|| বাংলার ঐতিহ্যবাহী শীতলপাটি ||

শীতলপাটি

শীতলপাটি

“বুকের মধ্যে মস্তো বড় ছাদ থাকবে
শীতলপাটি বিছিয়ে দেব;
সন্ধে হলে বসবো দু’জন”
মনে থাকবে!
আরণ্যক বসুর জনপ্রিয় এই ‘মনে থাকবে’ কবিতায় শীতলপাটি বিছিয়ে স্বস্তিতে বসে থাকার প্রস্তাব আমরা অনেকেই পড়েছি। আজ জানবো এই স্বস্তিদায়ক শীতল করা শীতলপাটির কথা।
দুর্বিষহ গরমে শহুরে মানুষ যখন একটু শীতলতার জন্য বৈদ্যুতিক পাখা, এসি, কুলার নিয়ে ব্যস্ত তখন মনে পড়ে বেশ ক-বছর আগেও গ্রামের উঠোনে বা গাছতলায় গ্রামের এসি বলে প্রচলিত শীতলপাটি বিছিয়ে আড্ডার দিন গুলোর কথা। শীতলপাটি একসময় ছিলো নিত্যদিনের গ্রামবাংলার অনুসঙ্গ।
কুটুম এলো, কুটুম এলো, ঝেড়ে ধুলো-মাটি
 দাও বিছিয়ে চিকন বেতে তৈরি শীতলপাটি!
মেঝেতে পাতা আসন বা গালিচার একটির ধরণ এই শীতলপাটি, যার বিশেষ বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে এতে বসলে গরমে ঠান্ডা অনুভূত হয়। তাই এর নামকরণ করা হয়েছে শীতলপাটি। যে গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ থেকে শীতল পাটি তৈরী করা হয় তার স্থানীয় নাম ‘মুর্তা’। স্থানভেদে একে ‘মুস্তাক’, ‘পাটিবেত’ ,’পাইত্রা’ ইত্যাদি নামেও অভিহিত করা হয়। ঝোপ আকারে জন্মানো সরু বাঁশের মতো দেখতে এই মুর্তা গাছ, যা শুষ্ক মৌসুমে রোপণ করা হয়। পরিপক্ব হলে বর্ষার মৌসুমে এই মুর্তার কাণ্ড গোড়া থেকে কেটে পানিতে ভিজিয়ে রেখে দা দিয়ে চেঁছে পাতা ও ডাল-পালা ফেলে, দূর করা হয় ময়লা। তারপর মাটিতে মাছকাটার বটির সাহায্যে মুর্তার কাণ্ডটিকে চিড়ে লম্বালম্বি কমপক্ষে চারটি ফালি বের করা হয়। কাণ্ডের ভেতর ভাগের সাদা নরম অংশকে ‘বুকা’ বলে, যা চেঁছে ফেলে দেয়া হয়। যে ব্যক্তি পাটি তৈরী করে তাকে বলা হয় ‘পাটিকর’ বা ‘পাটিয়াল’। পাটিকরের লক্ষ্য থাকে মুর্তার ছাল থেকে আঙুলের নখ দিয়ে ছিলে যতটা সম্ভব সরু ও পাতলা ‘বেতী’ তৈরী করে নেয়া। কারণ বেতী যত সরু ও পাতলা হবে পাটি তত নরম ও মসৃণ হবে। আন্দাজ করা হয়, একজন দক্ষ কারিগর একটি মুর্তা থেকে বারোটি পর্যন্ত সরু বেতি তৈরী করতে সক্ষম। আঙুল দিয়ে ছিলে ছিলে বেতী তৈরীর সময় বেতীর ধারে আঙ্গুল না ফেঁড়ে যায় সেইজন্য একজন পাটিকর বুড়ো আঙ্গুল ও মধ্যমায় কাপড় পঁচিয়ে নেয়। এরপর বেতীকে গুচ্ছ বা বিড়ার আকারে বেধে ভাতের মাড়ের সাথে আমড়া, জারুল ও গেওলা ইত্যাদি গাছের পাতা মিশিয়ে সিদ্ধ করা হয়। এর ফলে বেতী হয় মোলায়েম, মসৃণ ও চকচকে। পাটিতে রঙ্গীন নকশা ফুটিয়ে তুলতে হলে সেদ্ধ করার সময় রং এর ব্যবহার করতে হয়। এসব পাটিতে বুননের দক্ষতায় পৌরাণিক কাহিনিচিত্র, পাখি, ফুল-লতা-পাতা বা অন্যান্য জ্যামিতিক নকশা ও মোটিফ তুলে ধরা হয়। বর্তমানে অন্যান্য হস্তশিল্পজাত পণ্য তৈরীতেও শীতলপাটির খন্ডাংশ ব্যবহার করা হয়।
নকশা,বুনন,মসৃণতার উপর ভিত্তি করে শীতলপাটির রয়েছে বিভিন্ন নাম আর প্রকার। যার মধ্যে গ্রামের গৃহস্থ পরিবারে ‘সিকি’, ‘আধুলি’, ‘পয়সা’,  ‘টাকা’, ‘নয়নতারা’, ‘আসমান তারা’, ‘শাপলা’, ‘সোনামুড়ি’, ‘টিক্কা’ নামের পাটির ব্যবহার বেশি। এছাড়া ‘লালগালিচা’, ‘ধাধুলি’, ‘মিহি’ অভিজাত পাটি হিসেবে চাহিদা অনুযায়ী তৈরি করা হয়। এর মধ্যে ‘সিকি’ পাটি খুবই মসৃণ হয়। কথিত আছে, মসৃণতার কারণে সিকি পাটির ওপর দিয়ে সাপ চলাচল করতে পারে না। এছাড়াও শীতল পাটির উপাদান দিয়েই আসন পাটি এবং নামাজের পাটিও বানানো হয়।
বাংলাদেশ এর সিলেট  অঞ্চলের সুনামগঞ্জ, বালাগঞ্জ, রাজনগর, মৌলভিবাজারের ধুলিঝরা প্রভৃতি এলাকায় পাটিকররা তাদের নিপূণতার জন্য শত শত বৎসর যাবৎ প্রসিদ্ধ। শীতলপাটিকে ‘সিলেটের মসলিন’ বলা হয়। এছাড়াও বরিশালের ঝালকাঠির রাজাপুর, নলছিটি, পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি, ফরিদপুরের সাতৈর,ফেনীর সোনাগাজী, ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা প্রভৃতি স্থানে উন্নতমানের শীতলপাটি তৈরি হয়।
 ‘দুটি পাতা একটি কুড়ি
  শীতলপাটি গরম চা’
– এই লোকসাহিত্যের লাইন দুইটি সিলেট অঞ্চলের  শীতলপাটির জনপ্রিয়তাকে নির্দেশ করে। এসহ শীতলপাটি নিয়ে বিভিন্ন ঘটনা এবং জনশ্রুতি রয়েছে। সিলেটের প্রসিদ্ধ ইতিহাসবিদ অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধি তার ‘শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ‘১৮৭৬-৭৭ খ্রিস্টাব্দে শ্রীহট্ট হইতে ৩৯২৭ টাকা মূল্যের পাটি রপ্তানি হইয়াছিল।’ উনিশ শতকে ঢাকার নবাবরা সিলেটের কারিগরদের দিয়ে হাতির দাঁতের শীতলপাটি তৈরি করিয়েছিলেন, যা লোকশিল্পের অতুলনীয় নিদর্শন। সোনা-রুপা দিয়ে  শীতলপাটিতে নকশা করারও নজির ছিল। জনশ্রুতিতে জানা গিয়েছে ব্রিটিশ আমলে রানী ভিক্টোরিয়ার রাজপ্রাসাদে স্থান লাভ করেছিল, মসলিনের পাশাপাশি সিলেটের শিল্পীদের শীতলপাটি। শোনা যায় ভারতবর্ষে এসেছিলেন, এমন বাহাদুরি প্রমাণ হিসেবে ভিনদেশিরা ঢাকার মসলিনের পাশাপাশি সিলেটের শীতলপাটি নিয়ে যেতেন স্মৃতি হিসেবে। বর্তমানেও  প্রবাসী, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা দেশীয় নির্দশন হিসাবে শীতলপাটি উপহার দিয়ে থাকেন ভীনদেশীদের।
প্রচলিত আছে সিলেটের মৌলভীবাজারের,দাসের বাজারের রুপালী বেতের শীতলপাটি সুবে বাংলার নবাব মুর্শিদ কুলী খাঁ, সম্রাট আওরঙ্গজেবকে উপহার দিয়েছিলেন। তখন সম্রাট আওরঙ্গজেব দিল্লির মসনদে। জরুরী প্রয়োজনে সেখানে যেতে হতো মুর্শিদ কুলী খাঁ এর। সম্রাটের সাথে দেখা করতে যাবেন নবাব তাই উপঢৌকন নিয়ে যাওয়া বাঞ্চনীয় কিন্তু নবাব শুনেছেন সম্রাট ভীষণ ধর্মপ্রাণ এবং খুব সাধারণ জীবনে বিশ্বাসী। সম্রাটের সেই জীবনে, বিলাসবহুল জিনিস এর স্থান নেই। একারণে নবাব ভীষণ সঠিক উপহার নিয়ে ভীষণ চিন্তিত, এদিকে যাত্রার দিন পিছিয়ে যায়। তখন অনেক ভেবে চিনতে তিনি সম্রাটের জন্য নিলেন শীতলপাটি। সেই পাটি নবাবের এত পছন্দ হয়েছিলো কথিত আছে তাতে তিনি আমৃত্যু নামাজ পড়েছেন।
পাত্রপক্ষের কাছে মেয়ের গুণকীর্তন করতে গিয়ে বলা হচ্ছে,
“আড় মাছ বানাইতো কন্যা, লয় ছালি-মাটি।
 ইলিশ বানাতো কন্যা, বিছায় শীতল পাটি”।
এই শীতলপাটির ব্যবহার হয় বিয়েতেও। বিশেষত সিলেট অঞ্চলে হিন্দু সম্প্রদায়ের বিয়ে এবং বিভিন্ন  মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানে শীতলপাটির ব্যবহার অনেকটা বাধ্যতামূলক। এছাড়াও বর-কনেকে বিয়ের অনুষ্ঠানে উপঢৌকন হিসেবে  শীতলপাটি দেওয়ার রেওয়াজ রয়েছে। পল্লীকবি জসিম উদ্দীন তার “নকশী কাঁথার মাঠ” কাব্যগ্রন্থে শীতল পাটির বর্ণনা করেছেন-
“আসুক আসুক বেটির দামান কিছু চিন্তা নাইরে,
আমার দরজায় বিছাইয়া থুইছি কামরাঙ্গা পাটি মারে”
গ্রাম এলাকায় এখনো  কনে ‘নাইওর’  (বাবার বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার রীতি) থেকে ফেরার সময় হাতে রঙিন নকশা করা শীতলপাটি নিয়ে ফেরেন। “খাঁটি সোনা” কবিতায় বাংলার ঐতিহ্যর অংশ শীতলপাটিকে বাংলার মাটির সঙ্গে তুলনা করে লিখেছিলেন কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত ।
“চন্দনেরি গন্ধভরা,
শীতল করা, ক্লান্তি-হরা
যেখানে তার অঙ্গ রাখি
সেখানটিতেই শীতল পাটি ”
এই শীতলপাটি বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতি পাওয়া কারুশিল্প।দক্ষিণ কোরিয়ার জেজু দ্বীপে জাতিসংঘের অঙ্গসংস্থা ইউনেসকো ২০১৭ সালের সম্মেলনে সিলেটের শীতলপাটিকে ঘোষণা দেয় বিশ্বের ‘Intangible Cultural Heritage’ হিসেবে।  সিলেটের দুই বিখ্যাত পাটিয়াল গীতেশ চন্দ্র দাশ ও হরেন্দ্র কুমার দাশ ইউনেসকোর দ্বাদশ আন্তর্জাতিক সম্মেলনে শীতলপাটিকে সবার সামনে তুলে ধরেন।
স্বীকৃতির পরেও প্লাস্টিক এর সহজলভ্য পাটির ভিড়ে এই ঐতিহ্যবাহী শীতলপাটির কারিগররা আজ অসহায়। উজাড় হচ্ছে বন, বাড়ছে মুর্তা বেত এর দাম। ন্যায্য মূল্য নাহ পাওয়ায় পাটিয়ালদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নিরুৎসাহিত হচ্ছে এই কারুশিল্পের প্রতি। অথচ পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এই শিল্পকে গ্রামে ব্যবহার্য হিসাবেই শুধু নয়, ব্যবহার করা যায় শহুরে হালের নান্দনিকতায় ও। যে পাটিয়াল কোনোদিন ভারতের তাজমহল কিংবা বাংলাদেশ এর ষাটগম্বুজ মসজিদ সরাসরি  দেখেননি তিনিও তার হাতের অসাধারণ নৈপূণ্যে শীতলপাটিতে ফুটিয়ে তুলতে পারেন এহেন নকশা। শুধু স্বীকৃতিই নয়, এরূপ শিল্প ও শিল্পীর  কদর বোঝার জন্য রয়েছে খুব কম সময়।

তথ্যসূত্র :

১.ধুলিজুরার শীতলপাটি- শিশির কুমার নাথ (প্রতিদিনের বাংলাদেশ)
২.শীতলপাটি নারীর সরব গল্পগাথা- জায়েদুল আলম (দেশ রূপান্তর)
৩.কারুশিল্পী বাতায়ন
৪.ঠান্ডা-যুদ্ধে হেরেই গেল শীতলপাটি-দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়(আনন্দবাজার অনলাইন)
৫.বাংলাদেশের শীতলপাটি এখন বিশ্ব ঐতিহ্যে-প্রথম আলো