বরেন্দ্র ভুমিতে মাহিষ্য বিদ্রোহের বিজয় স্তম্ভ দিব্যক স্তম্ভ
[প্রথম পর্বে কৈবর্ত বা মাহিষ্য বিদ্রোহ সম্পর্কে সামান্য লিখেছি। এই পর্বে আর একটু বিস্তারিত লেখার চেষ্টা করব।কারন আমার গ্রামের ও শহরের বাসা,ও কর্মক্ষেত্রর ২৫/২৭ বছর এই কৈবর্ত জনগোষ্ঠির পরিবেষ্ঠিত জীবন অতিবাহিত করেছি। তখন এদের সম্পর্কে বাংলার ইতিহাস আছে তা আমি বা ওরাও কৈবর্তরা জানে না।কারন আমার বাড়ি ধনজইল খুব বড় গ্রামের ব্রাহ্মন পাড়ায় এক কথায় বামুন পাড়া বলে। এর চারিদিকে দেবনাথ পাড়া (যোগী, মাদুর বোনায়), অপর পাড়া কৈবর্ত মানে মন্ডলেরা থাকে। কৈবর্ত বলে একটু নাক কুচকায়। হাড়িপাড়া পাড়া এরা ডালা কুলা বানায়।অপর পাড়া দাস পাড়া মানে শালা ম্যাটাল বলে গাল পারতো। আবার অপর পাড়া রায় বর্মন মানে ওরা তো কোচ। ৯০ দশকে এসে এসব জাত পাতের নিগ্রহ দেখে তখন মনে মনে খুব ব্যাথা পেতাম। ভাবতাম এই সব বৈশাদৃশ্য কারা কখন কি ভাবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করল যে সমাজে এত নীচু হয়ে মানুষ কে চলতে হয়েছিল বা এখন বলবদ আছে। ব্রিটিশ ভারতের চির স্থায়ী বন্দোবস্ত আগে বা পরে পরেই এই শিষ্টাচার বহির্ভুত মানুষের শ্রেনী বিন্যাস হয়েছিল। আর এক জায়গায় দেখেছি পন্ডিত রজনীকান্ত চক্রবর্তী বলেছিলেন, এমন এক অরজকতার সময় নির্যাতিত হয়ে বহু মানুষ অলি আউলিয়ার কাছে গিয়েছিল শান্তির অন্বেষনে। মাটির খুব কাছে থেকে এই সব অনাচার বা অবহেলা আমি তখন মেনে নিতে পারি নাই।]
কৈবর্ত বিদ্রোহের কারন সমুহঃ
কৈবর্ত বিদ্রোহ ভারত বর্ষের প্রথম সফল জন বিদ্রোহ।এই বিদ্রোহ ২৫-৩০ বছর সল্প সময়ের জন্য হলেও বরেন্দ্র অঞ্চল মাহিষ্য রা নিজ দখলে রেখেছিল।এই বিদ্রোহের সাথে সামন্তদের এক বড় অংশ যুক্ত হয়েছিল। এই সময় পাল বংশীয় রাজা ছিলেন দ্বিতীয় মহীপাল।যাঁর রাজাত্ব কাল ধরা হয় ১০৭৫ -১০৮০ খ্রীঃ।
আর বিদ্রোহের নেতা ছিলেন একজন রাজ কর্মচারী বা সামন্ত মাহিষ্য সম্প্রদায়ের দিব্যক বা দিব্য।তিনি কৈবর্তদের সংঘটিত করে একটি শক্তিশালী বাহিনী হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন।আর অন্যান্য সামন্ত রাও দিব্য কে সহযোগিতা করেছিলেন। কৈবর্ত শব্দটি এসেছে, ‘ক”
(পানি)এবং ‘বর্ত’ ( জীবন যাপন) শব্দ দুটি থেকে। কৈবর্তরা জেলে সম্প্রদায় হওয়ায় স্বাভাবিক ভাবেই তাদের জীবন যাপন ছিল পানি বা জল কেন্দ্রিক। তবে
তাদের মধ্যে অনেক কৃষিজীবিও ছিল।মুল কারন হলো ধর্মীয় ভাবাবেগ।পাল রাজারা ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী।তাঁরা তাঁদের অহিংস নীতিতে বিশ্বাসী এবং
জীব হত্যার বিরোধী ছিলেন। কৈবর্তদের মাছ ধরাই পেশা ছিল। বরেন্দ্র অঞ্চলের বসবাসকারী বেশীর ভাগ
মানুষই মৎসভোজী ছিল। দ্বিতীয় মহীপালের সময় জীব হত্যা কথা তুলে তাদের এই পেশা কে নিরুৎসাহী এবং বাধাগ্রস্ত করা হয়। কিছু ক্ষেতে নেমে আসে কঠোর শাস্তি। এই সব কারনের পাশা পাশি রাজা মহীপাল তাঁর রাজ্যের সুশাসন প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হয়েছিলো। ফলে এ অঞ্চলের মানুষেরা অসন্তোষের বিরুদ্ধে মাথাচারা দিয়ে উঠে বিদ্রোহের ডাক দিয়েছিল। সেই সময় কৈবর্তরা নৌকা চালাতে পারদর্শী ছিল বলে তারা নৌযুদ্ধ প্রাধান্য দিয়েছিল।বাধ্য হয়ে পাল রাজারা পশ্চাৎ পদ হন এবং রাজা দ্বিতীয় মহীপাল নিহত হন। এই যুদ্ধে সামন্ত রা সাহায্য করেছিল এবং প্রজাবৃন্দরা সর্ব সম্মতিতে দিব্যক কে রাজা নির্বাচন করেন। রাজা দিব্য কিছু পরে মারা গেলে তার ভাই রুদোক ও পরে তার পুত্র ভীম রাজ্যর ভার নিয়ে নিষ্ঠার সাথে রাজ্য পরিচালনা করেন।
বিদ্রোহের বিজয় চিহ্ন হিসেবে দিব্যক স্তম্ভঃ
নওগাঁর পত্নীতলা থানার দীবর নামক এক গ্রামে অর্ধ মাইল দীর্ঘ হাজার বছর পুরাতন একটি দীঘি আছে যা
দীবর দীঘি নামে পরিচিত। এই দীঘির মধ্যভাগে প্রায় ৪১
ফুট উচ্চ এবং ১০ ফুট ব্যাস বিশি্ষ্ঠ একটি অষ্টকোণ গ্রানাইট পাথরের স্তম্ভ রয়েছে। এর শীর্ষদেশে লোহার কিছু কিছু কারুকার্যের চিহ্ন দেখা যায়। এই স্তম্ভ মহারাজ দীব্যকের জয়স্তম্ভ।
ভীমের রাজার রাজত্বঃ
রাজা দিব্যকের মৃত্যুর পর দিব্যকের ভাইয়ের ছেলে ভীম রাজ ক্ষমতা হাতে নেন। তিনিও নিষ্ঠার সাথে রাজ কার্য পরিচালনা করেন। নওগাঁ জেলায় বহু মাহিষ্যর বাস ছিল, তারা ভীমের বংশধর হিসেবে দাবী করত। ভীমের রাজত্ব কালে বরেন্দ্রবাসী প্রজাবৃন্দ পরম সুখে কালাতিপাত করত।প্রসিদ্ধ জন নায়ক ভীমের স্মৃতি ও নাম উত্তর বঙ্গের বহু স্থানে পথঘাট ও দুর্গের স্মৃতি বিজরিত।মহাদেবপুরের ধনজইল গ্রামের কয় টা গ্রামের আগে বকাপুর,সিদ্ধিপুর গ্রামে ভীম সাগর নামে একটি প্রকান্ড দীঘি রয়েছে। ঐ দীঘির নিকট দিয়ে একটি প্রশস্ত উচ্চ রাস্তার নিদর্শন দেখা যায়। এটি ভীমের জাঙ্গাল নামে পরিচিত।
এই জাঙ্গাল সিরাজগন্জের কাছ হতে শেরপুরের হয়ে বগুড়া শহরের ভিতর দিয়ে মহাস্থান (পন্ড্রুবর্ধন), কীচক, শালদহ, পত্নীতলা অতিক্রম করে দিনাজপুরের মধ্য দিয়ে রংপুর জেলার ডোমার ষ্টেশনের অভিমুখে গিয়েছে।এই ডোমার ষ্টেশনের নিকট ভীমের রাজধানী ডমনগর অবস্থিত।ভীমের জাঙ্গালের উচ্চতা প্রশস্ততা দেখে বিস্ময়াভিভুত হতে হয়।সম্ভবত রাজা ভীম তাঁর রাজ্যর নিরাপত্তার জন্য প্রতিবেশী কামরুপ রাজ্যর প্রতিরোধকল্পে এই সুদীর্ঘ প্রশস্ত উচ্চ জাঙ্গাল টি নির্মান করেছিলেন। যা দেখে চীনের প্রাচীরের ক্ষুদ্র সংস্করন বলাচলে।জাঙ্গালটি প্রায় ৭০ মাইল হবে সম্ভবত।