ভক্তিবাদী আন্দোলন
ভক্তিবাদ
সুলতানি যুগে ভক্তিধর্মের প্রসার ছিল এক বিরাট সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিপ্লব। বৌদ্ধ ধর্মের প্রসারের পর এত ব্যাপক ধর্মীয় আন্দোলন ভারতে ইতিপূর্বে সংগঠিত হয়নি। ভক্তি আন্দোলনের উদ্ভব সম্পর্কে ঐতিহাসিকগণ ভিন্ন ভিন্ন মতের অবতারণা করেছেন। ডক্টর কুরেশি , ইউসুফ হুসেন , ডক্টর তারাচাঁদ প্রমুখের মতে , ভক্তিবাদের উদ্ভবের পেছনে ইসলামের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। ভারতে মুসলমান আগমনের পর তাদের একেশ্বরবাদ হিন্দু সমাজের একাংশকে প্রভাবিত করে এবং তাঁদের চেষ্টায় ভক্তিবাদের প্রসার ঘটে।
Perhaps , after the decline of Buddhism , there had never been a more widespread and popular movement in our country than the bhakti movement . –
– A. L. Srivastava .
এই যুগে ভক্তিবাদ ও সুফিবাদ – এই দুই ধর্মীয় ও সামাজিক আন্দোলন হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে মিলনের সেতু নির্মাণে সাহায্য করে। কবির , নানক , রামানন্দ , শ্রীচৈতন্য – প্রমুখ ধর্মজ্ঞানীরা হিন্দু – মুসলিম সমন্বয়ের বাণী প্রচার করে মধ্য যুগের ভারতে এক নতুন চেতনার সঞ্চার করেন।
ভক্তি আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য :-
১. একেশ্বরবাদ :-
ভক্তিবাদের মূলকথা হল বাহ্যিক আড়ম্বরের পরিবর্তে আত্মার সাথে পরমাত্মার মিলন। ডক্টর তারাচাঁদ , ইউসুফ হোসেন , ডক্টর কুরেশি – প্রমুখের মতে , ইসলাম থেকে হিন্দুধর্মে ভক্তিবাদের প্রবেশ ঘটেছে। ইসলামের একেশ্বরবাদ ও আল্লাহের প্রতি আত্মসমর্পণ ভক্তিবাদের প্রচারকদের প্রভাবিত করে। হিন্দু ধর্মের বহুত্ববাদ , জটিল অনুষ্ঠান সর্বস্বতা – ইত্যাদির পরিবর্তে শুধুমাত্র ভক্তির মাধ্যমেই ঈশ্বর লাভ করার এই ধর্মীয় মত হিন্দু ধর্মের একাংশকে ভক্তিবাদের প্রসারে উৎসাহিত করে।
২. সুফিবাদের প্রভাব :-
ভক্তিবাদের উন্মেষে সুফিবাদের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। সুফি সন্তরা আল্লাহর প্রতি ভক্তিকেই মুক্তির একমাত্র পথ বলে অভিহিত করেন। তাঁরা অতীন্দ্রিয় , দিব্য উপলব্ধি , ভক্তিতত্ত্ব , নৈতিকতা এবং হিন্দু – মুসলিম সমন্বয়ের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। এই ধর্মীয় চিন্তা ভক্তিবাদের উন্মেষে বিশেষভাবে সহায়তা করে।
৩. ঐতিহাসিক বার্নেট – এর ভিন্নমত :-
অবশ্য , ভক্তিবাদের উদ্ভবের পেছনে যে ইসলাম ধর্ম ও সুফিবাদের প্রভাব রয়েছে – এই তত্ত্বের তীব্র বিরোধিতা করেছেন ঐতিহাসিক বার্নেট। তাঁর মতে , হিন্দু ধর্মের মধ্যেই ভক্তিবাদের বীজ নিহিত ছিল। বেদ , বিভিন্ন পুরাণ , গীতা – ইত্যাদি গ্রন্থে বহুকাল আগেই জ্ঞান – ভক্তি – কর্ম – মুক্তির এই পথগুলির সন্ধান দেওয়া হয়েছে। বিষ্ণু – পুরাণেও ভক্তিবাদের কথা উল্লিখিত আছে। সহজিয়া বৌদ্ধ ধর্মেও ভক্তির কথা বলা হয়েছে।
৪. সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভিত্তি :–
ভক্তি আন্দোলনের উদ্ভবের পেছনে তৎকালীন সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বিশেষ ভূমিকা পালন করে। হিন্দু সমাজের উচ্চবর্ণের লোকেরা ছিল খুৎ , মুকাদ্দাম ও সামন্ত শ্রেণীর মানুষ। মুসলিম শাসক শ্রেণীও ছিল সামন্ততান্ত্রিক। দরিদ্র কৃষক , নিম্নবর্ণের মানুষ , শহরের কারিগর শ্রেণী ছিল নিপীড়িত ও শোষিত। ভক্তিবাদ সামাজিক ন্যায়ের কথা প্রচার করে এই সকল মানুষদের বিশেষভাবে আকৃষ্ট করে।
৫. নায়নার ও আলওযার সম্প্রদায় :-
খ্রিস্টীয় সপ্তম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে দাক্ষিনাত্যেই প্রকৃতপক্ষে ভক্তিবাদের সূচনা হয়। শৈব নায়নার ও বৈষ্ণব আলওযার সম্প্রদায় এই আন্দোলনের সূচনা করে। তাঁরা জাতিভেদ প্রথা ও বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে ঈশ্বরের প্রতি প্রেম ও ও ভক্তির আদর্শকে তুলে ধরেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল বৌদ্ধ ধর্ম ও জৈন ধর্ম থেকে জনসাধারণকে সরিয়ে এনে সর্বশ্রেষ্ঠ দেবতার প্রতি তাদের আকৃষ্ট করা। নায়নার ও আলওযারদের এই সর্বশ্রেষ্ঠ দেবতা ছিলেন যথাক্রমে শিব ও বিষ্ণু।
৬. বর্ণবৈষম্যের বিরোধিতা :-
ইতিপূর্বে দাক্ষিণাত্যের নায়নার ও আলওযার সম্প্রদায় ভক্তি আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে বর্ণবৈষম্যের বিরোধিতা করেন। ভারতের অন্যান্য অঞ্চলেও সামাজিক ক্ষেত্রে বর্ণবৈষম্য তীব্র আকারে উপস্থিত ছিল। এই অবস্থায় রামানন্দ , কবির , শ্রীচৈতন্য – প্রমুখ ভক্তিবাদের প্রচারকগণ বর্ণবৈষম্যের তীব্র বিরোধিতা করেন ও সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠার বাণী প্রচার করেন।
রুশ গবেষিকা কোকা আন্তনোভা বলেন , ভক্তিবাদের সামাজিক সাম্য , ক্ষমতাসীনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ , মুসলিম আধিপত্য ও হিন্দুদের জাতিভেদ প্রথার বিরুদ্ধে আপত্তির প্রতিফলন।
৭. মূল আদর্শ : ভক্তি :-
ভক্তিবাদের প্রচারকেরা যাগযজ্ঞ , শাস্ত্রীয় অনুশাসন বা কোনো ধর্মীয় ক্রিয়াকলাপ মানতেন না। তাঁরা জাতিভেদ ও পৌত্তলিকতার ঘোর বিরোধী ছিলেন। তাঁরা একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী ছিলেন এবং তাঁরা মনে করতেন ঈশ্বর এক ও অভিন্ন। তাঁদের মতে , ভক্তিই ঈশ্বরলাভের একমাত্র উপায় এবং ভক্তি বলতে তাঁরা বুঝতেন – সমস্ত রকম কামনা , বাসনা রহিত হয়ে ঈশ্বর চিন্তা ও জীবে প্রেম। সকল প্রকার সংকীর্ণতা ত্যাগ করে মানুষে মানুষে এবং নারী – পুরুষের মধ্যে সমানাধিকারের প্রতিষ্ঠাতেও তাঁরা ব্রতী হন।
৮. রামানুজ :-
ভক্তিধর্মের আদি প্রচারক ছিলেন রামানুজ। কাঞ্চি ও শ্রীরঙ্গম ছিল তাঁর প্রচারের কেন্দ্র। কিন্তু চোল রাজাদের বিরোধিতার ফলে তিনি হোয়েসল রাজ্যে গমন করেন এবং সেখানে বৈষ্ণব ধর্মের ভিত্তি সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি প্রচার করেছিলেন ভক্তির মাধ্যমেই প্রকৃত মুক্তিলাভ সম্ভব।
৯. রামানন্দ :–
ভক্তিবাদের অন্যতম প্রবর্তক ছিলেন রামানন্দ। তিনি বৈষ্ণব ধর্মের প্রবর্তক রামানুজের শিষ্য ছিলেন। তিনি একেশ্বরবাদের প্রচার করেন এবং জাতিধর্ম নির্বিশেষে সকলের জন্যই ভক্তিবাদের প্রচার করেন। তিনি জাতিভেদ ও অস্পৃশ্যতা অস্বীকার করেন। পূজাবিধির সরলীকরণ ও বর্ণাশ্রমের কঠোরতা হ্রাস – তাঁর অন্যতম শ্ৰেষ্ঠ অবদান। তিনিই প্রথম উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের ভক্তিবাদী আন্দোলনের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করেন।
১০. কবীর :-
রামানন্দের শিষ্যদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন কবীর। তিনি ছিলেন মধ্য যুগের ভারতের সর্বাপেক্ষা উদারপন্থী সংস্কারক। হিন্দু দর্শন ও সুফি সন্তদের শিক্ষা তাঁকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে তিনি কোনো পার্থক্য স্বীকার করতেন না। সকল সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতি স্থাপনই ছিল তাঁর মূল লক্ষ্য। কবীরের মতে – তীর্থযাত্রা , পুণ্যস্নান , শাস্ত্রপাঠ , বিধিপালন বা আচার – অনুষ্ঠান পালন নয় , কেবলমাত্র মনের পবিত্রতা ও আন্তরিকতার মাধ্যমেই ঈশ্বরলাভ সম্ভব। হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মানুষেরাই তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। তাঁর রচিত ” দোঁহা ” গুলি হিন্দি সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ।
১১. গুরু নানক :-
শিখ ধর্মের প্রবর্তক গুরু নানক মূর্তিপূজা , জাতিভেদ প্রথা , মূর্তিপূজা , তীর্থযাত্রা ও ধর্মের বহিরঙ্গতার তীব্র নিন্দা করতেন। তাঁর মতে , ঈশ্বরলাভের জন্য কখনোই সন্যাস অপরিহার্য নয় ; সৎ ও নিরাসক্ত জীবন যাপন এবং ঈশ্বরের প্রতি অবিচল ভক্তির মাধ্যমে সাংসারিক জীবনেও মোক্ষলাভ সম্ভব। তাঁর ধর্মনীতির মূলকথা ছিল ঈশ্বর এক ও অদ্বিতীয়। হিন্দু ও মুসলিম উভয়েই তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। তাঁর শিষ্যরা শিখ নামে পরিচিত।
১২. শ্রীচৈতন্য :-
ভক্তিবাদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রবক্তা ছিলেন শ্রীচৈতন্য। বাইশ বছর বয়সে বৈষ্ণব গুরু ঈশ্বরপুরী – র কাছে কৃষ্ণমন্ত্রে দীক্ষা লাভ করেন। তিনি বৈষ্ণব ধর্মের মূলমন্ত্র বৈরাগ্য , বিশুদ্ধ প্রেম , ভক্তি ও জীবে দয়ার আদর্শ প্রচারে ব্রতী হন। বাংলাদেশে প্রেম ও ভক্তিমূলক বৈষ্ণব ধর্ম প্রচারে তিনি ছিলেন সর্বাগ্রগণ্য। উত্তর ও দক্ষিণ ভারতে ভ্রমণ করে তিনি সর্বত্র প্রেমধর্মের বন্যা প্রবাহিত করেন। তাঁর অনুগামীদের কাছে তিনি বিষ্ণুর অবতার হিসেবে পরিচিত। তাঁর প্রচারিত ধর্ম ” গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্ম ” নামে পরিচিত।
এছাড়াও ভক্তিবাদের প্রচারকদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন বল্লভাচার্য , মীরাবাঈ , নামদেব – প্রমুখ। সুলতানিযুগে ভক্তিবাদ মানুষকে ধর্মীয় সংকীর্ণতা থেকে মুক্ত করে এক নতুন প্রগতিশীল পথের সন্ধান দেয়। শুধুমাত্র ধর্মীয় ক্ষেত্র নয় , সামাজিক – রাজনৈতিক সর্বক্ষত্রেই এর প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী।