ভব ও বিকাশ পরিলক্ষিত হয়েছিল। স্বভাবতই বঙ্গের পশ্চিমে অবস্থিত সেই রাজ্য থেকেই জৈনধর্মের আগমন বর্তমান বাঁকুড়া জেলায় সংঘটিত হয়েছিল বলে ঐতিহাসিকরা অনুমান করেন। আচারাঙ্গসূত্রের অনেকখানি অংশ রাঢ় অঞ্চলে রচিত হয়েছিল বলেও অনুমিত হয়। বর্তমান বাঁকুড়া জেলার অবস্থান রাঢ়ের দক্ষিণাংশের অন্তর্ভূত ভৌগোলিক অঞ্চল হওয়ায় প্রাচ্যদেশ অর্থাৎ পূর্বভারতের আর্যায়ন প্রক্রিয়া মূলতঃ জৈনদের প্রভাবেই সম্পাদিত হয়েছিল, যদিও এই ধারণা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে কোন ঐক্যমত নেই। কিন্তু ওই অঞ্চলে জৈনদের প্রভাব প্রতিপত্তি ছিল সর্বাধিক। সুতরাং সেই বিস্তৃত ভৌগোলিক অঞ্চলের আর্যায়ন প্রক্রিয়ায় জৈনদের অবদানকে অস্বীকার করা যায় না। জৈন ধর্মের চতুর্বিংশ তীর্থঙ্কর ‘বর্ধমান মহাবীরের’ পদাঙ্ক অনুসরণ করে কাল থেকে কালান্তরে বাঁকুড়ায় জৈনভিক্ষু ও প্রচারকদের আগমন ঘটেছিল এবং তদানীন্তন সময়ে বাঁকুড়ায় জনবসতির ঘনত্ব অত্যন্ত অল্প হলেও স্থানীয় অধিবাসীগণ জৈনধর্মকে কেবলমাত্র স্বাগতই জানাননি, সেই ধর্মের প্রবল পৃষ্ঠপোষকতাও করেছিলেন – এমন বহু ঐতিহাসিক প্রমাণ বিদ্যমান। জৈন শ্রমণগণ স্থানীয় মানুষদের সাথে সৌহার্দ্য স্থাপনের মাধ্যমে আর্যীকরণপ্রক্রিয়া সম্পাদনের সাথে সাথে তাঁদের হৃদয়বৃত্তির পরিবর্তনেও সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন।

জৈনদের প্রভাবসূত্রে আর্যায়ন প্রক্রিয়াকে দ্রুততর করতে সহায়তা করেছিল তদানীন্তন স্থানীয় রাজন্যবর্গের ব্রাহ্মণদের পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান। তাঁরা তাঁদের রাজধানী সংলগ্ন অঞ্চলে ব্রাহ্মণবসতি স্থাপন করিয়েছিলেন। ব্রাহ্মণদের নিষ্কর ভূমি প্রদান, রাজসভায় তাঁদের সাম্মানিক বৃত্তি দান এবং মন্দিরগুলিতে তাঁদের পৌরোহিত্যকর্মে নিযুক্তীকরণ আর্যায়ন প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করেছিল। বাঁকুড়া জেলায় বহু ব্রাহ্মণ পরিবারকে স্থাপন করার ক্ষেত্রে তদানীন্তন রাজারা মুখ্য ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। ‘দ্বারকেশ্বর’, ‘কুমারী’, ‘কংসাবতী’, ‘শিলাবতী’, ‘তারাফেণি’ প্রভৃতি নদীর উভয়তীরস্থ অঞ্চলে জৈন মঠ ও মন্দিরের প্রত্নাবশেষ আজও ইতঃস্তত ছড়িয়ে রয়েছে। বহু জায়গায় জৈন তীর্থঙ্কর ‘পার্শ্বনাথের’ ‘সপ্তসর্পফণাশোভিত’ শিলামূর্তির ক্ষয়িত নিদর্শন আজও দেখতে পাওয়া যায়। সমগ্র বাঁকুড়া জেলা জৈনধর্ম ও সংস্কৃতির প্রভাববলয়ের অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং সেটার প্রবহমানতা দ্বাদশ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত অক্ষুণ্ণ ছিল। এ সম্পর্কে বাঁকুড়াবিদ ‘শ্রী অমিয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের’ অভিমতটি প্রণিধানযোগ্য। তিনি লিখেছিলেন, “And this should not cause any surprise as up to the 12th Century A.D., The most widely practised religion of the North Indian tradition in Bankura region was neither Brahminism nor Buddhism, but Jainism.” স্থানীয় অধিবাসীদের জৈনধর্ম ও সংস্কৃতির প্রতি সমর্থন তথা আনুকূল্য প্রদান ছাড়া জৈনধর্মের সেই বিকশিত রূপটি বাঁকুড়া জেলায় দৃষ্টিগোচর হতে পারত না। ‘দ্বারকেশ্বর’ নদের বিস্তীর্ণ অববাহিকা অঞ্চলে অবস্থিত ‘ডিহর’, ‘বহুলাড়া’, ‘সোনাতপল’, ‘দেউলভিড়া’ প্রভৃতি জনপদে খ্রিস্টীয় নবম থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যে বহু জৈন মঠ ও মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ‘ধারাপাট’, ‘রাধানগর’, ‘শলদা’, ‘জয়পুর’, ‘ময়নাপুর’ প্রভৃতি জনপদে স্থাপিত মন্দিরগুলিতে তীর্থঙ্করদের শিলামূর্তিগুলির সমাবেশ স্পষ্টতই উক্ত স্থানগুলিতে প্রবল জৈনপ্রভাবের বিষয়টিকে সুস্পষ্ট করে।

সেইসব মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত তীর্থঙ্করদের শিলামূর্তিগুলি ল্যাটেরাইট শ্রেণির পাথর দিয়ে তৈরি। বহু সংখ্যক তীর্থঙ্করমূর্তি নির্মাণের জন্য ব্যবহৃত সেই শ্রেণির শিলাখণ্ডগুলি বহু দূরবর্তী অঞ্চল থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল। কেননা সেইসব অঞ্চলে ল্যাটেরাইট শ্রেণির পাথরের কোন অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। বলা বাহুল্য যে সেই কাজের জন্য ব্যয়িত বিপুল পরিমাণ অর্থের জোগান দিয়েছিলেন সংশ্লিষ্ট জনপদগুলির বৃহৎ ভূস্বামী, ব্যবসায়ীবৃন্দ এবং রাজন্যবর্গ। কোনো কোনো জৈনমন্দির স্থানীয় বিত্তবান বণিক সম্প্রদায় নিজেদের অর্থব্যয়ে সেগুলি নির্মাণ করিয়েছিলেন। পূর্ব বাঁকুড়ার ‘ওন্দা’র অন্তর্গত ‘বীরসিংহপুর-রাজহাটি’ জনপদের উল্লেখ করে ‘শ্রী অমিয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়’ অভিমত প্রকাশ করেছিলেন যে, ওই সব অঞ্চলের সুপ্রাচীন অধিবাসীবৃন্দের মধ্যে ‘শঙ্খবণিক’, ‘তাম্বুলি’ ও ‘তসর’ শিল্পের সাথে যুক্ত ব্যবসায়ীদের অর্থানুকূল্যে বহু জৈন মন্দির স্থাপিত হয়েছিল। ‘শলদা’, ‘বহুলাড়া’, ‘সোনাতল’, ‘শালতোড়া’, ‘জয়পুর’, ‘গোকুলনগর’, ‘রাধানগর’ প্রভৃতি প্রত্নক্ষেত্রের সঙ্গে বাঁকুড়া জেলার দক্ষিণাংশে অবস্থিত ‘পরেশনাথ’, ‘চিৎগিরি’, ‘রুদড়া’, ‘হাড়মাসড়া’, ‘কেচন্দা’, ‘সাতপাটা’, ‘মানডি-ভোজদা’, ‘বড়কোলা’, ‘অম্বিকানগর’ প্রভৃতি প্রাচীন জনপদগুলিতেও জৈন ধর্মের বিকশিত রূপটি দ্বাদশ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত পরিলক্ষিত হয়েছিল। প্রধানতঃ জৈন প্রত্নাবশেষের সমাধিক্ষেত্ররূপে সেই অঞ্চলগুলি সুপরিচিত। এখনো সেই সব অঞ্চলের পথেঘাটে উন্মুক্ত প্রান্তরে ইতঃস্তত বিকীর্ণ রয়েছে সেইসব মহামূল্যবান প্রত্নতাত্বিক অবশেষ। যতগুলি নিদর্শন জনসমক্ষে এখনও পর্যন্ত বিদ্যমান, তার চেয়ে বহুগুণ নিদর্শন ভূগর্ভে এবং বিভিন্ন পুষ্করিণীর মধ্যে শায়িত রয়েছে। ‘কংসাবতী’ ও ‘কুমারী’ নদীর অববাহিকা অঞ্চলে মনুষ্যবসতির ইতিহাস কমপক্ষে দশ হাজার বছরের পুরানো। সেই অঞ্চলের সভ্যতা সংস্কৃতি সম্পর্কে আলোকপাত করতে গিয়ে ‘ভি. কৃষ্ণমূর্তি’, ‘কুঞ্জবিহারী গোস্বামী’ প্রমুখ প্রখ্যাত প্রত্নতাত্বিকরা অনুমান করেছিলেন যে, সেই অঞ্চলের সভ্যতা সংস্কৃতির সঙ্গে ‘মহেঞ্জোদাড়ো’ এবং সিন্ধুসভ্যতার সংযোগ ও বহুবিধ সৌসাদৃশ্য বিদ্যমান।

প্রত্নতত্ববিদ ‘ভি. কৃষ্ণমূর্তি’র নেতৃত্বে ১৯৫৯-৬০ সালে ‘ভারতীয় প্রত্নতাত্বিক সর্বেক্ষণ বিভাগ’ ‘কুমারী-কংসাবতী’ নদীর উভয় তীরবর্তী অঞ্চলে প্রত্নতাত্বিক ক্ষেত্রসমীক্ষা পরিচালনা করেছিল। তাঁদের ক্ষেত্রসমীক্ষা থেকে সেই অঞ্চলের প্রত্নপ্রস্তরযুগীয় সভ্যতা সংস্কৃতির বিদ্যমানতা প্রমাণিত হয়েছে। সেখানে প্রত্নপ্রস্তর যুগের বহু নিদর্শন আবিষ্কৃত হওয়ায় প্রমাণিত হয়েছিল যে দক্ষিণ বাঁকুড়ার ‘কুমারী’, ‘কংসাবতী’, ‘তারাফেণি’ ও ‘শিলাবতী’ নদীগুলির উভয়তীরবর্তী অঞ্চলে মানব বসতি এবং সেগুলোর অস্তিত্বশীলতা ছিল সুপ্রাচীন এবং সমগ্র বাঁকুড়া জেলায় সম্ভবতঃ প্রথম। সেইসব অঞ্চলে সম্ভবতঃ খ্রীস্টপূর্ব প্রথম শতক থেকে জৈনধর্ম এবং সংস্কৃতির সমাগমন ঘটেছিল। জৈনধর্ম ও সংস্কৃতির সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই সেইসব অঞ্চলের তদানীন্তন অধিবাসীদের ধর্মচেতনা ও লোকসংস্কৃতির মিথষ্ক্রিয়ার অবকাশ ঘটেছিল। ফলে বাঁকুড়া জেলার অন্যান্য অংশের সঙ্গে দক্ষিণ বাঁকুড়াতেও মিশ্রসংস্কৃতি ও পরমতসহিষ্ণুতার একটি গৌরবময় সামাজিক পটভূমি নির্মাণ বাস্তবায়িত হতে পেয়েছিল এবং জৈনধর্ম ও সংস্কৃতির বিকাশের সমৃদ্ধতম রূপটি খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতকের মধ্যে পরিলক্ষিত হয়েছিল। ১১৩৫ খ্রীস্টাব্দে পালবংশীয় রাজা ‘কুমারপালের’ দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ‘কলিঙ্গের গঙ্গাবংশীয় নৃপতি’ ‘অনন্তবর্মন চোড়গঙ্গ’ বাঁকুড়ার দক্ষিণাংশ পর্যন্ত তাঁর রাজ্যসীমাকে সম্প্রসারিত করেছিলেন। তিনি জৈন ধর্মবলম্বী হওয়ার কারণে তাঁরই পৃষ্ঠপোষকতায় দক্ষিণ বাঁকুড়ার সর্বত্র জৈনধর্মের প্রসার ঘটেছিল এবং বহু জৈনমন্দির তাঁর অর্থানুকূল্যে নির্মিত হয়েছিল। ‘অনন্তবর্মন’ ব্রাহ্মণদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন বলে তাঁর সঙ্গে উড়িষ্যা থেকে বহু ব্রাহ্মণ দক্ষিণ বাঁকুড়ায় আগমন করেছিলেন এবং সেখানে তাঁদের বসতি স্থাপন করেছিলেন।

এই প্রসঙ্গে ‘শ্রী অমিয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়’ লিখেছিলেন, “It is claimed that following the trails of Ananta Barman Chorganga’s victorious army, the Utakal Brahmins came over from Orissa and settled down in the southern and south-west part of the district which renamed under Orissa suzarainty for quite sometime.” বিগত শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে ‘কংসাবতী-কুমারী জলাধার প্রকল্পের’ কাজ চালানোর সময় বহু প্রত্নতাত্বিক নিদর্শন বিনষ্ট হয়ে গিয়েছিল। হারিয়ে গিয়েছিল ‘লাধনবনী’ ও ‘নীলগিরি’র বিস্তীর্ণ বনাঞ্চল সহ বহু পুরাতাত্বিক অবশেষ। ‘প্রস্তরযুগ’ থেকে ‘তাম্রাশ্মীয়’ যুগের শেষপর্ব পর্যন্ত অস্তিত্বশীল বহু নিদর্শনও সেই জলাধারগর্ভে স্থায়ীভাবে ডুবে গিয়েছিল। জলাধার প্রকল্পের কাজ চলাকালীন সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের প্রত্নতাত্বিক নিদর্শনগুলির বিনষ্ট হওয়ায় পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে ‘শ্রীমতী দেবলা মিত্র’ সেই অঞ্চলে একটি ব্যাপক ক্ষেত্রসমীক্ষা পরিচালনা করেছিলেন। সেই ক্ষেত্রসমীক্ষার নির্যাস ‘এশিয়াটিক সোসাইটির জার্নালে’ প্রকাশিত ‘Some Jain Antiques from Bankura, West Bengal’ শীর্ষক প্রবন্ধে সন্নিবেশিত হয়েছিল।

সেই প্রবন্ধে তিনি উল্লেখ করেছিলেন যে – ‘অম্বিকানগর’, ‘চিৎগিরি’, ‘পরেশনাথ’, ‘চিয়াদা’, ‘হাতিখেলা’, ‘রুদড়া’ প্রভৃতি ছোটবড় গ্রাম নিয়ে প্রাক-ইসলামিক শাসনকালে জৈনধর্ম ও সংস্কৃতির কতিপয় প্রভাবশালী কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছিল। ব্যাপক সমীক্ষার ভিত্তিতে তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন যে ‘অম্বিকানগরে’ অবস্থিত ‘অম্বিকামন্দিরের’ অধিষ্ঠাত্রী দেবতা আদতে জৈন তীর্থঙ্কর ‘নেমিনাথের’ ‘শাসনযক্ষী’ ছিলেন। কালপর্যায়ে বাঁকুড়া জেলায় জৈনধর্মের অবলুপ্তি ঘটলে তিনি ‘শাক্ত’ ভাবনায় পরিবর্তিত হয়ে ‘অম্বিকানগরের অধিষ্ঠাত্রী দেবী’তে পরিণতি লাভ করেছিলেন। শ্রীমতী মিত্রের সেই সিদ্ধান্ত প্রশ্নাতীত নয়। এই কারণে যে, দক্ষিণ বাঁকুড়ার জৈনক্ষেত্রগুলিতে প্রাপ্ত শিলামূর্তিগুলির প্রায় সবই তীর্থঙ্কর ‘পার্শ্বনাথের’ মূর্তি যাঁর প্রত্নলাঞ্ছন হল ‘সপ্তসর্পফণা’। দ্বিতীয়তঃ, অম্বিকা-মন্দিরের আরাধ্যা দেবীর পার্শ্বে ‘গণেশমূর্তি’র বিদ্যমানতা প্রমাণ করে যে তিনি দেবী ‘দুর্গা’রূপেই পূজিতা হয়ে আসছিলেন। তৃতীয়তঃ, দেবী অম্বিকার মন্দিরের সংলগ্ন পরিবারের মধ্যেই একটি সুপ্রাচীন শিবমন্দিরের অস্তিত্ব রয়েছে এবং সেই মন্দিরের পশ্চিমপার্শ্বে রক্ষিত ভগ্নপ্রায় তীর্থঙ্কর মূর্তিগুলির মধ্যে ‘নেমিনাথের’ কোনো মূর্তি নজরে পড়ে না। ‘অম্বিকানগরের’ কাছে ‘কুমারী’ নদীর উত্তরতীরে অবস্থিত ‘সারেংগড়’ ও ‘পরেশনাথ’ জৈনক্ষেত্ররূপে সুপরিচিত।

সেই অঞ্চলগুলি থেকে প্রাপ্ত তীর্থঙ্কর মূর্তিগুলির মধ্যেও ‘নেমিনাথের’ কোন মূর্তি পাওয়া যায়নি এবং তাঁর ‘শাসনযক্ষী’ ‘অম্বিকা’রও কোনো মূর্তি পাওয়া যায়নি। সুতরাং অম্বিকানগরের অধিষ্ঠাত্রী দেবীকে দেবী ‘দুর্গা’রূপে স্বীকার করাই যুক্তিসঙ্গত বলে ঐতিহাসিকদের মনে হয়। ‘অম্বিকানগরের’ অদূরে ‘কংসাবতী’ নদীর উত্তর তীরে ‘খাতড়া’ থানার অন্তর্গত ‘কেচন্দা’ নামক গ্রামে সংরক্ষিত ‘যক্ষিণীমূর্তি’টির স্বরূপ এবং নির্মাণশিল্প তথা নির্মাণকাল নিয়ে বিশেষ সমীক্ষা করেছিলেন প্রত্নতত্ববিদ ‘রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়’। তাঁর সেই সমীক্ষা সংক্রান্ত বিবরণী ‘দক্ষিণ-পশ্চিম বঙ্গের শিল্প’ শীর্ষক প্রবন্ধে সন্নিবদ্ধ হয়েছিল। ‘রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়’ তাঁর প্রবন্ধে ‘কেচন্দা’ গ্রামকে ‘কিচান্দা’ নামে আখ্যায়িত করেছিলেন। উক্ত শিলামূর্তিটিকে রোদ ও বৃষ্টির প্রভাব থেকে রক্ষা করতে. গ্রামবাসীরা নিজেদের উদ্যোগে চালা নির্মাণ এবং প্রাত্যহিক পূজার ব্যবস্থাপনা করেছিলেন। ‘রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়’ সেই শিলামূর্তিটি সম্পর্কে আলোকপাত করতে গিয়ে লিখেছিলেন, “কিচান্দার বিশাল শাসনদেবীমূর্তি দক্ষিণ-পশ্চিমবঙ্গের শিল্পের একটি শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। কিচান্দা বাঁকুড়া জেলার খাতড়া থানার এলাকাভুক্ত। মূর্তিটি উচ্চে প্রায় আট ফুট। উহার পিছনের চালিতে পাঁচটি জীন বা তীর্থঙ্করমূর্তি আছে। প্রধান মূর্তিটির মাথার উপরে কতকগুলি সফল আম্রশাখা এবং পাশে তেরটি পঙ্ক্তিতে জৈন পুরাণের গল্পের অংশ উৎকীর্ণ আছে। দেবী যে পথটির ওপর দাঁড়াইয়া আছেন তাহার নীচে একটি সিংহ উপবিষ্ট।

বিহারীনাথের উৎকীর্ণ সিংহ দেখিয়া মনে হয় দক্ষিণ-পশ্চিম বঙ্গের শিল্পকলার পতন দ্বাদশ শতাব্দীর পর আরম্ভ হয়। পাদানের শিলালিপি অস্পষ্ট। দ্বিতীয় পংক্তির প্রথম ‘শ্রীজগপালস্য’ বলিয়া মনে হইল। যদিও কানিংহাম নামক পূর্ববর্তী অধিকর্তারা এই দেশের ভিতর দিয়া গিয়াছেন তবুও এখন পর্যন্ত দক্ষিণ পশ্চিমবঙ্গের অর্ধের খবর কমই জানা গিয়েছে।” ‘রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়’ ‘কেচন্দা’র সেই ‘শাসনযক্ষী’টি কোন তীর্থঙ্করের সঙ্গে সম্পৃত্ত – সেই সম্পর্কে কোনো আলোকপাত করেননি। সেই ‘শাসনযক্ষী’ যদি ‘নেমিনাথের’ হতেন – তাহলে তিনি নিশ্চিতভাবেই সেটার উল্লেখ করতেন। মূর্তিটির শিল্পকলার গুণগ্রহণ করতে গিয়ে তাঁর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা, দক্ষিণ বাঁকুড়ার ভাস্কর্য শিল্পের সৌন্দর্যের দিকটিকে স্পষ্ট করে। বোঝা যায় যে খ্রিস্টিয় দ্বাদশ শতকে দক্ষিণ বাঁকুড়ায় বহু প্রতিভাধর ভাস্কর বসবাস করতেন এবং সেই অঞ্চলের ভাস্কর এবং জৈন শ্রমণগণ সংস্কৃত ভাষার চর্চাতেও অভ্যস্ত ছিলেন।

বাঁকুড়া জেলার বিভিন্ন জনপদ থেকে প্রাপ্ত জৈন প্রত্নস্বাক্ষর এবং ঐতিহাসিক সাক্ষ্যপ্রমাণ থেকে ঐতিহাসিকরা সহজেই অনুমান করতে পারেন যে, সেই জেলা থেকে জৈন ধর্ম কীভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল। ‘হাড়মাসড়া’য় অবস্থিত বিশাল জৈন মন্দিরটিও এই প্রমাণ দেয় যে, দ্বাদশ খ্রীস্টাব্দের পরবর্তী সময়ভাগ থেকে বাঁকুড়া জেলায় জৈনধর্মের ক্রমাপসরণ পর্ব শুরু হয়েছিল এবং চতুর্দশ খ্রিস্টাব্দের মধ্যেই বাঁকুড়া জেলা থেকে জৈনধর্মের অবলুপ্তি ঘটেছিল। প্রসঙ্গতঃ স্মরণীয় যে সপ্তম খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে ‘গৌড়রাজ শশাঙ্কের’ মৃত্যুর পরে তাঁর শাসনাধীন অঞ্চলের অন্যতম ‘তাম্রলিপ্ত’ ও তৎসংলগ্ন বিস্তীর্ণ ভৌগোলিক অঞ্চলে নিদারুণ অরাজক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। সেই ধরণের ‘মাৎস্যন্যায়’ প্রায় শতাধিক বর্ষ ব্যাপী স্থায়ী হয়েছিল। যার পরিণামে সবলের অত্যাচারে উৎপীড়িত জনগণ ‘গোপাল’ নামক এক যুবককে নৃপতিরূপে নির্বাচিত করেছিলেন। অষ্টম খ্রীস্টাব্দের মধ্যভাগে নির্বাচিত রাজা ‘গোপাল’, রাজ্যে শান্তিশৃঙ্খলা পুনঃস্থাপনে সক্ষম হয়েছিলেন এবং এর সাথেই বঙ্গে পালরাজাদের শাসন পর্ব শুরু হয়েছিল।

পালরাজারা ধর্মবিশ্বাসে বৌদ্ধ হলেও তাঁরা বৌদ্ধধর্মকে বলপূর্বক জনগণের ওপরে চাপিয়ে দেন নি। কিন্তু বৌদ্ধধর্ম রাজার ধর্ম হওয়ার কারণে খ্রীস্টিয় নবম শতক থেকেই উত্তরবঙ্গে জৈনধর্মের ঔজ্জ্বল্য হ্রাস পেতে শুরু করেছিল। পালরাজদের রাজত্বকাল দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। নবম খ্রীস্টাব্দের দ্বিতীয়ার্ধে, রাজা ‘দেবপালের’ মৃত্যুর পর থেকেই পাল বংশীয় রাজাদের প্রভাব প্রতিপত্তি হ্রাস পেয়েছিল। পালরাজাদের সেই দুর্বলতার সুযোগে ‘উৎকলের রাজা’ ‘প্রথম শিবকর’ রাঢ়ের দক্ষিণাঞ্চল পর্যন্ত নিজের রাজ্যসীমা সম্প্রসারিত করেছিলেন। ‘অজয়’ নদের দক্ষিণাংশে পালরাজাদের বৌদ্ধধর্ম প্রসারে কোনো প্রাণবন্ত ভূমিকা ছিল না। এই সম্পর্কে ‘শ্রী অমিয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়’ লিখেছিলেন, “they bring avowed Buddhists, the earstwhile ebiquitous Jainism had necessarily to recede from the areas, e.g.north Bengal, where their supremacy was unquestioned. It is, however, doubtful if the Palas exercised any concrete influence in the regions, south of the Ajay river in Bengal which, in effect, meant that Buddhism, professed and patronized by the ruling dynasty, had no opportunity to replace Jainism in the Bankura area, south of the Ajoy river, where the earstwhile faith continue to prosper till the sena rulers came upon the scene.” বাঁকুড়া জেলার দক্ষিণাংশে অবস্থিত প্রত্নতাত্ত্বিক অবশেষ পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যায় যে, এক কালে সেই অঞ্চলের সর্বত্র জৈন ধর্মেরই প্রাধান্য ছিল।

পরিমানে স্বল্প হলেও, বৌদ্ধ নিদর্শনগুলিও সেই প্রত্নক্ষেত্রগুলি থেকে পাওয়া গেছে, এবং সেই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলগুলিতে জনসাধারণের মধ্যে শৈব ও বৈঘ্নবধর্মীয় উপাসনা সংক্রান্ত বহু প্রাচীন মন্দির ও প্রত্ননিদর্শণের প্রমাণ পরিলক্ষিত হয়েছে। ‘পরেশনাথ’ ছাড়াও ‘শিলাবতী’ নদীর উভয়তীরে অবস্থিত ‘হাড়মাসড়া’, ‘বিবড়দা’, ‘লদ্দা’, ‘পেদ্দা’, ‘কেশিয়া’ প্রভৃতি জনপদগুলিও প্রাচীন জৈনক্ষেত্ররূপে পরিচিত ও ঐতিহাসিকরা এই বিষয়ে একমত যে, সেই সব জায়গার সংস্কৃতির উদ্ভব ও বিকাশকাল ন্যূনতম সহস্র বর্ষ প্রাচীন। ‘তালডাংরা’ থানার অন্তর্গত ‘হাড়মাসড়া’ সম্ভবতঃ দক্ষিণ বাঁকুড়ার একটি প্রধান জৈনক্ষেত্র ছিল। ১৫৬৫ খ্রীস্টাব্দে ‘সোলেমান কিরানীর সেনাপতি’ ‘কালাপাহাড়’ ‘সোনামুখী’র ‘স্বর্ণমুখী মন্দির’টি সম্পূর্ণ গুঁড়িয়ে দিয়েছিলেন। সেই সময় মূল মন্দিরটি বিনষ্ট হলেও ভগ্নপ্রায় একটি ছোটো আকারের জৈনমন্দির এখনো সেখানে বিদ্যমান রয়েছে। মন্দিরটির পশ্চিম দিকে একটি পুকুরের দক্ষিণ তীরে একটি ভগ্নপ্রায় ‘পার্শ্বনাথের মূর্তি’ নিতান্ত অবহেলার নিদর্শনস্বরূপ খোলা আকাশের নীচে ফেলে রাখা হয়েছে। ‘হিড়বাঁধ’ থানার অন্তর্গত ‘সানডি-ভোজদা’ সম্ভবতঃ বাঁকুড়া জেলার প্রাচীন জনপদগুলির মধ্যে অন্যতম। ১৯৯৪ সালে সেই গ্রামের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে অবস্থিত একটি পুকুর সংস্কার করতে গিয়ে বহু প্রত্নসামগ্রী আবিষ্কৃত হয়েছিল। ‘সাংড়া’ নামে পরিচিত ঐ পুকুরের দক্ষিণ-তীরে একটি ‘দারু’ময় জৈনমঠ ছিল।

সম্ভবত ‘কালাপাহাড়ের’ হাতে সেই মঠটিও বিনষ্ট হয়েছিল। মঠটিকে আগুন লাগিয়ে ভস্মীভূত করা হয়েছিল। মন্দিরটি অঙ্গারে পরিণত হওয়ার জন্য ঐ অঞ্চলের তৎকালীন অধিবাসীগণ পুকুরটির নামকরণ করেছিলেন ‘সাঙ্গারা’, যা কাল পর্যায়ে ‘সাংড়া’ নামে বিবর্তিত হয়ে গিয়েছে। দক্ষিণ বাঁকুড়ায় ‘কালাপাহাড়ের’ সম্ভাব্য আক্রমণের ভয়ে সংশ্লিষ্ট মন্দিরগুলিতে অবস্থানরত শ্রমনরা ওই সব জায়গা ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার আগে, বহু তীর্থঙ্করদের মূর্তি মাটির নীচে পুঁতে দিয়েছিলেন এবং পুকুরের জলে ফেলে দিয়েছিলেন। সেই কারণে ‘সাংড়া’রসংস্কার কালে বিশাল অঙ্গারের স্তূপ সহ ‘কয়েকটি তীর্থঙ্করের মূর্তি’ ছাড়াও ‘একটি পূর্ণাবয়ব নরকঙ্কাল’, ‘আরণ্যক প্রাণীর চোয়াল’, ‘লৌহনির্মিত তীর’, ‘হরিণের শিং’ প্রভৃতি উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছিল। বর্তমানে ‘পার্শ্বনাথের’ শিলামূর্তিটি স্থানীয় একটি প্রাচীন শিবমন্দিরে রাখা আছে। একখণ্ড গোলাকৃতি শিলাখণ্ডে উৎকীর্ণ রহস্যময় ‘সাধন চক্র’টি স্থানীয় ‘নিত্যানন্দ আশ্রমে’ সংরক্ষিত হয়েছে। উদ্ধার হওয়া মূর্তিগুলির মধ্যে একটি ক্ষুদ্রাকৃতির দেবী মূর্তিও উক্ত আশ্রমে সংরক্ষিত হয়েছে। ‘বন্যপ্রাণীর চোয়াল’ এবং ‘হরিণের শিং’ প্রভৃতি প্রত্নসামগ্রী, দক্ষিণ বাঁকুড়ায় বিস্তৃত বনাঞ্চল এবং তার পরিসরে অস্তিত্বশীল প্রাণী সম্পদের বৈচিত্র্যের বিষয়টিকেও সকলের সামনে উপস্থাপিত করে।

দশম খ্রীস্টাব্দের শেষ ভাগ থেকে পালরাজাদের আধিপত্য হ্রাস পেতে শুরু করেছিল এবং তাঁদের সেই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে বঙ্গে সেন রাজবংশের প্রভূত্ব বৃদ্ধি পেতে শুরু হয়েছিল। সেন রাজারা ‘কর্ণাট ক্ষত্রিয় বংশের’ অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। পালবংশের বিখ্যাত রাজা ‘রামপালের’ জীবন ও বিজয়গাথা অবলম্বনে ‘রামরচিত’ রচনা করেছিলেন ‘সন্ধ্যাকর নন্দী’। কবি দ্ব্যর্থবোধক শ্লোকে যুগপৎ ‘রামকাহিনী’ এবং ‘রামপালকাহিনী’ বর্ণনা করেছিলেন। প্রতিভাবান সেই কবি ১০৫৭ থেকে ১০৮৭ খ্রীস্টাব্দে পর্যন্ত সময়ভাগে সমগ্র বঙ্গে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তাঁর সেই কাব্যে সেনবংশীয় রাজা ‘বীর সেনের’ উল্লেখ পাওয়া যায়। ত্রয়োদশ খ্রীস্টাব্দের প্রথমার্ধের মধ্যেই বর্তমান বাঁকুড়া জেলারূপ ‘লক্ষ্মণ সেনের’ শাসনসীমার অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। সেনবংশীয় রাজন্যবর্গ ‘ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুধর্মের’ পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। বস্তুতঃ ‘লক্ষণ সেনের’ আমল থেকে বাঁকুড়া জেলা থেকে জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মের ক্রমাপসরণ পর্বের সমাপ্তি ঘটেছিল।

সেই অপসরণের সম্ভাব্য সুচনাকালরূপে একাদশ খ্রীস্টাব্দের শেষ ভাগকে চিহ্নিত করা যায়। সেন বংশীয় রাজারা হিন্দুধর্মের পৃষ্ঠপোষক হলেও বাঁকুড়া জেলা থেকে জৈনধর্মকে বলপূর্বক উৎখাত করার কোনো উদ্যোগ তাঁরা গ্রহণ করেননি। এই প্রসঙ্গে ‘শ্রী অমিয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়’ লিখেছিলেন, “The advent of the senas, who were Brahminical Hindus, were nonetheless very liberal in their religious belief and saw no point in ousting by force a religion, in which their subjects had believed for ages. But the royal patronage offered by them to brahminism slowly worked out the effacement of Jainism which did not die a violent death but because of the social and religious circumstances obtaining then-was gradually absorbed into the wider Brahminical Hindu fold.” ‘অমিয়কুমার বন্দ্যেপাধ্যায়ের’ এই বিশ্লেষণ সম্পূর্ণ যুক্তিযুক্ত হলেও, জৈনরা হিন্দুধর্মের ‘পঞ্চোপাসনার’ কোন আধারে তাঁদের পরিবর্তন সম্পূর্ণ করেছিলেন, তার কোনো উল্লেখ তিনি করেননি। ঐতিহাসিকদের মতে, একাদশ/দ্বাদশ খ্রীস্টাব্দ থেকেই বাঁকুড়া জেলার জৈনরা, ‘লোকায়ত শৈব ধর্মের’ সঙ্গে নিজেদের সংযুক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন। বহু প্রত্নতাত্বিক নিদর্শনের জৈনোত্তর কালে প্রয়োগ এবং গ্রহণরীতি দেখে গবেষকরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। অতীতে ‘রানীবাঁধ’ থানার অন্তর্গত ‘কুমারী’ নদীর উত্তরতীরস্থ ‘পরেশনাথে’ ‘তীর্থঙ্কর পার্শ্বনাথের মন্দির’, শিব ও বিষ্ণুমন্দিরের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান লক্ষ্যণীয় ছিল। সেই জায়গায় ‘পার্শ্বনাথ’ মূর্তির কাছে শিবের ‘নটরাজ’ মূর্তিও পূজিত হতেন।

সেই শিবমন্দিরের প্রাচীন ত্রিশূলটি বর্তমানে ‘কংসাবতী-কুমারী জলাধারের’ সঙ্গমস্থলের দক্ষিণতীরের পাহাড়ের ওপরে রক্ষিত হয়েছে এবং তারই সম্মুখে শায়িত রয়েছে একটি অতিশয় ক্ষয়প্রাপ্ত ‘পার্শ্বনাথ’ মূর্তি। সেই শিব ও বিষ্ণুমন্দিরের অস্তিত্বকাল ‘অনন্তবর্মনের’ ‘সারেংগড়ে’ দুর্গনির্মাণেরও পূর্ববর্তীকালের বলে ঐতিহাসিকরা মনে করেন। উত্তর বাঁকুড়ার ‘শালগেড়া’র কাছে ‘বিহারীনাথ পাহাড়ে’ প্রতিষ্ঠিত জৈন তীর্থঙ্কর মূর্তি অবশ্য শিবমন্দিরের তুলনায় প্রাচীনতর। ল্যাটেরাইট শিলায় নির্মিত ‘পার্শ্বনাথের’ সেই মূর্তিটি সেই শিবমন্দিরের কাছে আজও দেখতে পাওয়া যায়। সেখানে দ্বাদশ বাহু বিশিষ্ট বিষ্ণুর শিলামূর্তিটিও অতি প্রাচীন। সুতরাং এই জায়গাতেও ‘শিব’, ‘বিষ্ণু’ ও ‘পার্শ্বনাথের’ সহাবস্থান, এই সত্যের দিকে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে যে, হিন্দুধর্মের শিবোপাসনার পরিসরে জৈনদের অন্তর্ভুক্তকরণের প্রক্রিয়াটি খ্রীস্টিয় দ্বাদশ শতক থেকে গতিশীল হয়েছিল। ‘বিষ্ণুপুরের’ উত্তর-পশ্চিম দিকে অবস্থিত ‘ধারাপাট’ নামক বিখ্যাত প্রত্নক্ষেত্রের কৃষ্ণমন্দিরের বাইরের দেওয়ালে দুটি জৈন-মুর্তির বিদ্যমানতাও প্রমাণ করে যে সেই মন্দিরটি আদিতে একটি জৈন মন্দির ছিল। সপ্তদশ খ্রীস্টাব্দের গোড়ার দিকে সেই কৃষ্ণমন্দিরটি স্থাপিত হয়েছিল। সেই মন্দিরের অনতিদূরে পার্শ্বনাথের আরেকটি শিলামূর্তির অবস্থান এই ধারণাকে পুষ্ট করে।

‘রাইপুর’ থানার অন্তর্গত ‘সাতপাটা’ গ্রামের প্রাচীন শিবমন্দিরটিও আদিতে একটি জৈনমন্দির ছিল। সেই শিব মন্দিরের বাইরের দেওয়ালগুলিতে অনুপম ভাস্কর্যশিল্পের নিদর্শনস্বরূপ অনেকগুলি ‘পার্শ্বনাথ’ মূর্তি সিমেন্ট দিয়ে গেঁথে দেওয়া হয়েছে। ‘ওন্দা’ থানার ‘বহুলাড়া’র বিখ্যাত জৈনক্ষেত্রের একটি শিবমন্দিরে শিবলিঙ্গের পূজার্চনা প্রচলিত রয়েছে। সেই মন্দিরের পেছনের দেওয়ালে পার্শ্বনাথের একটি বিশাল শিলামূর্তি আজও সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। অতীতে সেই জনপদের বিভিন্ন জায়গায় উৎখনন চালাতে গিয়ে বহু জৈনমূর্তি পাওয়া গিয়েছিল। ফলে ‘বহুলাড়া’ যে একসময় জৈনধর্মের অন্যতম প্রধান উপাসনা কেন্দ্র ছিল সে বিষয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে কোন সংশয় নেই। এইভাবে কালক্রমে বাঁকুড়া জেলা থেকে জৈন আধ্যাত্মিক চিন্তাবলয়টি শীর্ণ হতে হতে এক সময় লোকায়ত শৈব উপাসনা ও লোকসংস্কৃতির চিন্তাপ্রবাহে নিজের স্বকীয়তাকে সম্পূর্ণরূপে হারিয়ে ফেলেছিল। লোকমানসে জৈন ধর্মের শাশ্বত প্রভাব মুদ্রিত করতে না পারার অন্যতম কারণ ছিল জৈনদের সুকঠোর আত্মসংযম ও আত্মনিপীড়ন ব্রত।

দিগ্বসন জৈন সাধকদের সাধনক্ষেত্রগুলিতে বসবাসকারী আদিম জনগোষ্ঠীগুলির নিজস্ব একটা সংস্কৃতি ছিল, যেগুলোর প্রবহমানতা এবং গৌরব জৈনসংস্কৃতির নিজস্ব প্রভাবে ক্ষুন্ন হয়নি। পরবর্তীকালে জৈনধর্ম ও সংস্কৃতির প্রত্ননিদর্শনগুলি শৈব অনুশাসন কেন্দ্রে বিলীন হলেও লোকসংস্কৃতির বৃহত্তম অঙ্গনে ‘সপ্তসর্পফনা’ শোভিত তীর্থঙ্কর ‘পার্শ্বনাথ’ বিস্ময়করভাবে ‘সর্পদেবী মনসা’য় পরিণত হয়েছেন। দক্ষিণ বাঁকুড়ার বহু জায়গায় ‘পার্শ্বনাথ’ ‘খাঁদারানী’ আখ্যায় ভূষিত। ‘খাতড়া’ থানার ‘দহলা’ গ্রামে ‘কংসাবতী’ নদীতীর থেকে উদ্ধার করা ‘পার্শ্বনাথের’ মূর্তিটি বর্তমানে ‘মনসাদেবী’রূপে পরম শ্রদ্ধায় পূজিত হচ্ছেন। এবং জৈনদের অনমনীয় কঠোরতা ও আত্মনিপীড়ন প্রবাহিত হয়েছে ‘শিবের গাজন’ ও ‘চড়ক মেলা’য় অংশগ্রহণকারী ভক্তদের (স্থানীয় নাম ‘ভক্ত্যা’) অতিশয় ক্লেশদায়ক উপবাস, ‘বানফোঁড়া’, ‘পিঠ ও জিভ ফোঁড়া’ – জাতীয় কর্মকান্ডর মধ্যে দিয়ে।

বাঁকুড়া জেলায় বৌদ্ধ ধর্মের প্রবেশ জৈনকালোত্তর যুগে সম্পন্ন হয়েছিল। বাঁকুড়া জেলার বৌদ্ধধর্ম মূলতঃ ‘দ্বারকেশ্বর’ নদের নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চলে এবং ‘কংসাবতী’ নদীর পশ্চিমতীরস্থ বর্তমান ‘পুরুলিয়া’ জেলা সংলগ্ন এলাকায় বিকশিত হয়েছিল। ওই সব অঞ্চলে বহু বৌদ্ধস্তূপ ও মন্দিরের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। কথিত আছে যে সুদূর ‘শ্রীলঙ্কা’ (সিংহল) থেকে বৌদ্ধ ভিক্ষুগণ ‘দ্বারকেশ্বর’ নদের অববাহিকা অঞ্চলে অবস্থিত মঠগুলিতে ‘সাধনমার্গ’ ও ‘দর্শন’ শিক্ষা গ্রহণের জন্য যাতায়াত করতেন। বাঁকুড়া জেলার দক্ষিণাংশ প্রধানতঃ জৈন প্রভাবিত অঞ্চল হলেও ‘রাইপুর’ থানার ‘মটগোদা’, ‘মণ্ডলকুলি’, ‘দেবাশোল’ প্রভৃতি গ্রামে বৌদ্ধধর্মের অস্তিত্ব উক্ত অঞ্চলগুলিতে আজও ইতস্তত ছড়িয়ে থাকা বৌদ্ধ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলি থেকে প্রমাণিত হয়। বৌদ্ধধর্ম কালক্রমে ‘সহজিয়া বৈষ্ণব’ ধর্মের পরিসরে সমাহিত হয়ে পড়েছিল। মূলতঃ ‘দ্বারকেশ্বর’ অববাহিকা অঞ্চল থেকে বৌদ্ধধর্মের ক্রমবিলুপ্তির কথা স্মরণে রেখেই ‘‘দ্বারিকের জলে ভাসে বোধি অবশেষ’’ জাতীয় প্রবাদবাক্যের অবতারণা হয়েছিল। দ্বাদশ খ্রীস্টাব্দে বৈষ্ণব কবি ‘জয়দেব’ তাঁর বিখ্যাত গীতিকাব্য ‘গীতগোবিন্দে’ ‘গৌতমবুদ্ধ’কে ‘বিষ্ণুর অবতার’রূপে স্বীকার করেছিলেন –

“নিন্দসি যজ্ঞবিধেরহহ শ্ৰুতিজাতম্
সদয়হৃদয়দর্শিত পশুঘাতম্।
কেশব ধৃতবুদ্ধশরীর জয় জগদীশ হরে।”

দ্বাদশ খ্রিস্টাব্দে রাজা ‘লক্ষ্মণ সেনের’ রাজত্বকালে কবি বীরভূম জেলার ‘কেন্দুবিল্ব’ গ্রামে আবির্ভূত হয়েছিলেন। ‘ভগবান তথাগত’কে ‘বিষ্ণুর অবতার’রূপে স্বীকৃতি দেওয়ার ফলে সমগ্র বাঁকুড়া জেলায় ‘বজ্রযানী সহজিয়া তন্ত্রসাধনা’য় নিরত বৌদ্ধগণ পরবর্তীকালে উদ্ভূত ও বিকশিত ‘সহজিয়া বৈষ্ণব ধর্মের’ পরিসরে নিজেদের পরিবর্তনকে সম্পন্ন করেছিলেন। সেনবংশীয় রাজাদের বৈষ্ণবধর্মের প্রতি অনুরক্তি তৎকালীন বৌদ্ধগণের বৈষ্ণবধর্মের পরিসরে আশ্রয় গ্রহণের অন্যতম কারণ ছিল। বাঁকুড়া জেলায় পশ্চিম সীমান্তবর্তী ‘পুরুলিয়া’ জেলার পূর্বভাগে ‘কংসাবতী’ নদীর তীরবর্তী কিছু অঞ্চলে বৌদ্ধধর্মের অস্তিত্বের কেন্দ্র ছিল ‘বুদ্ধপুর’ বা ‘বুধপুর’ গ্রাম। ‘বুধপুর’ থেকে ‘কংসাবতী’ নদী অতিক্রম করে তদানীন্তন মানভূমের রাজধানী ‘মানবাজার’ পর্যন্ত প্রসারিত রাস্তার দক্ষিণ দিকে একটি বিশাল বৌদ্ধস্তূপের অস্তিত্ব বিদ্যমান। অতীতে ‘বুধপুরের’ বহু বাড়িতে বৌদ্ধমঠ ও মন্দিরের ভগ্নাবশেষ নানাভাবে ব্যবহৃত হতে দেখা যেত। তবে দক্ষিণ বাঁকুড়ায় বৌদ্ধধর্মের উল্লেখযোগ্য কোন মঠ বা প্রচারকেন্দ্র ছিল না। ‘রাইপুর’ থানার থানার অন্তর্গত ‘মণ্ডলকুলি’ গ্রামের কাছে একটি গাছের তলায় বৌদ্ধ প্রত্নাবশেষ স্তূপীকৃত অবস্থায় এখনো পড়ে রয়েছে। কিন্তু একথা অনস্বীকার্য যে বৌদ্ধধর্ম প্রধানতঃ ‘দ্বারকেশ্বর’ নদের উভয় পার্শ্ববর্তী কিছু অঞ্চলে বিকশিত হলেও জৈনধর্মের তুলনায় বহুলাংশে নিষ্প্রভ ছিল। বাঁকুড়া জেলায় বৌদ্ধধর্মের অস্তিত্ব ‘ধর্মপূজা’র প্রেক্ষাপটে উপলব্ধি করা যায় বলে ‘মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী’ তাঁর অভিমত প্রকাশ করেছিলেন। সেই একই অভিমতের উল্লেখ ‘ও ম্যালী’ও (O’ Malley) করেছিলেন।

‘হরপ্রসাদ শাস্ত্রী’র মতে বৌদ্ধ ‘বজ্রযানী তান্ত্রিক সম্প্রদায়ের’ অনুসরণে ‘হিন্দু তান্ত্রিক সাধনমার্গ’ উদ্ভূত হয়েছিল। বৌদ্ধ ধর্মে ‘বুদ্ধ’, ‘ধর্ম’ এবং ‘সংঘ’ – এই ত্রিতয়তত্বের দ্বিতীয়স্থানে ‘ধম্ম’ বা ধর্মের অধিষ্ঠান। সেই ধর্মের উপাসনা মূলতঃ বৌদ্ধস্তূপের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। যেহেতু বাঁকুড়ার তদানীন্তন সমাজের উচ্চবর্গীয় মানুষেরা বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি তাঁদের আনুগত্য দেখান নি, তাই এর বিস্তার সমাজের নিম্নবর্গীয় মানুষদের মধ্যেই সম্প্রসারিত হয়েছিল। কালক্রমে বৌদ্ধদের সেই ধর্মই ‘ধর্মপূজা’র রূপ পরিগ্রহ করেছিল। কিন্তু বিস্ময়ের বিষয় এই যে, যেসব জায়গার ‘ধর্মপূজা’য় ব্রাহ্মণরা অংশগ্রহণ করেছেন – সেখানেই ‘কূর্মরূপী ধর্ম’ ‘শিব’ বা ‘বিষ্ণু’র উপাসনা প্রতীকে পর্যবসিত হয়েছেন। ‘হরপ্রসাদ শাস্ত্রী’ মনে করতেন যে, সেই ‘কূর্ম’ আসলে বৌদ্ধ স্তূপেরই প্রতীক এবং ধর্মের কুর্মাকৃতির পাঁচটি স্তরভেদের প্রত্যেকটিতে গৌতমবুদ্ধের পাঁচ প্রকার ধ্যানমূর্তিই কল্পিত হয়েছে। এই প্রসঙ্গে ‘ও ম্যালী’ লিখেছিলেন, “To this it may be added that at the present day, the image of Dharma is generally found in the house of low caste people, and that a popular saying is ‘Dharma nichagami’ i.e. Dharma favours the low.” ‘হরপ্রসাদ শাস্ত্রী’ প্রদত্ত ‘ধর্মপূজার স্বরূপ’ সংক্রান্ত অভিমতটি বিতর্কাতীত নয়।

প্রথমতঃ, কুর্মাকৃতির ‘পঞ্চস্তরীয় সংগঠন’ হিন্দু ধর্মের ‘পঞ্চোপাসনা’র সঙ্গে তুলনীয় বলে বিবেচিত হতে পারে। ‘ধ্যানীবুদ্ধের’ ‘পঞ্চপ্রকারত্বের’ বিষয়টির আরোপণ কূর্মাকৃতির সঙ্গে অনুমিত হয়েছে মাত্র, কিন্তু বিষয়টি সংশয়াতীত নয়।

দ্বিতীয়তঃ, ‘বিষ্ণু’র ‘দশাবতারের’ মধ্যে কূর্মাবতারের প্রসঙ্গটিও সুপ্রাচীন। ফলে ‘বিষ্ণুর কুর্মাবতারের’ বিষয়টিতে ‘বিষ্ণুর প্রতীকীকরণের’ সম্ভাবনা তিরোহিত হয় না। সুতরাং স্থানবিশেষে ‘কূর্ম’কে ‘বিষ্ণুর অবতার’রূপে উপাসনা করার বিষয়টি এই ধারণার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।

তৃতীয়তঃ, হিন্দু ধর্মে ‘পঞ্চোপাসনা’র আধ্যাত্মিকত্ব – ‘বিষ্ণু’, ‘শিব’, ‘শক্তি’, ‘গণপতি’ এবং ‘সূর্য’ – এই ‘দেবপঞ্চকের’ মধ্যে যিনি যে-দেবতার উপাসনা করেন, তাঁর উপাসনার কেন্দ্রে অবস্থান করেন সেই দেবতা এবং অবশিষ্ট দেবচতুষ্টয় এই কেন্দ্রীভূত উপাস্যদেবের প্রাপ্তিগোচরতার ক্ষেত্রে আনুকূল্য প্রদান করে থাকেন। সুতরাং এই দৃষ্টিকোণের পরিপ্রেক্ষিতে ‘ধর্মের’ সঙ্গে ‘বিষ্ণুর’ কেন্দ্রীভবন অসম্ভব কোন ব্যাপার হতে না।

চতুর্থতঃ, বাঁকুড়া জেলায় ‘লোকায়ত শৈব ধর্মের’ সুপ্রাচীন অস্তিত্বের বিষয়টি সর্বজনবিদিত। ‘রামাই পণ্ডিত’ ‘শূন্যপুরাণ’ রচনা করেছিলেন। শিবোপসনায় সমাজের তথাকথিত নিম্নবর্গীয় মানুষদের অংশগ্রহণ অদ্যাবধি প্রবহমান। অবশ্য এই সব যুক্তি সত্বেও একথা মানতেই হয় যে বৌদ্ধধর্মের ‘বজ্রযান-সহজযান তন্ত্রসাধনা’ ‘হিন্দু তন্ত্র সাধনা’র সঙ্গে সম্মিলিত হয়ে ‘সহজিয়া বৈষ্ণব ধর্মের সাধনমার্গ’কে পরিপুষ্ট করেছে।

এবং সেই সঙ্গে এই বিষয়টিও অনস্বীকার্য যে ‘বৌদ্ধ বজ্রযানী তন্ত্র সাধনা’য় নারীর ব্যাপক অনুপ্রবেশ বাঁকুড়া জেলায় বৌদ্ধ ধর্মের অস্তিত্ব লোপের ক্ষেত্রে সহায়তা করেছিল। এই প্রসঙ্গে ‘ও ম্যালী’ও একই মন্তব্য করেছিলেন। বাঁকুড়া জেলার বহু জায়গায় ‘ধর্মঠাকুর’ ‘বিষ্ণুর প্রতীক’রূপে পূজিত হন। ‘ইন্দাসের’ ‘বাঁকুড়া রায়’ আদতে একখণ্ড শিলাবিশেষ – যাঁকে ‘বিষ্ণুর প্রতীকরূপে’ উপাসনা করা হয়। ‘শালগ্রাম শিলা’র অনুষঙ্গ এক্ষেত্রে ক্রিয়াশীল রয়েছে। সেই শিলাখণ্ডে, দশটি বঙ্কিম রেখা ‘বিষ্ণুর দশ অবতার’ রূপে মান্যতা পেয়েছেন। সেই শিলাখণ্ডটি একজন ‘সূত্রধরের’ গৃহে প্রতিষ্ঠিত ছিল এবং ‘রথযাত্রা’ ও ‘মকর সংক্রান্তি’ উপলক্ষ্যে, সেটিকে কেন্দ্র করে আজও বিশেষ উৎসব আয়োজিত হয়। দেবতাকে প্রদত্ত খিঁচুড়ি ভোগ জনৈক ব্রাহ্মণ-প্রস্তুত করেন। ‘মঙ্গলপুরের’ ‘রূপনারায়ণ’ও কূর্মাকৃতির একটি শিলাখণ্ড। তাঁকেও ‘বিষ্ণুর অবতার’ রূপে পূজা করা হয়। জনৈক এক ‘তন্তুবায়ের’ গৃহে তাঁর অধিষ্ঠান ছিল।

‘ইন্দাস’ থানার ‘গাবপুর’, ‘বালসী’ প্রভৃতি জায়গাতেও এই ধরনের শিলাখণ্ডকে ‘বিষ্ণুর অবতার’ বলে পূজা করা হয়। ‘কোতুলপুর’ থানার ‘সিয়াস’, ‘বৈতল’ প্রভৃতি গ্রামে তিনি – ‘বংশীধর’, ‘কালাচাঁদ’, ‘বাঁকুড়া রায়’ নামে পূজিত হন। ‘জয়পুর’ থানার ‘গোপালপুরে’ ধর্মঠাকুর ‘কাঁকড়াবিছা’ নামে পূজিত হন। স্বভাবতই এই সব দৃষ্টান্ত ধর্মঠাকুরের বৌদ্ধ প্রেক্ষাপটকে সংশয়াতীতভাবে প্রমাণ করেনা। ‘বিষ্ণুপুরের’ ‘শাঁখারি পাড়া’য় ধর্মঠাকুর ‘বৃদ্ধাক্ষ’ নামে আরাধিত হন। ‘বৃদ্ধাক্ষ’ও একটি শিলাখণ্ড এবং ‘কর্মকার’ সম্প্রদায় ভুক্ত মানুষ তাঁর পূজায় পৌরোহিত্য করেন। সম্ভবতঃ এই কারণেই ‘কর্মকার’ সম্প্রদায়কে অতীতে ‘ধর্মপণ্ডিত’ বলা হত। এই প্রসঙ্গে ‘ও ম্যালী’ লিখেছিলেন, “It is said that the worship of the deity goes back to the days before the establishment of the Bishnupur Raj i.e. over 1100 years and that the ancient Rajas of Mallabhum gave the idol endowments of land, some of which are still held by the priests.”

বাঁকুড়া জেলায় বৌদ্ধ ধর্মের অপসরণ দ্বাদশ খ্রীস্টাব্দ থেকেই সুচিত হয়েছিল এবং ‘সহজিয়া বৈষ্ণব ধর্মে’ বৌদ্ধদের পরিবর্তন ষোড়শ খ্রীস্টাব্দের মধ্যেই সম্পূর্ণ হয়েছিল। ‘সহজিয়া বৈষ্ণবধর্মের’ মধ্যে বৌদ্ধধর্ম সমাহিত হলেও বাঁকুড়া জেলার ‘বিষ্ণুর লোকেশ্বর মূর্তি’র নির্মাণশিল্পের ওপরে এর প্রভাব বহুলাংশে বিদ্যমান ছিল বলে দেখা যায়। সেই ‘লোকেশ্বর বিষ্ণুমূর্তি’গুলি দ্বাদশ খ্রীস্টাব্দের পরবর্তীকালে নির্মিত হয়েছিল। ‘গৌতম বুদ্ধ’কে ‘বিষ্ণুর অবতার’ রূপে মান্যতা প্রদানের প্রেক্ষাপটে বিষ্ণুমূর্তিতে বুদ্ধের মূর্তিনির্মাণ কৌশল নির্দ্বিধায় অনুসৃত হয়েছিল। সুতরাং বাঁকুড়া জেলার শিল্পীগণ হিন্দু দেবমূর্তি নির্মাণে ‘বৌদ্ধ রীতি’ স্বচ্ছন্দে অনুসরণ করেছিলেন। ‘শলদা’র বিখ্যাত প্রত্নক্ষেত্রে এই ধরণের শিলামূর্তি পরিদৃষ্ট হয়। এই বিষয়টির উপরে আলোকপাত করতে গিয়ে, বাঁকুড়ার পুরাতত্ত্ববিদ ‘শ্রী চিত্তরঞ্জন দাশগুপ্ত’ লিখেছিলেন, “শলদার এই বিশিষ্ট পুরাক্ষেত্রে ভাগবত বৈষ্ণব ধর্মের সঙ্গে মহাযান বৌদ্ধ ধর্মের মিলনের ফলে মিশ্র লোকেশ্বর বিষ্ণু মূর্তির বিকাশ ঘটেছে, এমন মনে করা অসঙ্গত নয়।” ‘রানীবাঁধ’ থানার প্রথমসিদ্ধ পুরাক্ষেত্র ‘পরেশনাথ’ থেকে সংগৃহিত ও ভারতীয় যাদুঘরে রক্ষিত ভগবান বিষ্ণুর হৃষিকেশ প্রকরণের অনুপম শিল্পসুষমামন্ডিত বিষ্ণুমূর্তিটির নির্মাণ কাল নবম খ্রীস্টাব্দ। ‘শুশুনিয়া’ পাহাড়ে উৎকীর্ণ ‘মহারাজ চন্দ্রবর্মার শিলালিপি’র প্রতিষ্ঠাকাল খ্রীস্টিয় তৃতীয় শতক থেকে শুরু করে ‘পরেশনাথে’ প্রাপ্ত ‘হৃষিকেশ বিষ্ণুমূর্তি’ – বাঁকুড়া জেলায় ভাগবত বৈষ্ণব ধর্মের অস্তিত্বকালকে জৈন ও বৌদ্ধ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনসমূহের প্রতিষ্ঠাকালেরও পূর্ববর্তিত্বকে সপ্রমাণ করে। ‘শলদা’র কাছে ‘গোকুল’ নগরে প্রাপ্ত এক ‘নাগচ্ছত্র’ ‘লোকেশ্বর ভগবান বিষ্ণু’র ‘বরাহ অবতারের শিলামূর্তি’ পাল রাজাদের আমলে নির্মিত হয়েছিল।

‘রাজগ্রামের’ অনতিদূরে অবস্থিত ‘গোকুলনগরে’ প্রাপ্ত ভগবান বিষ্ণুর ‘ত্রিবিক্রমমূর্তি’ এবং অসাধারণ শিল্প সৌন্দর্যের আধার ‘শেষশায়ী’/‘অনন্তশয়ন’ মূর্তিটির নির্মাণকালও সুপ্রাচীন। বহু জায়গায় প্রাপ্ত সেই সব প্রত্ন নিদর্শন প্রাক জৈন কালের বলে অনেকে মনে করেন। ‘ইন্দপুর’ থানার অন্তর্গত ‘দেউল ভিড়া’য় প্রতিষ্ঠিত মহাবিষ্ণু মন্দিরে অধিষ্ঠিত – ‘মহাবিষ্ণু’, ‘কুবের’ ও ‘নটরাজ’ মূর্তিগুলির নির্মাণকালও অতি প্রাচীন। গভীর পরিতাপের বিষয় এই যে, ১৯৯৬ সালের আগষ্ট মাসে সেই মুর্তিগুলি অপহৃত হয়েছিল। আজ পর্যন্ত সেগুলোর আর কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। এই সব প্রত্নতাত্বিক নিদর্শন যে সাধারণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাপারে ঐতিহাসিকদের অনুপ্রেরিত করে, তা হল এই যে, প্রাক দ্বাদশ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত প্রাপ্ত বিষ্ণুমূর্তিগুলির মধ্যে ‘ধ্যানীবুদ্ধের’ কোনো প্রকারভেদের প্রতিফলন বা অনুকরণ সম্পূর্ণভাবে অনুপস্থিত ছিল। পক্ষান্তারে, দ্বাদশ খ্রীস্টাব্দোত্তর কালের বিষ্ণুমূর্তিগুলির মধ্যে ‘লোকেশ্বর বিষ্ণুমূর্তি’ সমূহের নির্মাণশৈলী বৌদ্ধ প্রভাব দ্বারা সম্পৃক্ত। সুতরাং এ কথা না মেনে উপায় নেই যে, দ্বাদশ খ্রীস্টাব্দে ‘কবি জয়দেব’ দ্বারা ‘দশাবতার স্তোত্রে’ ‘গৌতম বুদ্ধ’কে ‘বিষ্ণুর অবতার’রূপে মান্যতা প্রদান বা স্বীকরণ বিষ্ণুমূর্তি নির্মাণে বাঁকুড়ার শিল্পীদের বিশেষভাবে অনুপ্রানিত করেছিল। ‘মহাযানী লোকেশ্বরের’ সেই সংমিশ্রণকে প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ‘রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়’ স্বীকার করে নিয়েছিলেন। সেই স্বীকরণের পটভূমিতে সম্ভবতঃ ‘মহাযান-বজ্রযান-সহজযানের সাধনমার্গ’ ধরে ক্রমে ক্রমে ‘সহজিয়া বৈষ্ণবধর্মে’ বৌদ্ধদের আত্মনিমজ্জনের প্রক্রিয়াটিকে সম্পূর্ণতা প্রদান করেছিল।

‘পাশুপত শৈবধর্মের’ প্রবর্তক ভগবান ‘লকুলীশের’ মূর্তি বাঁকুড়া জেলার শিবমন্দিরগুলিতে সন্নিবেশিত হয়েছে এবং বহু ক্ষেত্রে জৈন দেউল এবং শিব মন্দিরের নির্মাণশৈলীর মধ্যে প্রচুর সাদৃশ্য থাকায়, দেবমন্দিরটি আদতে জৈন নাকি শৈব – সেটা চিহ্নিত করা অত্যন্ত জটিল হয়ে পড়ে। সুতরাং সামগ্রিক বিচারে বাঁকুড়া জেলায় প্রচলিত লোকসংস্কৃতি ও লোক উৎসবের গভীরতার মধ্যে নিহিত রয়েছে জৈন, বৌদ্ধ এবং শৈব ধর্ম ও সংস্কৃতির আচার তথা অনুশাসন-পরম্পরা। লোকসংস্কৃতির জীবনীশক্তি ও জনমোহিনী আকর্ষণশক্তির ক্রমহ্রাসমান পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে এই সব বিশিষ্টতাকে সম্ভবতঃ আর পৃথক করা সম্ভব হবে না। তা সত্ত্বেও একথা অনস্বীকার্য যে জৈন, শৈব, বৌদ্ধ এবং বৈষ্ণব ধর্মের বহু উপাদান প্রচলিত লোকসংস্কৃতির মধ্যে বিকীরিত, সংমিশ্রিত ও আত্মস্বীকৃত হয়ে গেছে। বস্তুতঃ এইসব বহু ধর্মাশ্রিত মন্দিরসমূহের দীর্ঘকালব্যাপী একত্রাবস্থান এবং সেগুলিকে জনসাধারণের শ্রদ্ধাবনতহৃদয়ে সহন ও গ্রহণ করার মধ্যে দিয়ে বাঁকুড়া জেলায় পরমত সহিষ্ণুতা এবং পারস্পরিক বিদ্বেষবর্জিত সামাজিক পরিমণ্ডলের এক গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস সংরচিত হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *