স্কেলার ও ভেক্টর রাশি (Scalars and Vectors)
আমরা জানি, ভৌত জগতে যা কিছু পরিমাপ করা যায়, তাকে রাশি বলে। বস্তু জগতের সকল রাশিকে দুই ভাগে ভাগ করতে পারি। যথা:
১। অদিক রাশি বা স্কেলার রাশি।
২। দিক রাশি বা ভেক্টর রাশি।
স্কেলার রাশি (Scalar Quantities)
আমরা যদি একটি গাড়ি প্রতি ঘণ্টায় 40km যায়। এই বাক্যটি দ্বারা আমরা গাড়িটির দ্রুতি, অর্থাৎ গাড়িটি কত দ্রুত যায়, তা প্রকাশ করছি। এটি প্রকাশ করতে গাড়িটি কোন দিকে যাচ্ছে তা বলার প্রয়োজন পড়ে না।
যে সকল ভৌত রাশিকে শুধু মান দিয়ে সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ করা যায়, দিক নির্দেশের প্রয়োজন হয় না তাদেরকে স্কেলার রাশি বলে।
স্কেলার রাশির উদাহরণ: দূরত্ব, দ্রুতি।
ভেক্টর রাশি (Vector Quantities)
যখন আমরা বলি একটি গাড়ি প্রতি ঘণ্টায় 40kmh−1 বেগে চলে, তখন পুরো ব্যাপারটিকে বুঝিয়ে বলতে আমাদের একটি দিক ব্যবহারের দরকার পড়ে। অর্থাৎ, গাড়িটি প্রতি ঘণ্টায় কোন দিকে 40km দূরত্ব অতিক্রম করছে, তাও উল্লেখ করতে হয়।
যে সকল ভৌত রাশিকে শুধু মান দিয়ে সম্পূর্ণভাবে প্রকাশ করা যায় না, সাথে দিকও নির্দেশ করার প্রয়োজন হয় তাদেরকে ভেক্টর রাশি বলে।
ভেক্টর রাশির উদাহরণ: সরণ, বেগ, ত্বরণ, বল, তড়িৎ প্রাবল্য ইত্যাদি।
ভেক্টর রাশি A⃗ বা ∣A⃗∣ দিয়ে নির্দেশ করা হয়।
স্কেলার ও ভেক্টর রাশির উদাহরণ (Examples of scalar and vector quantities)
দূরত্ব ও সরণ:
ধরো, তুমি 4m ব্যাসার্ধের একটি বৃত্তাকার পথে 4 বার ঘুরলে এবং যেখান থেকে শুরু করেছিলে সেখানেই থামলে। এরপর তোমাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় তোমার সরণ কতটুকু হয়েছে? তুমি বলবে আমি 100 m অতিক্রম করে ফেলেছি। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, তোমার অতিক্রান্ত দূরত্ব 100 m হলেও সরণ 0। কারণ, কোনো বস্তুর আদি অবস্থান ও শেষ অবস্থানের মধ্যবর্তী নূন্যতম দূরত্ব অর্থাৎ সরলরৈখিক দূরত্বই হচ্ছে সরণের মান এবং সরণের দিক হচ্ছে বস্তুর আদি অবস্থান থেকে শেষ অবস্থানের দিকে। বৃত্তাকার পথে ঘুরে আবার একই অবস্থানে আসলে তোমার আদি ও অন্ত অবস্থান একই।
সরণের মাত্রা হলো দৈর্ঘ্যের মাত্রা। যেহেতু সরণ একটি নির্দিষ্ট দিক বরাবর সংঘটিত হয় তাই সরণ ভেক্টর রাশি।
∴ [s]= L
দ্রুতি (Speed):
ধরা যাক, রিমন 100 মিটার দূরত্ব 50 সেকেন্ডে পার হলো। অন্যদিকে আয়মান একই দূরত্ব 40 সেকেন্ডে পার হলে, কে দ্রুত চলেছে? নিশ্চয় আয়মান।
1 সেকেন্ডে আয়মানের অতিক্রান্ত দূরত্ব 100/40=2.5 মি.
1 সেকেন্ডে রিমনের অতিক্রান্ত দূরত্ব 100/50=2 মি.
যেহেতু আয়মান 1 সেকেন্ডে রিমনের চেয়ে বেশি দূরত্ব অতিক্রম করেছে তাই আয়মান রিমনের চেয়ে দ্রুত চলেছে।
কোনো বস্তুর দ্রুতি নির্ভর করে সময় ও অতিক্রান্ত দূরত্বের উপর। দ্রুতির সংজ্ঞা হিসেবে আমরা বলতে পারি, সময়ের সাথে কোনো বস্তুর অবস্থানের পরিবর্তনের হারকে দ্রুতি বলে।
অতএব, দ্রুতি = সময়/দূরত্ব
বা, v = d/t
দ্রুতি একটি স্কেলার রাশি। দ্রুতির মাত্রা সময়/দূরত্ব এর মাত্রা।
∴[V]=LT=LT−1
দ্রুতির একক মিটার/সেকেন্ড (ms−1)
Note: গাড়ির স্পিডো মিটারের দ্রুতি kmh−1 এ দেয়া থাকে।
গড় দ্রুতি (Average speed):
যদি কোনো গাড়ি ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাওয়ার সময় 7 ঘণ্টায় 350 কি. মি. অতিক্রম করে তবে তার গড় দ্রুতি হচ্ছে 350km7h=50kmh−1। এখানে গড় দ্রুতি বলার কারণ হলো, গাড়ি চলার পথে প্রত্যেক ঘণ্টায় 50 কি. মি. পথ অতিক্রম করেছে এমন কোনো কথা নেই। গাড়িটি কখনো এর চেয়ে আস্তে বা জোরেও যেতে পারে।
গড় দ্রুতি = মোট দূরত্ব/মোট সময়
তাৎক্ষণিক দ্রুতি (Instant speed):
ধরো, তুমি মাশরাফির কোন বলের দ্রুতি কত তা জানতে চাও। এজন্য তোমাকে তাৎক্ষণিক দ্রুতির সাহায্য নিতে হবে।
যে কোনো মূহুর্তের প্রকৃত বা তাৎক্ষণিক দ্রুতি বের করতে হলে আমাদের অতি অল্প সময় ব্যবধানে অতিক্রান্ত দূরত্ব জানতে হবে। তারপর সেই দূরত্বকে সময় দিয়ে ভাগ করে তাৎক্ষণিক দ্রুতি বের করতে হবে।
বেগ (Velocity):
সাধারণ কথাবার্তায় আমরা বেগ ও দ্রুতিকে একই অর্থে ব্যবহার করলেও বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় এ দুটি শব্দের ভিন্নতা রয়েছে। দ্রুতি একটি স্কেলার রাশি, সুতরাং বুঝতেই পারছো এখানে কোন দিকে কোন বস্তুর অবস্থান পরিবর্তন হচ্ছে তার উল্লেখ নেই। কিন্তু বেগের ক্ষেত্রে, কোনো বস্তু নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট দিকে যে দূরত্ব অতিক্রম করে তাই বেগ। যেহেতু এক্ষেত্রে দিকের উল্লেখ রয়েছে, তাই বেগ একটি ভেক্টর রাশি।
যদি কোনো বস্তু t সময়ে নির্দিষ্ট দিকে s দূরত্ব অতিক্রম করে তাহলে বেগ, v = s/t
বেগের মাত্রা ও দ্রুতির মাত্রা একই, তা হলো [LT−1], একক ms−1।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, বস্তুর বেগের মানই তার দ্রুতি। নির্দিষ্ট দিকে বস্তুর দ্রুতিই তার বেগ।
আবার, যদি গতিশীল কোনো বস্তুর বেগের মান ও দিক অপরিবর্তিত থাকে তাহলে সেই বস্তুর বেগকে সুষম বেগ বা সমবেগ বলে। শব্দের বেগ সুষম বেগের উদাহরণ।
Note: 0° c তাপমাত্রায় বায়ুতে শব্দের বেগ প্রতি সেকেন্ডে 332 মিটার।
অসমবেগ (Variable Velocity):
কোনো বস্তু গতিশীল থাকা অবস্থায় যদি তার বেগের মান বা দিক বা উভয়ের পরিবর্তন ঘটে তাহলে বস্তুর সেই বেগকে অসম বেগ বলে। আমাদের চলা-ফেরা, গাড়ির বেগ ইত্যাদি অসম বেগের উদাহরণ।
ত্বরণ ও মন্দন (Acceleration and Deceleration or Retardation):
ধরো, তুমি গাড়িতে করে প্রতিদিন স্কুলে আসো। একদিন তোমার শিক্ষক তোমাকে বললেন, তুমি যে গাড়িতে করে কলেজে আসো সে গাড়ির প্রতি 8 সেকেন্ডে বেগ কত হয় তা খাতায় লিখে আনবে। শিক্ষকের কথা মতো তুমি ড্রাইভারের পাশে বসে প্রতি 8 সেকেন্ডে গাড়ির বেগ লিপিবদ্ধ করলে।
এ সারণি থেকে দেখা গেল, গাড়িটির প্রথম 8 সেকেন্ডেও 4ms−1 বেড়েছে। সুতরাং প্রতি 8 সেকেন্ড ব্যবধানে গাড়িটির বেগের পরিবর্তন হয়েছে 4ms−1। সুতরাং প্রতি সেকেন্ডে গাড়ির বেগের পরিবর্তনের হার = 4ms−18s = 0.5ms−1।
বেগের পরিবর্তনের হার বা একক সময়ে বেগ পরিবর্তনকেই ত্বরণ বলে। যদি সংজ্ঞাটি গুছিয়ে লিখি তবে বলতে পারি,
সরল পথে চলমান বস্তুর সময়ের সাথে বেগ বৃদ্ধির হারকে ত্বরণ বলে।
আর যদি সময়ের সাথে বেগ হ্রাস পায় তাকে মন্দন বলা হয়।
Note: বেগ যদি বৃদ্ধি পায় তবে বেগের পরিবর্তন বেগের দিকে হয়। এক্ষেত্রে ত্বরণ হবে ধনাত্মক। আর বেগ হ্রাস পেলে বেগের পরিবর্তন হয় বেগের বিপরীত দিকে। এক্ষেত্রে ত্বরণ ঋণাত্মক হয় এবং তখন একে মন্দন বলা হয়।
যদি আদি বেগ u এবং t সময় পরে তার শেষ বেগ v হয় তবে,
t সময়ে বেগের পরিবর্তন = v-u
∴ একক সময়ে বেগের পরিবর্তন = v−ut
∴ বেগের পরিবর্তনের হার বা ত্বরণ, a=v−ut
মাত্রা: ত্বরণের মাত্রা বেগ/সময় এর মাত্রা
ত্বরণ=বেগসময়=সরণসময়সময়=সরণসময়2
∴[a]=LT2=LT−2
একক ms−1s বা ms−2। ত্বরণ আবার দু’ রকম হতে পারে। যেমন:
সুষম ত্বরণ:
কোনো বস্তুর বেগ যদি নির্দিষ্ট দিকে বা নির্দিষ্ট হারে বাড়তে থাকে তাহলে সে ত্বরণকে সুষম ত্বরণ বলে। যেমন: অভিকর্ষের প্রভাবে মুক্তভাবে পড়ন্ত বস্তুর ত্বরণ যা 9.8 ms−2।
অসম ত্বরণ:
যদি সময়ের সাথে বেগ বৃদ্ধির হার সমান না হয় তবে তাকে অসম ত্বরণ বলে। যেমন: সাইকেল, রিকশা, বাসের ত্বরণ।
পড়ন্ত বস্তুর গতি:
এ মহাবিশ্বের প্রতিটি বস্তু কণাই একে অপরকে আকর্ষণ করে। এই মহাবিশ্বের যে কোনো দুই বস্তুর মধ্যে যে আকর্ষণ তাই মহাকর্ষ। আর কোনো বস্তুর উপর পৃথিবীর আকর্ষণকে অভিকর্ষ বলে। যেমন ধরো, চাঁদ ও পৃথিবীর মধ্যে যে আকর্ষণ বল তা অভিকর্ষ। আবার, চাঁদ ও সূর্যের আকর্ষণ বল মহাকর্ষ।
অভিকর্ষজ ত্বরণ:
অভিকর্ষ বলের প্রভাবে ভূ-পৃষ্ঠে পড়ন্ত কোনো বস্তুর বেগ বৃদ্ধির হারকে অভিকর্ষজ ত্বরণ বলে। অভিকর্ষজ ত্বরণকে g দ্বারা প্রকাশ করা হয়।
অভিকর্ষ ত্বরণের মাত্রা [LT−2] এবং একক ms−2
ভূ-পৃষ্ঠের যেকোনো স্থানে g এর মানের রাশিমালা, g=GMR2
M = পৃথিবীর ভর
G = মহাকর্ষীয় ধ্রুবক
R = পৃথিবীর ব্যাসার্ধ
Note: মেরু অঞ্চলে পৃথিবীর ব্যাসার্ধ R এর মান সবচেয়ে কম, তাই g এর মান সবচেয়ে বেশি।
বিষুবীয় অঞ্চলে R এর মান সবচেয়ে বেশি, তাই g এর মান সবচেয়ে কম।
45° অক্ষাংশে সমুদ্র সমতলে g এর মানকে আদর্শ ধরা হয় এবং তা হলো 9.80665 ms−2 বা 9.81 ms−2
বাসার ছাদ হতে একটি পাথর ও এক টুকরো কাগজ যদি একসাথে ফেলা হয় কোনটি আগে মাটিতে পৌঁছাবে? অবশ্যই পাথরটি আগে পৌঁছাবে। যেহেতু অভিকর্ষজ ত্বরণ বস্তুর ভরের উপর নির্ভর করে না, তাই দুটি বস্তু একই সময়ে মাটিতে পৌঁছানোর কথা। আসলে বাতাসের বাধার জন্য তারা ভিন্ন ভিন্ন সময়ে পৌঁছায়। বাতাসের বাধা না থাকলে তারা অবশ্যই একই সময়ে মাটিতে পৌঁছাত।
পড়ন্ত বস্তুর সূত্রাবলি (Laws of falling bodies)
পড়ন্ত বস্তু সম্পর্কে গ্যালেলিও তিনটি সূত্র বের করেন। সূত্র তিনটি হলো:
পড়ন্ত বস্তুর প্রথম সূত্র (First law of Falling Bodies):
স্থির অবস্থান ও একই উচ্চতা থেকে বিনা বাধায় পড়ন্ত সকল বস্তু সমান সময়ে সমান পথ অতিক্রম করে।
পড়ন্ত বস্তুর দ্বিতীয় সূত্র (Second Law of Falling Bodies):
স্থির অবস্থান থেকে বিনা বাধায় পড়ন্ত বস্তুর নির্দিষ্ট সময়ে (t) প্রান্ত বেগ (v) ঐ সময়ের সমানুপাতিক। অর্থাৎ, v∝t
পড়ন্ত বস্তুর তৃতীয় সূত্র (Third law of Falling Bodies):
স্থির অবস্থান থেকে বিনা বাধায় পড়ন্ত বস্তু নির্দিষ্ট সময়ে যে দূরত্ব অতিক্রম করে তা ঐ সময়ের বর্গের সমানুপাতিক। অর্থাৎ h∝t2
সূত্র পরিচিতি
সূত্র | প্রতিক পরিচিতি | একক |
v=u+at | v = শেষ বেগ | ms−1 |
u = আদিবেগ | ||
a = ত্বরণ | ms−2 | |
t = সময় | s | |
v2=u2+2as | v = শেষ বেগ | ms−1 |
u = আদিবেগ | ||
a = ত্বরণ | ms−2 | |
s = দূরত্ব | m | |
S=ut+12at2 | u = আদিবেগ | ms−1 |
v = শেষবেগ | ms−1 |