ভারতের ইতিহাসে ভৌগোলিক প্রভাব

ভারতের ইতিহাসে ভৌগোলিক প্রভাব

ভৌগোলিক প্রভাব

ভারতে বিভিন্ন পরিবেশ ভারতবাসীর জীবনযাত্রা , রাজনীতি ,অর্থনীতি ও সংস্কৃতি প্রাকৃতিক অবস্থার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে । ভারতের তিনদিক সমুদ্রবেষ্টিত এবং উত্তরে হিমালয় পর্বতমালা ভারতকে সুরক্ষিত করেছে ।তার ফলে ভারতের মানুষের জীবনধারা ও সংস্কৃতির স্বাতন্ত্র্য লাভ করেছে । ভারতের মধ্য দিয়ে কর্কটক্রান্তি রেখা যাওয়ায় এই অঞ্চলে অবস্থিত ভারতের অধিকাংশ অঞ্চল নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ু দ্বারা প্রভাবিত ।

হিমালয়ের প্রভাব :–

হিমালয় পর্বত ভারতে দেবতার আসনে প্রতিষ্ঠিত । ঐতিহাসিক কে এম পনিক্কর ভারতবর্ষকে হিমালয়ের দান বলেছেন । জনজীবনে হিমালয়ের প্রভাব গভীর ।
প্রথমত , ভারতে উত্তর, উত্তরপূর্ব দিকে হিমালয় পর্বত শ্রেণী বহির্বিশ্ব থেকে ভারতকে বিচ্ছিন্ন করেছে । ফলে ভারতের সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকশিত হয়েছে ।
দ্বিতীয়ত,এই পর্বতমালা প্রহরীর মতো উত্তরে দণ্ডায়মান থাকায় বহিঃশত্রুর হাত থেকে ভারতবর্ষকে রক্ষা করেছে ।
তৃতীয়তঃ ,হিমালয় পর্বত উত্তর ও মধ্য এশিয়ার শৈত্যপ্রবাহ কে প্রতিরোধ করে নাতিশীতোষ্ণ অবস্থা বজায় রেখে ভারতবাসীকে স্বাচ্ছন্দ প্রদান করেছে ।
চতুর্থত ,হিমালয় থেকে নির্গত বরফ গলা জল ভারতের অধিকাংশ নদ-নদী কে পুষ্ট করায় উত্তর ভারতের সমভূমি কে সুজলা সুফলায় সম্বৃদ্ধ করেছে ।
পঞ্চমত, ভারতের উত্তর-পশ্চিম দিকে হিমালয় পর্বতের কোলে খাইবার ,বোলান , গোমাল, গিরিপথ এর মধ্য দিয়ে ভারতের সঙ্গে বৈদেশিক বাণিজ্য ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল । আবার এই পথ দিয়ে মধ্য এশিয়া থেকে আগত গ্রিক, শক ,কুশান, হুন, পাঠান ,মুঘল প্রভৃতি বিভিন্ন জাতি ভারতে প্রবেশ করে , রাজ্য স্থাপন করে ভারতবাসীর জনসমাজে সঙ্গে মিশে ভারতীয় সংস্কৃতি কে পুষ্ট করেছে ।
ষষ্ঠতঃ সাগর থেকে উত্থিত দক্ষিণ পশ্চিম মৌসুমি বায়ু হিমালযে প্রতিহত হযে ভারতের বিভিন্ন স্থানে বৃষ্টিপাত ঘটিয়ে কৃষি ,অর্থনীতি ও জল সম্পদকে সমৃদ্ধ করেছে । ভারতীয় দর্শন ধর্ম ও সাহিত্যে হিমালয়ের স্থান অনন্য ।

ভারতের ইতিহাসে ভৌগোলিক প্রভাব
বিন্ধ পর্বতের প্রভাব :–

বিন্ধ পর্বতের দ্বারা ভারতের ইতিহাস প্রবাহিত হয়েছে । এই পর্বতের জন্য ভারত বর্ষ আর্যাবর্ত ও দাক্ষিণাত্য এ দুই ভাগে বিভক্ত হয়েছে ।
প্রথমত , বিন্ধ পর্বত ভারতের মধ্যস্থলে থাকায় উত্তর ভারত ও দক্ষিণ ভারতের মধ্যে যোগাযোগের অন্তরায় সৃষ্টি করে । ফলে সমগ্র ভারত ব্যাপী রাজনৈতিক ঐক্য স্থাপিত হতে পারেনি । প্রাচীন যুগে উত্তর ভারতের বিন্ধ পর্বত এর বাধা অতিক্রম করে দক্ষিণ ভারতের স্থায়ী প্রাধান্য স্থাপন করতে পারেনি । অপরদিকে দক্ষিণ ভারতের শাসকরা উত্তর ভারত আক্রমণ করে সাফল্য লাভ করেনি ।
দ্বিতীয়তঃ বিন্ধ পর্বত এর দুর্গমতার কারণে উত্তর ভারত থেকে দাক্ষিণাত্য বিচ্ছিন্ন ছিল বলে দক্ষিণ ভারতে স্বতন্ত্র দ্রাবিড় প্রভাবিত সভ্যতা ও সংস্কৃতি গড়ে ওঠে । পরবর্তীকালে আর্য ও সংস্কৃতির সমন্বয় ঘটে ।
তৃতীয়তঃ বিন্ধ পর্বত অতিক্রম করে আর্য অনুপ্রবেশ ব্যাপক না হওয়ায় দক্ষিণ ভারতের ভাষায় সংস্কৃত ভাষার প্রভাব কম থাকায় উত্তর ভারত ও দক্ষিণ ভারতের ভাষার মিল নেই।
চতুর্থত ,বিদেশীরা উত্তর ভারত বারবার আক্রমণ করলেও বিন্ধ পর্বত এর জন্য দক্ষিণ ভারত বিদেশি আক্রমণ থেকে অনেকাংশে মুক্ত ছিল । বিন্ধ পর্বত এর বাধার কারণে দাক্ষিণাত্যের সভ্যতা-সংস্কৃতির বিপর্যয় হয়নি ফলে প্রাচীন শিল্পকলা অস্তিত্ব বজায় রয়েছে ।

ভারতের ইতিহাসে ভৌগোলিক প্রভাব
নদনদীর প্রভাব :–

প্রাকৃতিক বৈচিত্র ভরা ভারতবর্ষে মূলত নদীমাতৃক । আর যে কারণে , ভারতবর্ষের অভ্যন্তরে প্রবাহিত নদ-নদীর তীরে গড়ে উঠেছিল প্রাচীনতম সভ্যতা । নদ নদী গুলি উপত্যকার উর্বরতা বৃদ্ধি করে । নদীর তীরে গড়ে উঠেছে বাণিজ্যকেন্দ্র জনপদ ও সভ্যতা । ভারতের প্রাচীন হরপ্পা সভ্যতা সিন্ধু নদ কে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয়েছিল ।
পরবর্তীকালে সিন্ধু গঙ্গা নদী উপত্যকায় আর্য সভ্যতা বিকাশ লাভ করে । উত্তর ভারতের এই নদী গুলির উপকূলে হরিদ্দার কনৌজ ,পাটলিপুত্র, বারানসি, দিল্লি প্রভৃতি জনপদ ও রাজনৈতিক কেন্দ্র গড়ে উঠেছিল । দক্ষিণ ভারতে কৃষ্ণা, গোদাবরী , কাবেরী , তুঙ্গভদ্রা প্রভৃতি নদী দাক্ষিণাত্যের অর্থনীতি ,রাজনীতি ও সংস্কৃতিতে প্রভাব বিস্তার করেছে । এই নদনদীর অববাহিকা অঞ্চলেই প্রাচীন চোল ,চের ,পান্ডা ,পল্লব ,চালুক্য প্রভৃতি রাজ্য গড়ে ওঠে । দেশের অভ্যন্তরে নদীপথে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটেছে। যাত্রী পরিবহন করে দেশের বিভিন্ন স্থানে অধিবাসীদের মধ্যে ঐক্য সৃষ্টি হয়েছে । নদীতীরে তীর্থস্থান গুলিতে সমাবেত ভারতবাসীর মধ্যে মিলনের ফলে ঐক্যবোধ জাগ্রত হয়েছে ।

সমুদ্রের প্রভাব :–

পর্বতমালার নেয় সমুদ্রও ভারত ইতিহাসের গতি প্রকৃতি নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করেছে । ভারতের পূর্বে বঙ্গোপসাগর পশ্চিমে আরব সাগর এবং দক্ষিনে ভারত মহাসাগর ভারতবর্ষকে বেষ্টন করে রেখেছে । এইসব সমুদ্র ভারতের ইতিহাস কে প্রভাবিত করেছে ।

প্রথমত , তিনদিক সমুদ্রবেষ্টিত থাকায় প্রাচীন ভারত বিদেশী শত্রুর আক্রমণ থেকে সুরক্ষিত ছিল । একমাত্র নৌ শক্তিতে বলিয়ান ইউরোপীয়রা সমুদ্রপথে ভারত আক্রমণ করেছিল ।

দ্বিতীয়তঃ, ভারতের সমুদ্র তীরে অনেক বাণিজ্য বন্দর গড়ে উঠেছিল । এই বন্দর গুলির মাধ্যমে সমুদ্রপথে দক্ষিণ এশিয়া, ব্রহ্মদেশ, মালয়, জাভা, সুমাত্রা, বোর্নিও ইন্দোচীন, ইন্দোনেশিয়া ও আফ্রিকা প্রভৃতি দেশের প্রাচীন ভারতের বাণিজ্য সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

তৃতীয়তঃ সমুদ্র বাণিজ্যের স্বার্থে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ভারতীয় উপনিবেশ হয়েছিল এবং ভারতীয় সংস্কৃতি সমুদ্র কে কেন্দ্র করে বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল।

চতুর্থত, ভারতীয়রা নৌবিদায় পারদর্শী ছিল । চোল রাজারা নৌ- শক্তির দ্বারা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজ্যঅংশ অধিকার করেছিলেন ।

পঞ্চমত, সমুদ্র বাণিজ্যের জন্য ইউরোপে ভারতীয় পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছিল এবং ইউরোপীয় দেশগুলো ভারতীয় পণ্যের জন্য ভারতে আসতে প্রলুব্ধ হয়েছিল ।

ষষ্ঠত, সমুদ্র থেকে প্রবাহিত মৌসুমী বায়ু বৃষ্টিপাত ঘটিয়ে ভারতকে শস্য-শ্যামলা করেছে।

ভারতের ইতিহাসে ভৌগোলিক প্রভাব

জলবায়ুর প্রভাব :–

জলবায়ুর বৈচিত্র ভারতের ইতিহাস ও সংস্কৃতির ধারা কে প্রভাবিত করেছে । উত্তরে শীতের প্রবল প্রকোপ, ক্রান্তীয় অঞ্চলে উষ্ণতা, মৌসুমী বায়ু প্রবাহিত প্রবল বারিপাত অঞ্চল অর্থাৎ ঋতু বৈচিত্র্যের কারণে ভারতবাসীর খাদ্য-সংস্কৃতি ও জীবনধারায় প্রভেদ সৃষ্টি হয়েছে । নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে স্বাচ্ছন্দ্যের কারণে ঘন জনবসতি গড়ে উঠেছে ।
ভারতবর্ষে প্রাকৃতিক বৈচিত্রের ফলে ভারতবাসীর মধ্যে কষ্ট সহিষ্ণু নির্ভীক রন নিপুন ও দৃঢ়চেতা চরিত্র গঠিত হয়েছে। প্রকৃতির প্রভাবে ভারতের সাহিত্য, সংস্কৃতি ,দর্শন ও ধর্মচেতনা বিভিন্ন সুরে গঠিত হলেও ঐক্যের আদর্শ প্রতিষ্ঠা হয়েছে।

1 thoughts on “ভারতের ইতিহাসে ভৌগোলিক প্রভাব

  1. Pingback: ভারতের ভূগোল – Shikshangan Institute

Comments are closed.