ভারতীয় সভ্যতার পরিচয়

ভারতীয় সভ্যতার পরিচয়

ভারতীয় সভ্যতা

★পূর্বে মনে করা হয়েছিল বেদ রচনার সময় থেকেই ভারতের সভ্যতার সূচনা। নানা প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারের সূত্রে সে ধারণা এখন বদলে গেছে।

★শুধু ইতিহাস চর্চাকারীদের মধ্যে নয়, স্কুলপাঠ্য বই আর সংবাদপত্রের লেখালেখির সূত্র ধরে সাধারণ জনসমাজেও। আমরা অনেকেই এখন জানি যে মধ্যপ্রদেশের ভীমভেটকার গুহায় প্রায় তিরিশ হাজার বছর আগে মানুষের আঁকা ছবি পাওয়া গেছে। হাজার হাজার পর্যটক প্রতি বছর সে গুহাচিত্র এখন স্বচক্ষে দেখে আসেন।

★বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারোর প্রত্নস্থল আবিষ্কারের সূত্র ধরে খোঁজ পাওয়া গেল হরপ্পা সভ্যতার। এটি সিন্ধু সভ্যতা নামেও পরিচিত ছিল। বর্তমানে একে অনেকে সিন্ধু সরস্বতী সভ্যতা বলেও ডাকতেন।

★এই সভ্যতার অনেক প্রত্নস্থল পরবর্তীকালেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। গুজরাট এবং তার পূর্বদিকে রাখিগড়ি সহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নস্থলের খোঁজ মিলেছে গত কয়েক দশকে, যা এই সভ্যতার বিস্তার সম্পর্কে বিশ শতকের প্রথম অর্ধের ধারণাকে প্রসারিত করেছে।

★বিশ শতকের শেষের দিকে নাগরিক হরপ্পা সভ্যতার পূর্ববর্তী পর্যায়ের গ্রামীণ সভ্যতার সন্ধান মিলেছে। একে বলা হয় মেহেরগড় সভ্যতা। আজ থেকে প্রায় নয়/ সাড়ে নয় হাজার বছর আগে যাযাবর শিকারী মানুষ এই অঞ্চলে কৃষিকাজ ও পশুপালন আরম্ভ করে ও স্থায়ী গ্রামীণ সভ্যতা গড়ে তোলে। বালুচিস্থানের বোলান উপত্যকায়, ইরান ও আফগানিস্থান সীমান্তের কিছুদূরে বোলান নদীর ধারে মেহেরগড় অবস্থিত।

★১৯৭৪ থেকে ১৯৮৬ পর্যন্ত দীর্ঘ বারো বছর ফরাসী প্রত্নতাত্ত্বিকদের একটি দল পাকিস্থানের মাটিতে এই খননকাজ চালিয়েছিলেন। পরে ১৯৯৭ থেকে ২০০০ সাল অবধি আবার এখানে খননকাজ চালানো হয়।

★মাটি খুঁড়ে এই এলাকায় সাতটি সভ্যতা স্তর পাওয়া গেছে। প্রথম বা সর্বপ্রাচীন স্তরটি সাড়ে নয় থেকে আট হাজার বছর আগেকার। দ্বিতীয় স্তরটি আট হাজার বছর ও তৃতীয় স্তরটি সাড়ে ছয় হাজার বছরের প্রাচীন। প্রথম স্তরে মাটির ইঁটের তৈরি বাড়ি পাওয়া গেছে। সে সময়ে তারা ছোট তীক্ষ্ণ পাথরের হাতিয়ার ব্যবহার করত। এরকম অসংখ্য হাতিয়ার এই স্তরে পাওয়া গেছে। শস্য পেশাইয়ের পাথর থেকে অনুমান করা হয় তারা খাবার রান্না করে খেত। মৃতদেহ কবর দেওয়া হত।

★একধরনের বিশেষ মাটি তারা সেই কবরে দিত পারলৌকিক সংস্কারের অঙ্গ হিসেবে। কবরের মধ্যে পাথর, সামুদ্রিক ঝিনুকের নেকলেস পাওয়া গেছে। লাপিস লাজুলিও আবিষ্কৃত হয়েছে। এই লাপিস লাজুলি সম্ভবত আসত আফগানিস্থান বা উত্তর বালুচিস্থানের চাঘতাই পার্বত্য এলাকা থেকে। সামুদ্রিক ঝিনুকের জন্য তাদের নিশ্চয় দূর বাণিজ্যের ওপর নির্ভর করতে হয়েছিল। সবচেয়ে কাছের সমুদ্রতট মাকরানের দূরত্ব এই এলাকা থেকে অন্তত ৫০০ কিলোমিটার।

★মেহেরগড়ের প্রাচীনতম স্তরটিকে ক ও খ দুটি উপস্তরে ভাগ করা হয়েছে। খ উপস্তরটি থেকে অনেক বড় আকারের কবরখানা পাওয়া গেছে যেখানে পাশাপাশি দেড়শটি কবরের অস্তিত্ব ছিল। তাদের পারলৌকিক ক্রিয়াকর্মেও এই দ্বিতীয় উপস্তরে কিছু পরিবর্তন এসেছিল। প্রথমে খোলা প্রকৃতিতে মৃতদেহ রেখে দেওয়া হত। তারপর বেশ কিছু মৃতদেহের হাড় সংগ্রহ করে একত্রে কবর দেওয়া হত।

★দ্বিতীয় প্রাচীন স্তরটি আট হাজার বছর আগে থেকে সাড়ে ছয় হাজার বছরের পুরনো। প্রাচীনতম স্তরটিতে মাটির তৈরি জিনিসপত্র পাওয়া যায় নি। কিন্তু এই দ্বিতীয় প্রাচীন স্তরের প্রথম উপস্তরটিতেই মাটির তৈরি জিনিসপত্র পাওয়া গেছে। তৃতীয় উপস্তরটিতে কুমোরের চাকের তৈরি মাটির জিনিসের সন্ধান মিলেছে।

★দ্বিতীয় স্তরে তামার তৈরি কয়েকটি জিনিসেরও সন্ধান পাওয়া গেছে, তবে মেহেরগড়ের তৃতীয় স্তরটি থেকেই প্রকৃতপক্ষে তাম্র যুগের সূচনা। সাড়ে ছয় হাজার বছর আগে এই স্তরটির সূচনা হয়েছিল। কুমোরের চাকের তৈরি জিনিসপত্রের ব্যবহার এই সময় শুধু অনেকটাই বেড়েছিল তাই নয়, সেগুলির মধ্যে নানা ধরনের বৈচিত্র্যও দেখা যায়। সেগুলির গায়ে নানা ধরনের অলংকরণও করা হয়েছিল। তিনটি উনুন সমৃদ্ধ মাটির জিনিস তৈরির একটি জায়গাও এই স্তর থেকে আবিষ্কৃত হয়েছে। ★মেহেরগড় সভ্যতার প্রাচীনতম স্তরটি থেকে শস্যাগারের সন্ধান পাওয়া গেছে। তৃতীয় স্তরে বহু কক্ষ বিশিষ্ট শস্যাগারের সন্ধান মিলেছে। চাষাবাদের যথেষ্ট প্রসারের প্রমাণ পাওয়া যায়। অসংখ্য ধরনের গাছপালা/ শস্যের সন্ধান মাটি খুঁড়ে পাওয়া গেছে। প্রথম দুটি স্তরে প্রধান শস্য ছিল বার্লি। গমও ছিল গুরুত্বপূর্ণ শস্য। তৃতীয় স্তর থেকে গমই প্রধান শস্য হয়ে ওঠে। অনেক ধরনের গমের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। পাওয়া গেছে কুল ও খেজুর ফলের বীজ। অনেক ধরনের তুলোর বীজও পাওয়া গেছে। চাষের জন্য শীতকালীন বৃষ্টি এবং সেচের ওপর নির্ভর করতেন চাষীরা। কাঠের হাতলওয়ালা পাথরের তৈরি কাস্তে চাষের কাজে ব্যবহার করা হত।

★মেহেরগড়ের প্রথম স্তরে হরিণ, সম্বর, নীল গাই, বুনো গাধা ইত্যাদি বন্য পশুর আধিক্য। পরের স্তরগুলি থেকে বন্য পশুর বদলে গৃহপালিত পশুর হাড়ের আধিক্য দেখা যায়। বোঝা যায় পশুপালন ক্রমশ বেড়েছিল। গৃহপালিত পশুর মধ্যে ছিল ভেড়া, ছাগল, গরু, মোষ। তৃতীয় স্তরের সময়কাল থেকে দাঁতের গঠনে পরিবর্তন আসে। সম্ভবত খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তনই ছিল এর কারণ।

★চতুর্থ স্তরে এসে যে সমস্ত ঘরবাড়ি পাওয়া গেছে সেগুলো অপেক্ষাকৃত বড় আকারের। বাড়ির মধ্যেকার এক একটি ঘর চওড়া দেওয়াল ও দরজা দিয়ে আলাদা করা। এই পর্বে যে মাটির তৈরি জিনিসপত্র পাওয়া গেছে সেগুলি বহুবর্ণ চিত্রিত। এই স্তরেই সন্ধান পাওয়া গেছে টেরাকোটার তৈরি উন্নত নাসা এক নারী মূর্তির। পঞ্চম স্তরে যে ধরনের মাটির জিনিসপত্র পাওয়া যায়, তা চতুর্থ স্তরের মতোই। কিন্তু ষষ্ঠ স্তরে এসে আবার নতুন ধরনের মাটির জিনিসের সন্ধান পাওয়া যায়। পিপল পাতা থেকে পাওয়া লাল রঙে এই পর্বের অনেক মাটির জিনিসকে রাঙানো হয়েছিল।

★এই স্তরে টেরাকোটার তৈরি অনেকগুলি নারী মূর্তি পাওয়া গেছে। তাদের কেশসজ্জা ও ভারী বক্ষ হল লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য।
মেহেরগড়ের তৃতীয় স্তরটির সমকালীন সময়ে বোলান পাস এর অন্যদিকে কোয়েত্তা উপত্যকায় হানা নদীর ধারে কিলি গুল মহম্মদ অঞ্চলে গড়ে ওঠে আরেকটি সভ্যতা কেন্দ্র। ১৯৫০ সালে প্রত্নতত্ত্ববিদ ওয়াল্টার এ ফেয়ারসার্ভিস এই অঞ্চলে প্রথম খননকাজ চালিয়েছিলেন। এর প্রাচীন স্তরটি প্রায় সাড়ে ছয় হাজার বছরের পুরনো। তবে তারও কিছু আগে এখানে জনবসতি গড়ে উঠেছিল বলে অনুমান করা হয়।

★প্রথম দিকে এরা যাযাবর ই ছিল, পরে মাটির তৈরি বাড়িতে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করে। চারটি স্তরে কিলি গুল মহম্মদ সভ্যতাকে ভাগ করা হয়। তৃতীয় স্তরে এসে পাওয়া যায় তামার তৈরি জিনিসপত্র। তৃতীয় স্তরেই কালো ও লাল রঙের জ্যামিতিক নক্সা আঁকা কুমোরের চাকের তৈরি জিনিসপত্র পাওয়া গেছে। এর আগের দ্বিতীয় স্তর থেকে পাওয়া মাটির জিনিসপত্র ছিল হাতে তৈরি। কিলি গুল মহম্মদ সভ্যতার চতুর্থ স্তরটি ডাম্ব সাদাত সভ্যতার প্রাচীনতম স্তরটির সমসাময়িক।

★উভয় ক্ষেত্রেই উল্লিখিত স্তরে যে পোড়া মাটির কাজ পাওয়া গেছে তা পাতলা এবং খুব ভালো ভাবে পোড়ানো। মাটির পাত্রগুলো সাধারণভাবে কালো রঙের বিভিন্ন জ্যামিতিক আকারের চিত্রে চিত্রিত। কখনো কখনো লাল রঙও দেখা যায়। ডাম্ব সাদাত প্রত্নক্ষেত্রের দ্বিতীয় স্তরটি পাঁচ হাজার বছরের পুরনো এবং এটিই ছিল এই সভ্যতার মধ্যবিন্দু। এখানে এই স্তরে বহু কক্ষ বিশিষ্ট ঘর দেখা গেছে। এখানে প্রাপ্ত পোড়ামাটির জিনিসপত্রের মধ্যে রান্না ও গৃহস্থালির সরঞ্জাম ছাড়াও গৃহপালিত বিভিন্ন পশু এবং নারীমূর্তি পাওয়া গেছে। টেরাকোটার নারীমূর্তিগুলি ★মেহেরগড় সভ্যতার ষষ্ঠ স্তরে প্রাপ্ত নারীমূর্তিগুলির মতোই। বাড়িঘরের ছোট ছোট টেরাকোটার প্রতিরূপও এখানে পাওয়া গেছে। একটি ছুরি পাওয়া গেছে তার ধারটি তামার তৈরি।
১৯৪৮ থেকে ১৯৫৭ সালের মধ্যে কালাত মালভূমি অঞ্চলে বেত্রিস দ্য কার্দি তাঁর প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান চালান। এই অনুসন্ধান থেকে আঞ্জিরা এবং শিয়া দাম্ব অঞ্চলে প্রত্নক্ষেত্রের সন্ধান পাওয়া যায়। এখানে পাঁচটি স্তরে সভ্যতার নিদর্শন পাওয়া গেছে।

★প্রাচীনতম স্তরটি কিলি গুল মুহম্মদ সভ্যতার দ্বিতীয় স্তরের সমসাময়িক। এছাড়াও ভারতীয় উপমহাদেশ ও তার নিকট পশ্চিমের প্রাগৈতিহাসিক প্রত্নস্থলগুলির মধ্যে আছে দক্ষিণ পূর্ব আফগানিস্থানের মুণ্ডিগাক, বালুচিস্থানের ঝোব লোরালাই, আনাম্বার উপত্যকার সুর জঙ্গল, দাবার কোট, রানা ঘুনডাই। মুণ্ডিগাককে আজ থেকে সাড়ে পাঁচ থেকে ছয় হাজার বছরের পুরনো প্রত্নক্ষেত্র বলে মনে করা হয়। রানা ঘুনডাইকে আরো প্রাচীন, প্রায় সাড়ে ছয় হাজার বছরের পুরনো সভ্যতা বলে মনে করা হয়। রানা ঘুনডাইতে প্রাপ্ত এক পশুর দাঁতকে কেউ কেউ ঘোড়ার দাঁত বলে মনে করেছেন। অনেকে এটা মানতে চান নি, বলেছেন ঘোড়া নয়, এটা গাধার দাঁত। ডেরা ইসমাইল খান জেলায় সিন্ধুর উপনদী গোমালের ধারে বেশ কয়েকটি প্রত্ন

ক্ষেত্র পাওয়া গেছে। গুমলা এবং রহমান ঢেরি এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। এখানে যে সব মাটির জিনিস পাওয়া গেছে তার সাথে সেন্ট্রাল এশিয়ার তুর্কমেনিস্থানে প্রাপ্ত জিনিসপত্রের সাদৃশ্য রয়েছে।

★আজ থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার বছর আগে হরপ্পা সভ্যতার বিভিন্ন কেন্দ্রগুলোতে যখন উন্নত নাগরিক সভ্যতার বিকাশ ঘটছিল, তা কোনও আকস্মিক সভ্যতা ছিল না। চারপাশের এক বিস্তৃত অঞ্চলে হরপ্পা সভ্যতারও চার হাজার থেকে দু হাজার বছর আগে থেকে প্রবহমান গ্রামীণ কৃষি সভ্যতার ভিত্তির ওপরেই এই নাগরিক সভ্যতা গড়ে উঠেছিল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *