পদার্থবিদ্যা

তাপ ও তাপগতিবিদ্যা 

তাপ এক প্রকার শক্তি যা কোন বস্তুর উপর প্রয়োগ করলে বস্তুর উষ্ণতা বৃদ্ধি পায় বা তাপমাত্রার পরিবর্তন ঘটে।

  • S.I. পদ্ধতিতে তাপের একক– জুল (Joule) 
  • C.G.S. পদ্ধতিতে এর একক– ক্যালরি (Calorie)
  • এক ক্যালরি তাপ সম্পূর্ণরূপে যান্ত্রিক শক্তিতে রূপান্তরিত হলে 4.2 জুল কাজ পাওয়া যায়।
    • 1 ক্যালরি = 4.2 জুল
    • 1 জুল = 0.24 ক্যালরি
  • ক্যালরিমিটার দ্বারা তাপ পরিমাপ করা হয়।

তাপের প্রবাহ তাপের পরিমাণের উপর নির্ভর করে না কিন্তু তাপমাত্রার উপর নির্ভর করে।

  • দুটি বস্তুর তাপ এক হলেও এদের তাপমাত্রা ভিন্ন হতে পারে।

তাপমাত্রা হচ্ছে বস্তুর তাপীয় অবস্থা। তাপমাত্রার S.I. একক হচ্ছে – কেলভিন। থার্মোমিটার দ্বারা তাপমাত্রা পরিমাপ করা হয়।

  • যে তাপমাত্রায় কোনো গ্যাসের আয়তন শূন্য হয়ে যায় তাকে পরম শূন্য তাপমাত্রা বলে। একে কেলভিন স্কেলে 0 K ধরা হয় এবং সেলসিয়াস  ফারেনহাইট স্কেলে এর মান যথাক্রমে −273.15∘,−459.67∘F 
  • জলের ত্রৈধ বিন্দু 273.16 Kelvin (K)।

    S.T.P. – Standard Temperature and Pressure

    • 0˚C বা 273 K কে প্রমাণ তাপমাত্রা বলে। 760 মিলিমিটার বা 76 সেন্টিমিটার পারদ চাপকে প্রমাণ চাপ বলে।
    • পারদ একটি তরল ধাতু। ডাক্তারি বা ক্লিনিক্যাল থার্মোমিটারে পারদ ব্যবহার করা হয়।
    • পারদের হিমাঙ্ক -39°C এবং স্ফুটনাঙ্ক 357°C। ক্লিনিক্যাল থার্মোমিটারে 95°F থেকে 110°F পর্যন্ত দাগ কাঁটা থাকে কারণ মানব দেহের তাপমাত্রা 95°F হতে 110°F এর মধ্যে থাকে।
    • সুস্থ দেহের তাপমাত্রা 98.4°F।

    1927 সালে একটি আন্তর্জাতিক তাপমাত্রা স্কেল অনুমোদন করা হয় 

  • তাপ প্রয়োগে কঠিন পদার্থ প্রসারিত হয় এবং তাপ অপসারণে তা সংকুচিত হয়। পদার্থের এই প্রসারণ সবদিকে হয়। তবে সব কঠিন পদার্থের প্রসারণ সমান হয় না। তাপ প্রয়োগে লোহার চেয়ে পিতলের প্রসারণ বেশি হয়। আবার তাপ অপসারণে লোহার চেয়ে পিতল বেশি সংকুচিত হয়।তাপ প্রয়োগে বায়বীয় পদার্থের প্রসারণ সবচেয়ে বেশি হয়, বায়বীয় পদার্থের আন্তঃআণবিক শক্তি সবচেয়ে কম (পরমাণুসমূহের পরস্পরের মধ্যে আকর্ষণ বল তীব্র নয়)।
    • সাধারণ রেল লাইনের দুটি রেলের মাঝে যথেষ্ট ফাঁক রাখা হয় যাতে সূর্যের তাপে বা ট্রেনের চাকার ঘর্ষণের ফলে উৎপন্ন তাপে রেল লাইন প্রসারিত হওয়ার যথেষ্ট জায়গা পায়। কিন্তু বৈদ্যুতিক রেল লাইন বা ট্রাম লাইন বিদ্যুৎ পরিবাহী হিসেবে কাজ করে বলে এদের মাঝে কোনোফাঁক থাকে না, এগুলো নিরবিচ্ছিন্ন থাকে।
    • টেলিফোন ও বিদ্যুৎ লাইনের তারগুলো ঢিলা থাকে তাপমাত্রা হ্রাস পেলে ধাতব তার সংকুচিত হয়।
    • কাঠের চাকায় লোহার বেড় পরানো থাকে কারণ কাঠের চাকায় দৃঢ়ভাবে আটকানোর জন্য উত্তপ্ত অবস্থায় লোহার বেড় লাগানো হয়। লোহার বেড়টিকে গরম করলে এটি প্রসারিত হয়। ফলে এর ব্যাস পায়। উত্তপ্ত অবস্থায় বেড়টিকে চাকার সাথে লাগিয়ে ঠাণ্ডা করা হয়। ফলে বেড়টি সংকুচিত হয়ে চাকার গায়ে দৃঢ়ভাবে লেগে থাকে।
    • তরল পদার্থে তাপ প্রয়োগ করলে শুধু এর আয়তন প্রসারণ হয়। তরলে তাপ প্রয়োগ করা হলে আয়তন বাড়ে এবং তাপ অপসারণে আয়তন কমে।
    • আদর্শ পরিবেশে 4°C তাপমাত্রায় জলের ঘনত্ব সবচেয়ে বেশি থাকে অর্থাৎজল এসময় সবচেয়ে ভারি হয়। তাপমাত্রা 4°C এর কম বা বেশি হলে জল হালকা হয়। এটিই জলের ব্যতিক্রমধর্মী প্রসারণ অর্থাৎ তরল পদার্থের প্রসারণের সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম।

 

পুনঃশিলীভবন (Regelation)

চাপ প্রয়োগের ফলে কঠিন বস্তুর গলে যাওয়া এবং চাপ প্রত্যাহারে আবার এর কঠিন অবস্থা প্রাপ্ত হওয়াকে পুনঃশিলীভবন বলে। পুনঃশিলীভবনের জন্য দুই টুকরো বরফ একসাথে চেপে ধরলে লেগে যায়। চাপ প্রয়োগে টুকরোদ্বয়ের সংযোগস্থলে গলনাঙ্ক 0°C এর নিচে নেমে আসে।

কিন্তু সংযোগস্থলে তাপমাত্রা 0°C থাকায় ঐ জায়গায় বরফ গলে যায়। তখন চাপ অপসারণ করলে সংযোগস্থলের গলনাঙ্ক পুনরায় 0°C এ ফিরে আসে এবং সংযোগস্থলের বরফগলা জল জমাট বেঁধে টুকরো দুটিকে জুড়ে দেয়।

  • শীতের দেশে যখন অত্যধিক শীতে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা 0°C-এ নেমে আসে তখন পাইপের জল বরফে পরিণত হওয়ায় জলের তথা বরফের আয়তন বেড়ে যায় এবং বর্ধিত আয়তনের জন্য পাইপের উপর প্রচণ্ড চাপ পড়ে। ফলে জলের পাইপ ফেটে যায়।
  • দুধের ঘনত্ব জলের ঘনত্ব অপেক্ষা অনেক বেশি।
  • চাপ বেড়ে গেলে ১০০° সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় পানি ফুটে বাষ্পে পরিণত হয় না, বাষ্পে পরিণত হতে আরো বেশি তাপ লাগবে । এমতাবস্থায় জলে যে বস্তু রান্না করা হবে সেটিও বেশি তাপ পাবে ফলে তাড়াতাড়ি রান্না হবে।
  • প্রেসার কুকারে চাপ বৃদ্ধির মাধ্যমে তরলের স্ফুটনাঙ্ক বৃদ্ধি করা হয়। ফলে জল উচ্চমাত্রায় (প্রায় 130°C) ফুটতে শুরু করে। এ উচ্চ তাপমাত্রার কারণে মাছ, মাংস অতি দ্রুত সিদ্ধ হয়। জলের স্ফুটনাঙ্ক স্বাভাবিক চাপে 100°C.
  • ১৬৮৯ সালে ফরাসি বিজ্ঞানী ডেনিস পেপিন প্রেসার কুকার আবিষ্কার করেন।
  • উঁচু পাহাড়ের উপর রান্না করা অসুবিধাজনক।
  • পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ এভারেস্ট পর্বতে জলের স্ফুটনাঙ্ক 70°C
  • পৃথিবীপৃষ্ঠ হতে যত উপরে ওঠা যায় তত বায়ুর চাপ কমতে থাকে।
  • বায়ুতে জলীয় বাষ্পের উপস্থিতিকে বায়ুর আর্দ্রতা বলে। বায়ুর আর্দ্রতা দুই ধরনের – পরম আর্দ্রতা ও আপেক্ষিক আর্দ্রতা।

  • আর্দ্রতা পরিমাপক যন্ত্রের নাম হাইগ্রোমিটার
  • আপেক্ষিক আর্দ্রতা ৯০% মানে সম্পৃক্ত অবস্থায় বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ ৯০%।
  • 0°C তাপমাত্রার জলের চেয়ে 0°C তাপমাত্রার বরফ বেশি ঠাণ্ডা বোধ হয়। 0°C তাপমাত্রায় 1 কেজি জলে তার চেয়ে 3.36×105 জুল তাপ বেশি থাকে।
  • তাপ, বেশি তাপমাত্রাবিশিষ্ট স্থান থেকে কম তাপমাত্রাবিশিষ্ট স্থানের দিকে প্রবাহিত হয়, একে তাপ সঞ্চালন বলে। তাপ তিন পদ্ধতিতে সঞ্চালিত হয়: ১. তাপের পরিবহন ২. তাপের পরিচলন ৩. তাপের বিকিরণ।
  • যে সব পদার্থের মধ্য দিয়ে তাপ সহজে পরিবাহিত হতে পারে, তাদের সুপরিবাহী পদার্থ বলে। যেমন – লোহা, তামা, অ্যালুমিনিয়াম প্রভৃতি।যে সব পদার্থের মধ্য দিয়ে তাপ সহজে পরিবাহিত হতে পারে না, তাদের কুপরিবাহী পদার্থ বলে। যেমন – তুলা, কাচ, পশম প্রভৃতি।
  • ভুসা কয়লা প্রায় ৯৫% এবং কালো প্লাটিনাম প্রায় ৯৪% বিকীর্ণ তাপ শোষণ করে।
  • পদার্থের অণুগুলো স্থান পরিবর্তন না করে শুধু তার স্পন্দনের মাধ্যমে এক অণু থেকে অন্য অণুতে তাপ সঞ্চালনের প্রক্রিয়াকে তাপের পরিবহন বলে। লোহা তাপের সুপরিবাহক। কাঠ তাপের কুপরিবাহক।অ্যালুমিনিয়াম, তামা তাপ সুপরিবাহী পদার্থ।

তাপের পরিচলন

পদার্থের অণুগুলোর চলাচল দ্বারা উষ্ণতর অংশ থেকে শীতলতর অংশে তাপ সঞ্চালিত হওয়ার পদ্ধতি হল তাপের পরিচলন পদ্ধতি। তরল বা বায়বীয় পদার্থে তাপ এ পদ্ধতিতে সঞ্চালিত হয়।

একটি কাচের পাত্রে পানির সাথে কিছু রং মিশিয়ে পাত্রের নিচে তাপ দিলে দেখা যায়, পাত্রের তলা থেকে রঙিন পানির একটি স্রোত উপরের দিকে উঠে যায় এবং পাত্রের দেয়াল বেয়ে একটি স্রোত নিচের দিকে নেমে আসে।

এভাবে উত্তপ্ত অণু উপরের দিকে যায় এবং ঠাণ্ডা অণু নিচে এসে এর স্থান দখল করে। পদার্থের অণুগুলোর স্থান পরিবর্তনের মাধ্যমে তাপ সঞ্চালন করে বলে এ পদ্ধতির নাম তাপের পরিচলন।

  • মরু অঞ্চলে দিনের বেলা গরম আর রাতের বেলা তীব্র শীত অনুভূত হয় ।
  • খড়ের ছাদ যুক্ত ঘর শীতকালে গরম এবং গরমকালে ঠাণ্ডা থাকার কারণ তাপমাত্রা বেশি হলেও তাপ ভেতরে আসতে পারে না বলে ঠাণ্ডা মনে হয়। আবার শীতকালে বাইরের তাপমাত্রা কম হলেও ভেতরের তাপ বাইরে যেতে পারে না বলে ঘর গরম মনে হয়। খড়ের তৈরি ছাদের মাঝে অনেক ফাঁকাস্থান থাকে যাতে বায়ু আবদ্ধ থাকে। খড় ও বায়ু উভয়েই তাপের কুপরিবাহক।
  • কাচের ঘর সব সময় গরম থাকার কারণ কাচ তাপের কুপরিবাহক। কাচের মধ্য দিয়ে ক্ষুদ্র তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের তাপ সহজে যেতে পারে কিন্তু দীর্ঘ তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের বিকীর্ণ তাপ যেতে পারে না।
  • মেঘাচ্ছন্ন আকাশ শিশির জমার পক্ষে উপযোগী না হওয়ার কারণ আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকলে ভূ–পৃষ্ঠ যে তাপ বিকিরণ করে, সেই তাপ মেঘ দ্বারা প্রতিফলিত হয়ে ভূ–পূষ্ঠে ফিরে আসে।

তাপের বিকিরণ

  • জড় মাধ্যম ছাড়া তাড়িত চৌম্বক তরঙ্গের আকারে উষ্ণ বস্তু থেকে শীতল বস্তুতে তাপ সঞ্চালিত হওয়ার পদ্ধতিই তাপের বিকিরণ পদ্ধতি। সূর্য থেকে তাড়িত চৌম্বক তরঙ্গের আকারে বিকিরণ পদ্ধতিতে তাপ পৃথিবীতে আসে।
  • যে যন্ত্র তাপ শক্তিকে যান্ত্রিক শক্তিতে রূপান্তরিত করে তাকে তাপ ইঞ্জিন বলে। পেট্রোল ইঞ্জিন, ডিজেল ইঞ্জিন, গ্যাস ইঞ্জিন তাপীয় ইঞ্জিনের উদাহরণ। তাপীয় ইঞ্জিন দুই ধরণের- অন্তর্দহ ইঞ্জিন ও বহির্দহ ইঞ্জিন।
  •  যে ইঞ্জিনের দহন ক্রিয়া ইঞ্জিনের মূল অংশের বাইরে ঘটে তাকে বহির্দহ ইঞ্জিন বলে। বাষ্পীয় ইঞ্জিন একটি বহির্দহ ইঞ্জিন। এ ইঞ্জিনে মূল ইঞ্জিনের বাইরে পানি ফুটিয়ে বাষ্প তৈরি করা হয় এবং এ বাষ্প শক্তিকে ইঞ্জিন চালানোর কাজে ব্যবহার করা হয়

  • মোটরগাড়ি, লঞ্চ, এরোপ্লেন ইত্যাদিতে পেট্রোল ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয়। পেট্রোল ইঞ্জিনের কারবুরেটর পেট্রোলকে বাষ্পে পরিণত করে।
  • ড. অটো ১৮৮৬ সালে সর্বপ্রথম পেট্রোল ইঞ্জিন আবিষ্কার করেন।পেট্রোল ইঞ্জিন হলো চতুর্ঘাত ইঞ্জিন বলে।
  • কার্বুরেটরের প্রধান কাজ হলো জ্বালানির সাথে বায়ু মিশ্রিত করা।
  • রেডিয়েটর হলো ইঞ্জিনের উত্তাপ কম রাখার যন্ত্র।

স্থিতিস্থাপকতা

  • বস্তুর যে ধর্ম তার উপর প্রযুক্ত বলের ক্রিয়ায় তার আকার বা আয়তন বা উভয়েরই পরিবর্তনের প্রচেষ্টাকে বাধা দেয় এবং প্রযুক্ত বল অপসারণ করলে যে ধর্মের কারণে তার পূর্বের আকার বা আয়তনে ফিরে যেতে চায়, তাকে স্থিতিস্থাপকতা বলে।
  • কোনো একটি বস্তুর একক ক্ষেত্রফলের উপর প্রযুক্ত বলকে পীড়ন বলে। পীড়ন = বল/ক্ষেত্রফল ।
  • বল প্রয়োগে কোন একটি বস্তুর একক মাত্রার যে পরিবর্তন ঘটে তাকে বিকৃতি বলে।
  • ইস্পাত রাবার অপেক্ষা স্থিতিস্থাপক
  • স্থিতিস্থাপকতার ক্রম : হীরক > ইস্পাত > দস্তা > রাবার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *