প্রাকৃত ভাষার বিকাশ
আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রদত্ত তথ্যানুসারে প্রাকৃত ভাষার উৎপত্তি এবং ক্রমবিকাশকে তিনটি স্তরে ভাগ করা যেতে পারে।
সেগুলির মধ্যে প্রথম স্তরটির আনুমানিক সময় হল— খৃষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দী থেকে শুরু করে খৃষ্টীয় প্রথম শতাব্দী পর্যন্ত। এখনও পর্যন্ত এই স্তরের প্রাকৃত ভাষার প্রধান ঐতিহাসিক নিদর্শন সম্রাট অশোকের বিভিন্ন অনুশাসনগুলিতে, তাঁর সমসাময়িক অন্যান্য শিলালিপিগুলিতে এবং হীনযানী বৌদ্ধদের প্রাচীনতম শাস্ত্রীয়গ্রন্থগুলিতে, অর্থাৎ— পালিভাষায় লিখিত বিভিন্ন প্রাচীন গ্রন্থে পাওয়া গিয়েছে।
দ্বিতীয় স্তরের প্রাকৃতভাষার আনুমানিক সময় হল— খৃষ্টীয় প্রথম শতাব্দী থেকে শুরু করে খৃষ্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দী পর্যন্ত। এই স্তরের ভাষার ঐতিহাসিক পরিচয় উক্ত সময়ের অন্তর্গত প্রথম তিন শতাব্দীর প্রত্নলিপিগুলিতে, সাহিত্যিক প্রাকৃতে এবং বৌদ্ধ-সংস্কৃতের মধ্যে পাওয়া যায়।
তৃতীয় স্তরটির প্রাকৃত ভাষা আগের এবং পরবর্তী নব্য ভারতীয়-আর্য ভাষাগুলির; যথা— বাংলা, হিন্দি, মারাঠি, পাঞ্জাবি ইত্যাদি আদি স্তরের মাঝামাঝি সময়ে দেখতে পাওয়া যায়। গবেষকরা এই স্তরটিকে— অপভ্রংশ —বলে থাকেন। এটির আনুমানিক স্থিতিকাল হল— খৃষ্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দী থেকে খৃষ্টীয় দশম শতাব্দী পর্যন্ত। অতীতে পণ্ডিত গ্রীয়ার্সন জানিয়েছিলেন যে, মধ্যস্তরের, অর্থাৎ— দ্বিতীয় স্তরের প্রাকৃতের শেষ অবস্থাটিই হল অপভ্রংশ। মহাকবি কালিদাসের ‘বিক্রমোর্বশী’ নাটকের কয়েকটি গানে, এবং পরবর্তীকালে— আনুমানিকভাবে খৃষ্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীতে পাঞ্জাবের অধিবাসী মুসলমান কবি আব্দর রহমানের ‘দূত’ কাব্য ‘সংনেহয় রাসক’ গ্রন্থে এই ভাষার ঐতিহাসিক নিদর্শন দেখতে পাওয়া যায়।
একটু আগেই বলা হয়েছে যে, প্রথম স্তরের প্রাকৃত ভাষার, অর্থাৎ— খৃষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দী থেকে খৃষ্টীয় প্রথম শতাব্দীর প্রাকৃত ভাষার প্রধান ঐতিহাসিক নিদর্শন সম্রাট অশোকের অনুশাসনগুলিতে, সমকালীন অন্যান্য শিলালিপিগুলিতে এবং হীনযানী বৌদ্ধদের বিভিন্ন শাস্ত্রীয়গ্রন্থের ভাষার মধ্যে দেখতে পাওয়া যায়। এবারে প্রথম স্তরের প্রাকৃত ভাষার ঐতিহাসিক উদাহরণের দিকে নজর দেওয়া যাক।
এখনও পর্যন্ত সম্রাট অশোকের খৃষ্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীর যে সমস্ত অনুশাসনগুলি পাওয়া গিয়েছে, সেগুলিতে তখনকার প্রাকৃতের চারটি উপভাষার বা ‘dialect’–এর পরিচয় পাওয়া যায়। যেসব অনুশাসনে সেই উপভাষাগুলির নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে সেগুলি নিম্নরূপ—
(১) অশোকের শাহবাজগঢ়ী এবং মানসেহরা অনুশাসন,
(২) গির্ণার অনুশাসন,
(৩) কালসী ও ছোট অনুশাসন,
(৪) ধৌলী ও জৌগড় অনুশাসন।
স্থানানুযায়ী এগুলির নাম যথাক্রমে— উত্তর-পশ্চিমা, দক্ষিণ-পশ্চিমা, প্রাচ্যমধ্যা এবং প্রাচ্যা।
উত্তর-পশ্চিমা উপভাষার শাহবাজগঢ়ী অনুশাসন খরোষ্ঠী লিপিতে লেখা হয়েছিল। গবেষকদের মতে এই লিপিটি বিদেশী, উর্দু যেমন ডানদিক থেকে বাঁদিকে লেখা হয়, এটিও তেমনভাবেই লেখা হয়েছিল; এতে দীর্ঘস্বরের, অর্থাৎ— ঈ, ঊ ইত্যাদির আলাদা কোনো চিহ্ন ছিল না। শাহবাজগঢ়ী অনুশাসনের ভাষার নমুনা এরকম—
“দেবনং প্রিয়ো প্রিয়দ্রশি রয় এবং অহতি জনো উচবুচং মংগলং করোতি অবধে অবহে বিবহে পজুপদনে প্রবসে। এতয়ে অঞয়ে চ এদিশিয়ে জনো বহু মংগলং করোতি।” (নবম অনুশাসন)
অর্থাৎ— দেবদেব প্রিয়দর্শী রাজা একথা বলেছেন— লোকে নানারকম মঙ্গল অনুষ্ঠান করে— আপদে, ছেলের বিয়েতে, মেয়ের বিয়েতে, সন্তানলাভে, প্রবাসগমনে। এইসব এবং এরকম অন্য উপলক্ষ্যে লোকে অনেক মঙ্গল অনুষ্ঠান করে।
দক্ষিণ-পশ্চিমা বা গির্ণার অনুশাসনে ব্যবহৃত উপভাষায় এই একই অনুশাসনটি আবার নিম্নলিখিত রূপ নিয়েছিল বলে দেখতে পাওয়া যায়—
“দেবানং পিয়ো প্রিয়দসি রাজা এবং আহ অস্তি জনো উচবচং মংগলং করোতে আবাধেসু বা আবাহবিবাহেসু বা পুত্রলাভেসু বা প্রবাসম হি বা। এতমহি অঞমহি চ জনো উচাবচং মংগলং করোতে।” (নবম অনুশাসন)
কালসী এবং ছোট অনুশাসনগুলি প্রাচ্যমধ্যা উপভাষার অন্তর্গত। এর ঐতিহাসিক নিদর্শন এরকম—
“দেব্যণং পিয়ে পিয়দসি লাজা হেবং আহা মগেযু পি মে ণিগোহাণি লোপাপিতানি ছায়োপগাণি হোসংতি পশুমুণিষাণাং অংবাবডিককা লোপাপিতা অডঢকোসিককাণি পি মে উদুপাণাণি খাণাপিতানি নিংসিধয়া চ কালাপিতা আপাণাণি মে বহুকাণি তত তত কালাপিতানি পটিভোগায়ে পমুমণিসাণং।” (দিল্লী-তোপরা স্তম্ভলিপির সপ্তম অনুশাসন)
অর্থাৎ— দেবতাদের প্রিয় প্রিয়দর্শী রাজা বলছেন— পশুর ও মানুষের ছায়াপ্রদ হবে বলে আমি পথে ন্যগ্রোধ রোপণ করেছি, আমবাগান বসিয়েছি; আধক্রোশ অন্তর অমি কূপ খনন করিয়েছি, সোপান বাঁধিয়েছি। যেখানে সেখানে আমি পশু ও মানুষের উপকারের জন্য জলছত্র বসিয়েছি।
ধৌলীলিপিকে প্রাচ্যা উপভাষার ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসাবে দেখা যেতে যেতে পারে। এটির নমুনা নিম্নরূপ—
“সবে মুনিসে পজা মমা। অথা পজায়ে ইছামি হকং কিংতি সবেন হিতসুখেন হিদলোকিকপাললোকিকেন যুজেবু তি। তথা সবমুনিসেসু পি ইছামি হকং।”
অর্থাৎ— সব মানুষ আমার প্রজা (সন্তান)। যেমন আমি সন্তানের বিষয়ে এই চাই যে, তাঁরা যেন ইহলৌকিক এবং পারলৌকিক সমস্ত হিতসুখ পায়, তেমনি সব মানুষের বিষয়েও আমি তাই চাই।
এখন দেখা যাক যে, ভৌগোলিক অবস্থানের দিক থেকে শাহবাজগঢ়, গির্ণার, তোপরা, কালসী, ধৌলী ইত্যাদি স্থানগুলি ভারতবর্ষের কোথায় কোথায় অবস্থিত।
শাহবাজগঢ় একটি গ্রামের নাম। বর্তমানে এটি পাকিস্তানে অবস্থিত। অতীতের অবিভক্ত উত্তর-পশ্চিম ভারতের আটক এবং পেশোয়ারের মাঝামাঝি মর্দান নামের যে রেলস্টেশনটি ছিল, সেখান থেকে সাত-আট মাইল উত্তর-পশ্চিমে গেলে শাহবাজগঢ় গ্রামে পৌঁছানো যেত।
বর্তমান পাকিস্তানের অ্যাবটাবাদ থেকে যে রাস্তাটি কাশ্মীরে গিয়েছে, সেই রাস্তার উপরে মানসেহরা শহরটি অবস্থিত।
গুজরাটের জুনাগড় শহরের পূর্বদিকে মাইলখানেক দূরে থাকা প্রাচীন সুদর্শন হ্রদের তীরে অবস্থিত প্রাচীন রৈবতক পাহাড়ের আধুনিক নামই হল গির্ণার। যাঁরা প্রাচীন ভারতীয় পুরাণের কাহিনীগুলির সাথে পরিচিত রয়েছেন, তাঁরা রৈবতক নামটির সঙ্গেও নিশ্চিতভাবে পরিচিত থাকবেন।
কালসী গ্রামটি বর্তমান উত্তরাখণ্ড রাজ্যের মুসৌরী থেকে ষোল মাইল দূরে অবস্থিত।
ধৌলী গ্রামটি উড়িষ্যার ভুবনেশ্বর থেকে মাইল চারেক দূরে দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত। জৌগড়ও উড়িষ্যা রাজ্যের গঞ্জাম জেলার প্রায় সমুদ্রতীরবর্তী গঞ্জাম থেকে আঠারো মাইল উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত।
তোপরা গ্রামটি হরিয়ানা রাজ্যের আম্বালা জেলায় অবস্থিত।
এসব জায়গা ছাড়াও শাহবাদের সাসারাম; জয়পুরের বৈরাট; মহীশূরের সিদ্ধিপুর ও ব্রহ্মগিরি; মাদ্রাজের কুর্নুল, মীরাট ও কৌশাম্বী; বিহারের চম্পারন জেলায়; মধ্যপ্রদেশের জব্বলপুর ও সাঁচী; এবং উত্তরপ্রদেশের সারনাথ ইত্যাদি জায়গায় প্রাকৃত ভাষায় বিভিন্ন প্রাচীন অনুশাসন ও স্তম্ভলিপি পাওয়া গিয়েছে। এমনকি বর্তমান ভারতের বাইরে, নেপালের দু’-এক জায়গাতেও ঐতিহাসিকেরা প্রাকৃত ভাষায় লেখা স্তম্ভলিপির সন্ধান পেয়েছেন।
এখনও পর্যন্ত যে-সমস্ত প্রত্নলিপিতে প্রথমস্তরের প্রাকৃত ভাষার ঐতিহাসিক নমুনা পাওয়া গিয়েছে সেগুলির মধ্যে— রামগড় পাহাড়ের যোগীমারা গুহা থেকে প্রাপ্ত সুতনুকা প্রত্নলিপিটি অন্যতম। ঐতিহাসিকদের মতে এই লিপিটি সম্রাট অশোকের অনুশাসনের সমসাময়িক। পণ্ডিতেরা বলেন যে, মাগধী প্রাকৃতের প্রাচীনতম নিদর্শন হিসাবে এই প্রত্নলিপিটি বিশেষ মূল্যবান। উক্ত লিপিটি নিম্নরূপ—
“শুতনুক নাম দেবদশিককি
তং কময়িথ বলনশেয়ে
দেবদিনে নম লুপদখে।”
অর্থাৎ— সুতনুকা নামের একজন দেবদাসী ছিলেন। তাঁকে বারাণসীবাসী একজন রূপদক্ষ, যাঁর নাম দেবদীন ছিল, তিনি কামনা করেছিলেন।
উড়িষ্যার উদয়গিরি পাহাড়ের হাতিগুম্ফার দরজায় থাকা কলিঙ্গরাজ খারবেলের অনুশাসনটিও ইতিহাসের দিক থেকে অত্যন্ত মূল্যবান। সেটির কিছুটা অংশ নিম্নরূপ—
“কলিঙ্গাধিপতিনা সিরিখারবেলেন পন্দরস বসানি সিরিকড়ারসরীরবতা কীড়িতা কুমারকীড়িকা। ততো লেখরূপগণনা ব্যবহারবিধিবিসারদেন সববিজাবদাতেন নব বসানি যোবরজং পলাসিতং।”
অর্থাৎ— কলিঙ্গ-অধিপতি শ্রীখারবেল পনেরো বছর ধরে শ্রীকড়ার শরীর ধারণ করে বাল্যক্রীড়া করেছিলেন। তারপরে লেখ, রূপ, গণনা, ব্যবহারবিধিবিশারদ এবং সর্ববিদ্যায় পারদর্শী হয়ে নয় বছর ধরে যৌবরাজ্য শাসন করেছিলেন।
সুতনুকা প্রত্নলিপিটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব হল যে, এটির ভাষায় এমন কতগুলি বিশেষত্ব রয়েছে যা সম্রাট অশোকের অনুশাসনে পাওয়া যায় না; যদিও ঐতিহাসিকদের মতে দুটোই একই সময়ের অন্তর্গত। কোন কোন ভাষাতত্ত্ববিদ মনে করেন যে, সুতনুকা প্রত্নলিপির ভাষাই প্রাচীন সাহিত্যে ব্যবহৃত মাগধী প্রাকৃতের আদিরূপ।
খারবেলের অনুশাসন সম্রাট অশোকের সমসাময়িক হলেও এটির ভাষার সঙ্গে কিন্তু প্রাচ্যার খুব একটা মিল দেখতে পাওয়া যায় না; বরং দক্ষিণ-পশ্চিমার সঙ্গেই এটির আত্মীয়তা বেশী বলে দেখা যায়, যদিও ভৌগোলিক দিক থেকে এটির ভাষা প্রাচ্যার প্রভাবান্বিত হওয়াই অধিকতর সম্ভবপর ছিল। পণ্ডিতদের মতে খারবেল অনুশাসনের ভাষাটি হল পালি এবং এটি অশোকের গির্ণার অনুশাসনের সমধর্মী। যদিও এটির ভাষা প্রাচীন সাহিত্যে ব্যবহৃত গদ্যের ছাঁচে ঢালা সাধুভাষা, এবং সেটি তখনকার কথ্যভাষা ছিল কিনা— তা রীতিমত সন্দেহের বিষয়। খারবেল অনুশাসনের ভাষায় সংস্কৃত রচনাভঙ্গীর প্রভাবও দেখতে পাওয়া যায়। এর প্রধান কারণ হল যে, তৎকালীন পণ্ডিতমহলে সংস্কৃতের প্রাধান্য থাকবার দরুন এবং সেটার প্রভাবে সেযুগের জনসাধারণের মধ্যে সংস্কৃত-সংস্কৃতির আধিপত্য থাকবার ফলে— তখন প্রাকৃতে বা পালিতে যা কিছু লেখা হয়েছিল, তাতে লেখকদের জ্ঞাতসারেই হোক বা অজ্ঞাতসারেই হোক— সংস্কৃত সাধু গদ্য বা পদ্য রচনার আংশিক বা সম্পূর্ণ প্রভাব পড়েছিল। তাছাড়া তখনকার ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের কথ্য প্রাকৃতের একটা সর্বজনবোধ্য ‘standard’ রূপ দেওয়ার জন্য সংস্কৃত রচনাভঙ্গীর অনুসরণেরও প্রয়োজনীয়তা সম্ভবতঃ দেখা দিয়েছিল।
পালি ভাষা— প্রথম স্তরের প্রাকৃতের অন্তর্গত। অতীতের দক্ষিণভারতের হীনযানী বৌদ্ধরাই এই ভাষার বেশি চর্চা করেছিলেন।
দ্বিতীয় স্তরের প্রাকৃতভাষার আনুমানিক সময় হল— খৃষ্টীয় প্রথম শতাব্দী থেকে খৃষ্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দী পর্যন্ত। আগেই বলা হয়েছে যে, এই স্তরের ভাষার প্রধান ঐতিহাসিক নিদর্শন— সমসাময়িক প্রত্নলিপিগুলিতে, সাহিত্যে ব্যবহৃত মাগধী, মহারাষ্ট্রী, শৌরসেনী ইত্যাদি ধরণের প্রাকৃতে এবং মহাযানী বৌদ্ধদের বৌদ্ধ-সংস্কৃতে দেখতে পাওয়া যায়। অশ্বঘোষের ‘বুদ্ধচরিত’ গ্রন্থের কোনো কোনো জায়গায় প্রাকৃতের ব্যবহার করা হয়েছিল, এর আগে নাটকের মধ্যেও এই ভাষাটিকে ব্যবহার করা হয়েছিল। দ্বিতীয় স্তরের প্রাকৃতের মধ্যে তৎকালীন প্রাকৃতের তিনটি উপস্তরের পরিচয় পাওয়া যায়। অতীতে মধ্য-এশিয়ার খোটানে খরোষ্ঠী লিপিতে লেখা যে ‘ধম্মপদ’–র সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল, সেটার ভাষাও প্রাকৃত ছিল। ভারতের বাইরে চৈনিক-তুর্কীস্তানের শান্শান্ রাজ্যের সীমান্তে অবস্থিত একটি জায়গার নাম হল— নিয়া। অতীতে সেখানকার বালুকাস্তূপ খুঁড়ে খরোষ্ঠী এবং ব্রাহ্মীলিপিতে লেখা কিছু প্রাচীন প্রত্নলিপি পাওয়া গিয়েছিল; সেগুলির অধিকাংশই ব্যবসাবাণিজ্য, শাসনকার্য ইত্যাদি সংক্রান্ত রিপোর্ট ছিল। সেগুলির মধ্যে একটির নমুনা নিম্নরূপ—
“ল্যিপেয় বিন্নবেতি যথ অত্র খর্খনি স্ত্রি নিখলিতন্তি তহ সুধ এদসস্ত্রি মরিতন্তি অবশিঠি স্ত্রিয় ব মূত্তন্তি। এদ প্রচে তু অপগেয়দে অনদি গিড়েসি ল্যিপেয়স স্ত্রি পতেনস্তবিদব হোঅতি। যহি এদ কিলমূদ্র অত্র এশতি প্রঠ অত্র অনদ প্রোছিদবো।”
অর্থাৎ— ল্যিপেয় জানাচ্ছেন যে, ওখানে ডাইনীতে তিনজন স্ত্রীলোককে ধরে নিয়ে গিয়েছে। (সেই তিনজনের মধ্যে) শুধু তাঁর স্ত্রীকে মেরে ফেলেছে, অবশিষ্টদের ছেড়ে দিয়েছে। এই সম্বন্ধে তুমি অপগেয়ের কাছে উপদেশ পেয়েছ— ল্যিপেয়কে তাঁর স্ত্রীর জন্যে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। যখন এই আজ্ঞাপত্র ওখানে গিয়ে পৌঁছাবে, তখন তুমি ভালো করে খোঁজ করবে।
নিয়া নামক জায়গায় এই প্রাকৃতের নিদর্শন পাওয়া গিয়েছিল বলে, ঐতিহাসিকেরা এটিকে ‘নিয়া-প্রাকৃত’ বলে অবিহিত করেছিলেন।
নাটকে প্রাকৃত ভাষার ব্যবহার সম্বন্ধে প্রাচীনকালের আলঙ্কারিক এবং বৈয়াকরণরা যে নির্দেশগুলি দিয়েছিলেন সেগুলিও এপ্রসঙ্গে কৌতূহলোদ্দীপক ও অবশ্য উল্লেখ্য। ‘সাহিত্য-দর্পণ’ গ্রন্থে বলা হয়েছিল—
“কৃতাত্মা উত্তম পুরুষেরা সংস্কৃত এবং সেরকম যোষিদরা শৌরসেনী ভাষা ব্যবহার করবেন। কিন্তু এই যোষিদদের যে সমস্ত গাথা থাকবে, তাতে কিন্তু মহারাষ্ট্রী প্রযুক্ত করা হবে। এছাড়া যাঁরা রাজাদের অন্তঃপুরচারী তাঁরা মাগধী, এবং চেট রাজপুত্র ও শ্রেষ্ঠী— এঁরা অর্ধ-মাগধী ব্যবহার করবেন। বিদুষক ইত্যাদিদের প্রাচ্য, ধূর্তদের অবন্তিকা, যোধনাগরিকদের দাক্ষিণাত্য, শকার ও শকদের শাকারী, দিব্যদের বালহীকী, দ্রাবিড়দের দ্রাবিড়ী, আভীরদের আভীরী, পুক্কসদের চণ্ডালী, আর কাঠপাতা দিয়ে যাঁরা জীবিকানির্বাহ করেন তাঁদের পক্ষে শাবরী ভাষা প্রশস্ত। সেরকমভাবে অঙ্গারকারাদির পৈশাচি, উত্তম চেটীদের শৌরসেনী, উন্মত্ত ও আতুরদের শৌরসেনী ভাষা প্রয়োগ প্রশস্ত। … ঐশ্বর্যগাবত, দারিদ্র্যযুক্ত ও ভিক্ষুদের ভাষা প্রাকৃত এবং উত্তম পরিব্রাজিকা ব্রহ্মচারিণীদের ভাষা হবে সংস্কৃত। তাছাড়া দেবী, মন্ত্রী ও গণিকাদের সম্বন্ধেও সংস্কৃত ভাষা বিহিত হয়ে থাকে।”
অন্যদিকে ‘প্রাকৃত-চন্দ্রিকা’ গ্রন্থের গ্রন্থকার কৃষ্ণ পণ্ডিতের মতে—
“দেবতারা রাজারা মন্ত্রীরা অমাত্যরা এবং বণিকরা সংস্কৃত ভাষায় কথা বলবেন। কেউ কেউ সংস্কৃতে, কেউ কেউ বা প্রাকৃতে, কেউ কেউ সাধারণ ভাষায় এবং কোনো কোনো লোক ম্লেচ্ছ ভাষায় কথা বলবেন। যাগযজ্ঞাদিতে ম্লেচ্ছ ভাষার ব্যবহার চলবে না এবং স্ত্রী-লোকদেরও প্রাকৃত ভিন্ন অন্যভাষা চলবে না। কুলীন ব্যক্তির সঙ্কীর্ণ ভাষা এবং জ্ঞানহীন ব্যক্তির (অর্থাৎ অশিক্ষিত ব্যক্তির) সংস্কৃত প্রয়োগ করা নিষিদ্ধ। কিন্তু যাঁরা পরিব্রাজক মুনি অথবা ব্রাহ্মণ তাঁদের সংস্কৃত ছাড়া অন্য কোনো ভাষা ব্যবহার করা শাস্ত্রকারদের অভিপ্রায়সিদ্ধ নয়। প্রধান ব্যক্তিরা প্রায়ই সংস্কৃত ভাষা ব্যবহার করবেন, তবে তাঁদের মধ্যে ভাষান্তরের ব্যবহারও কদাচিৎ দেখা যায়। বালক, স্ত্রী, বৃদ্ধ, বৈশ্য ও অপ্সরারা— এঁদের জন্য সংস্কৃত ভাষা একেবারেই নিষিদ্ধ। … রাজা বা ব্রাহ্মণ এঁরা ক্রীড়ার জন্য প্রাকৃত ভাষা প্রয়োগ করতে পারেন।”
আবার প্রাকৃতভাষার প্রয়োগ সম্বন্ধে ভরদ্বাজের মত ছিল—
“গাথা মাত্রই সংস্কৃতে লিখতে হবে। এছাড়া অন্যান্য যাবতীয় ভাষাই নাট্য সম্বন্ধে প্রয়োগ করা যেতে পারে। যাঁরা বালক, স্ত্রী, বৃদ্ধ, ভিক্ষুক, শ্রাবক কিংবা কপট দণ্ডী এবং গ্রহাভিভূত, মত্ত বা ষণ্ডরূপী তাঁরা প্রাকৃত ভাষাই ব্যবহার করবে। নায়িকা বা সখীদের শৌরসেনী, বিদুষকদের প্রাচ্য, ধূর্তদের অবন্তিকা, রাক্ষসদের মাগধী, অন্তঃপুরবাসী চেট, রাজপুত্র ও শ্রেষ্ঠীদের অর্ধ-মাগধী ভাষাই শ্রেয়। শাকার, দিব্যভাষী, যোধ এবং ভারিশ— এঁদের জন্য যথাক্রমে শকারী, বালহীক ও শাবরী ভাষাই প্রশস্ত।”
এই উদ্ধৃতিগুলির অন্য যে দিকটি লক্ষ্যণীয়, সেটা হল যে, এগুলোর মধ্যে তখনকার সামাজিক গঠন, শ্রেণীবিভাগ ও সামাজিক নিয়মের সন্ধানও পাওয়া যায়। মধ্য ভারতীয়-আর্য ভাষার প্রচলনের সময়ে কত জাতি-গোষ্ঠী-কৌম ইত্যাদি ভারতে বাস করতেন, সেসবের একটা তির্যক ইঙ্গিতও উপরোক্ত উদ্ধৃতিগুলির সাহায্যে পাওয়া যায়। এছাড়া তাঁদের মধ্যে কার কতটা সামাজিক অধিকার ছিল সেটারও একটা সংক্ষিপ্ত পরিচয় যেমন এর মাধ্যমে পাওয়া যায়, তেমনি সংস্কৃত ভাষা সম্পর্কে সেকালের পণ্ডিতদের গোঁড়ামি এবং রক্ষণশীলতার ব্যাপারটাও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বস্তুতঃ ওইধরণের দৃষ্টিভঙ্গীই যে পরে সংস্কৃত ভাষার সমাধি রচনা করে দিয়েছিল, একথা বললে খুব অসঙ্গত কিছু বলা হয় না। তাছাড়া এই উদ্ধৃতিগুলি থেকে এটাও দেখা যায় যে, তৎকালীন সমাজে নারীর স্থান অবজ্ঞাত ছিল এবং আগের তুলনায় নারীর অধিকারের ক্ষেত্রও তখন সঙ্কুচিত হয়ে গিয়েছিল।
প্রসঙ্গতঃ একথাও এখানে উল্লেখ্য যে, উপরের উদ্ধৃতিগুলিতে যে— শাকারী, চণ্ডালী, শাবরী —ইত্যাদির উল্লেখ রয়েছে, গবেষকদের মতে সেগুলি আসলে মাগধীরই বিভাষা বা আঞ্চলিক বিশেষত্বযুক্ত রকমফের ছিল। বালহীকী ছিল বালহীক দেশের উপভাষা। পুক্কস, রাক্ষস প্রমুখরা তৎকালীন ভারতের আদিবাসী সম্প্রদায় ছিলেন।
অতীতে প্রাকৃতভাষায় রচিত প্রাচীন ব্যাকরণের মধ্যে— সমন্তভদ্রের ‘প্রাকৃতব্যাকরণ’; হেমচন্দ্রের ‘প্রাকৃতশব্দানুশাসন’; রাম তর্কবাগীশের ‘প্রাকৃতকল্পতরু’ ও ‘প্রাকৃতকৌমুদী’; কাত্যায়নের ‘প্রাকৃত মঞ্জরী’, এবং নবচন্দ্রের ‘প্রাকৃতপ্রবোধ’ —বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আর প্রাকৃতভাষায় রচিত প্রাচীন কাব্যগুলির মধ্যে— মহারাজ সাতবাহন প্রণীত ‘গাহা সতসই’ (গাথা সপ্তশতী); রাজা প্রবরসেনের ‘সেতুবন্ধ’ এবং বাকপতির ‘গৌড়বধ কাব্য’ —ইতিহাসে সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।