চর্যাপদ:সম্যক ধারণা

চর্যাপদ:সম্যক ধারণা

চর্যাপদ:সম্যক ধারণা-

১৯০৭ খৃষ্টাব্দে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী আবিষ্কারের ঘটনা ঘটে গিয়েছিল। সেই বছরই মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপালের রাজদরবার থেকে একটি প্রাচীন পুঁথি সংগ্রহ করে বাংলায় নিয়ে এসেছিলেন। এরপরে ওই ঘটনার দশ বছর পরে, অর্থাৎ— ১৯১৭ খৃষ্টাব্দে তিনি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে— ‘বৌদ্ধগান ও দোহা’ —নাম দিয়ে সেই প্রাচীন পুঁথির বিষয়বস্তুগুলি নিজের সম্পাদনায় ছাপার অক্ষরে প্রকাশ করেছিলেন। ‘বৌদ্ধগান ও দোহা’ নামের তাঁর সেই সংগ্রহ গ্রন্থটিতে দুটি বিষয় নিয়ে তথ্য ছিল। সেগুলোর মধ্যে প্রথমটি ছিল বৌদ্ধ ধর্মসম্বন্ধীর বিধিনিষেধ-বিষয়ক কিছু গান, এবং অন্যগুলি ছিল বৌদ্ধ দোহা।

সেইসব ধর্মসম্বন্ধীয় বিধিনিষেধগুলির নাম ছিল— ‘চর্যাচর্যবিনিশ্চয়’; অর্থাৎ— বৌদ্ধ ধর্মসাধনার ব্যাপারে কোনগুলি আচরণীয় এবং কোনগুলি অনাচরণীয়— সেগুলিতে সেসবেরই নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। আর দোহাগুলির রচয়িতা ছিলেন— সরোজবজ্র এবং কৃষ্ণাচার্য। উক্ত চর্যাচর্যবিনিশ্চয় বা চর্যাপদ এবং বৌদ্ধ ধর্মাচার্য সরোজবজ্র ও কৃষ্ণাচার্য রচিত দোহাগুলি একসঙ্গে একই গ্রন্থের অন্তর্গত করা হয়েছিল বলে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থটির নাম— ‘বৌদ্ধগান ও দোহা’ —দিয়েছিলেন।

চর্যাচর্যবিনিশ্চয়ের সংস্কৃত টীকাও পরে নেপালেই পাওয়া গিয়েছিল এবং সেই আবিষ্কারের কিছুদিন পরে ডঃ প্রবোধচন্দ্র বাগচী চর্যাপদগুলির একটি তিব্বতী অনুবাদও সেখানে আবিষ্কার করেছিলেন। এইভাবে চর্যাপদগুলির সংস্কৃত টীকা ও তিব্বতী অনুবাদ আবিষ্কৃত হওয়ার পরে সেগুলির ঐতিহাসিক মূল্য এবং প্রামাণিকতাও নিঃসংশয়ে অনেক পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়ে গিয়েছিল। মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপাল থেকে চর্যাপদের যে প্রাচীন পুঁথিটি সংগ্রহ করে এনেছিলেন, তাতে মোট অখণ্ডিত পদের সংখ্যা ছিল— ছেচল্লিশটি, এবং একটি খণ্ডিত পদ মিলিয়ে সমগ্র পুঁথিটিতে মোট পদের সংখ্যা ছিল— সাড়ে ছেচল্লিশটি। অন্যদিকে প্রবোধচন্দ্র বাগচী চর্যাপদের যে তিব্বতী অনুবাদটি আবিষ্কার করেছিলেন, তাতে মোট পদের সংখ্যা ছিল— একান্নটি। এই কারণেই অনেকে মনে করে থাকেন যে, প্রথমদিকে চর্যাপদের মোট পদের সংখ্যা হয়ত একান্নটিই ছিল, কিন্তু পরে হয়ত কোনো কারণে সেসবের কিছু নষ্ট হয়ে গিয়েছিল।

পরবর্তীকালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডঃ শশিভূষণ দাশগুপ্ত নেপাল থেকেই চর্যাপদের একশোটি নতুন পদ আবিষ্কার ও সংগ্রহ করে বাংলায় নিয়ে এসেছিলেন। তৎকালীন লণ্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডঃ আর্নল্ড বাকের কাছ থেকে তিনি সেই চর্যাগুলির সন্ধান পেয়েছিলেন। এর আগে তিনি ডঃ বাকের নিজস্ব সংগ্রহ থেকে কুড়িটি চর্যাপদ একটি টেপ রেকর্ডারে রেকর্ড করে নিয়ে এসেছিলেন। এই প্রসঙ্গে ১৯৬৩ সালের ২৫শে মার্চ তারিখে ডঃ বিজনবিহারী ভট্টাচার্যকে ডঃ শশিভূষণ দাশগুপ্ত প্যারিস থেকে একটি লিখিত পত্রে জানিয়েছিলেন—
“একটি অত্যন্ত শুভ সংবাদ আছে। নেপালে মুখে মুখে বজ্রাচার্যগণ এখনও চর্যাসংগীত গান করেন। এ জাতীয় প্রায় কুড়িটি সংগীত লণ্ডন হইতে যোগাড় করিয়াছি। স্থানে স্থানে চর্যাগুলির সঙ্গে পঙক্তিতে পঙক্তিতে মিলিয়া যায়। একই ভাব ও ভাষা। গানগুলিও সংগ্রহ করিয়াছি এবং সবগুলিই টেপরেকর্ড করিয়া আনিয়াছি।”

এই সংবাদটি কলকাতায় পৌঁছানোর পরে ইতিহাস অনুসন্ধিৎসু মানুষের মধ্যে ও তৎকালীন পত্র-পত্রিকা মহলে কিঞ্চিৎ উত্তেজনা এবং আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছিল। ডঃ দাশগুপ্ত দেশে ফিরে আসবার পরে ১৯৬৩ সালের ৭ই সেপ্টেম্বর তারিখে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ মন্দিরে সেই চর্যাগুলি নিয়ে কিছু আলোচনা করেছিলেন। তারপরে নেপালে ডঃ দাশগুপ্ত যেসব পদের সন্ধান পেয়েছিলেন, সেগুলির আনুমানিক সংখ্যা ছিল আড়াইশোটি। সেগুলির মধ্যে থেকে বাছাই করে তিনি একশোটি চর্যাপদ বাংলায় নিয়ে আসলেও সেগুলি কখনো মুদ্রিত আকারে প্রকাশিত হয়নি। তবে ডঃ দাশগুপ্তের সেই সংগ্রহ সম্পর্কে তখনকার বিভিন্ন সংবাদপত্রে সেসব সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল, সেগুলি থেকে জানা যায় যে— যেসব পুঁথিগুলি থেকে ডঃ শশিভূষণ দাশগুপ্ত ওইসব চর্যাগীতি সংগ্রহ করেছিলেন, সেগুলির অধিকাংশই বিকৃত ছিল; এবং বহু পাঠান্তর মিলিয়ে তিনি সেগুলির মোটামুটি একটা পাঠনির্ণয় করেছিলেন।

সেইসব পুঁথির বহু জায়গায় ‘ত’ এবং ‘ট’ বর্গের সাথে ‘র’ এবং ‘ল’ বর্গের স্থানচ্যুতি ঘটেছিল। তাঁর সংগৃহিত একশোটি পদকে তিনি তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করেছিলেন। সেগুলির মধ্যে প্রথম পর্যায়ে ছিল ১৯টি গান, যেগুলি ইতিপূর্বে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী সংগৃহীত প্রাচীন পদগুলির সমধর্মী ছিল। দ্বিতীয় পর্যায়ে তিনি ৪৫টি গানকে রেখেছিলেন, এবং তাঁর মতে সেগুলি খৃষ্টীয় দ্বাদশ শতাব্দী থেকে ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যে রচিত হয়েছিল। তবে ওই ৪৫টি গানের ক্ষেত্রে তিনি নিশ্চিত হতে পারেননি যে, সেগুলি কোন অঞ্চলে রচিত হয়েছিল। বাকি ৩৬টি গানকে তিনি আরও পরবর্তীকালের রচনা বলে মনে করেছিলেন, এবং তাঁর মতে সেগুলি নেপালেই রচিত হয়েছিল। ওই ৩৬টি গানে বহু সংস্কৃত শব্দ ব্যবহৃত হয়েছিল এবং সেগুলিতে নানা দেবদেবীর বর্ণনা ব্যক্ত করা হয়েছিল।

ওই চর্যাপদগুলি সম্পর্কে অতীতে ডঃ দাশগুপ্ত আরও যেসব তথ্য দিয়েছিলেন, সেসব থেকে জানা যায় যে, নেপালের বজ্রাচার্যরা তখনও নৃত্যগীত সহযোগে সেই গানগুলি নিবেদন করতেন। মূলতঃ তাঁদের নাচগানের সময়ে ওই পুঁথিগুলি ব্যবহার করা হত এবং ব্যবহার করতে গিয়ে পুঁথিগুলি নষ্ট হয়ে গেলে সেগুলিকে আবার নকল করে নেওয়া হয়। ওই নকল করবার সময়েই মূল পুঁথির পাঠ বিকৃত বা পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিল; কারণ— যাঁরা সেই নকল করবার কাজটি করেছিলেন, তাঁরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ওই গানগুলির বিষয়গত অর্থ সম্বন্ধে অজ্ঞ ছিলেন। সেই পুঁথিগুলি তুলট কাগজে নেপালি অক্ষরে লিখিত হলেও সেই লিপির ঢং অনেক ক্ষেত্রেই দেবনাগরী অক্ষরের মতোই ছিল। ডঃ দাশগুপ্ত ভাষার দিক দিয়ে কয়েকটি চর্যায় পরবর্তীকালের ব্রজবুলি ভাষার বিশেষত্ব দেখতে পেয়েছিলেন।

এই প্রসঙ্গে তিনি জানিয়েছিলেন—
“এই শ্রেণীর পদে সর্বত্রই কোমল ও মধুর শব্দ ব্যবহৃত হইয়াছে। এই পদগুলির ভাষা, শব্দচয়ন ও বিন্যাস এবং ছন্দ-কৌশল বিশেষভাবে লক্ষণীয়।”
ডঃ দাশগুপ্ত সেই পদগুলির মধ্যে ‘বাচ্ছলী’ নামের একজন দেবীর উল্লেখ একাধিকবার দেখতে পেয়েছিলেন। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যেও ‘বাসলী’ দেবীর উল্লেখ পাওয়া যায়। পণ্ডিতদের মধ্যে কেউ কেউ— ‘বাসলী’ —শব্দটি ‘বিশালাক্ষী’ থেকে এসেছে বলে জানালেও, অন্যমতে সেটি— ‘বজ্রেশ্বরী’ —শব্দ থেকে এসেছে। ডঃ দাশগুপ্তের অনুমান করেছিলেন যে— বাচ্ছলী —শব্দটি ‘বৎসলা’ শব্দ থেকে এসেছে। কিন্তু ডঃ দাশগুপ্তর সংগ্রহ করা চর্যাগুলি যেহেতু মুদ্রিত আকারে প্রকাশিত হয়নি, তাই সেগুলি নিয়ে এর থেকে বেশি কিছু বলা সম্ভব নয়। এবারে দেখা যাক যে, এখনও পর্যন্ত যেসব চর্যাপদ পাওয়া গিয়েছে, সেগুলির সাধারণ পরিচয় কি।

গবেষকদের মতে চর্যাপদগুলি ধর্মাচরণের বিধিনিষেধ সংক্রান্ত বিষয়ের উপরে রচিত হলেও সেগুলি মূলতঃ গান এবং কাব্যাকারেই লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। সুতরাং ধর্মসাধকদের কাছেও ধর্মগ্রন্থ হিসাবে সেগুলির অন্য মূল্য থাকলেও গীতিরসপিপাসু কাব্য পাঠক-পাঠিকাদের কাছেও সেগুলির অন্য সার্থকতা এবং প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। অতীতের ধর্মাচরকরা এই চর্যাপদগুলির মধ্যে বিধৃত ধর্মোপদেশ বা ধর্মচর্চার ক্ষেত্রে কি কি আচরণীয় এবং কোনগুলিই বা অনাচরণীয়— সে সম্বন্ধে কতটা নির্দেশ পেয়েছিলেন বা শুদ্ধ চিত্তে সেইসব নির্দেশ পালন করে কতটুকু লাভবান হয়েছিলেন, বর্তমানে সেবিষয়ে কিছু জানবার কোন উপায় নেই। কিন্তু কাব্য পাঠক-পাঠিকা হিসাবে অতীতে যাঁরা চর্যাপদের রস আস্বাদন করতে চেয়েছিলেন এবং তাঁরা কেউই এটির কাব্যমূল্যকে অস্বীকার করেননি। আজও তাই একটা ধর্মগ্রন্থ হিসেবে নয়, বরং কাব্যগ্রন্থ হিসেবেই সাধারণ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে চর্যাপদ প্রথম এবং প্রধান আকর্ষণ।

চর্যাপদের মধ্যে থাকা কবিতাগুলি আসলে পদ্যাকারে গ্রথিত গান, সেই কারণেই চর্যাপদের অপর নাম হল— চর্যাগান বা চর্যাগীতি। কোন একজন কবি যেমন সেই পদগুলি রচনা করেননি, তেমনি সেগুলি এক সুর এবং তালে গেয় নয়। এখনও পর্যন্ত চর্যাগীতি সংগ্রহের মধ্যে যে সমস্ত পদকর্তার পদ সংকলিত হয়েছে, অতীতে তাঁরা সকলেই সিদ্ধাচার্য ছিলেন। এখনও পর্যন্ত মোট ২৩ জন সিদ্ধাচার্যের রচিত এক বা একাধিক পদাবলী নিয়েই চর্যাপদের সংকলন গঠিত হয়েছে। সেই তেইশ জন সিদ্ধাচার্যের নাম ও তাঁদের রচিত গানের তালিকাটা এরকম—
কাহ্নপাদ বা কৃষ্ণাচার্য ১৩টি; ভুসুকুপাদ ৮টি; সরহপাদ ৪টি; কুক্কুরীপাদ ৩টি; লুইপাদ, শবরপাদ ও শান্তিপাদ প্রত্যেকে ২টি করে; এবং আর্যদেব, কঙ্কনপাদ, কম্বলাম্বর, গুণ্ডরী বা গুড্ডরীপাদ, চাটিলপাদ, জয়নন্দী, ডোম্বীপাদ, ডেন্টণপাদ, তন্ত্রীপাদ, তাড়কপাদ, দারিকপাদ, ধামপাদ, গুঞ্জরীপাদ, বিরুবাপাদ, বীনাপাদ, ভদ্রপাদ, মহীধরপাদ— এঁদের প্রত্যেকের একটি করে।

চর্যাপদ-রচয়িতা সিদ্ধাচার্যদের সকলের জীবন ও জীবনী সম্বন্ধে এখনও পর্যন্ত সঠিক ঐতিহাসিক তথ্য পাওয়া যায় নি। তবে পণ্ডিতেরা সিদ্ধান্ত করেছেন যে, এই সিদ্ধাচার্যরা সকলেই চুরাশী সিদ্ধাচার্যদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। আবার পদকর্তাদের নামের মিল দেখে তাঁরা যে সবাই চুরাশী সিদ্ধাচার্যদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন— একথাও জোর দিয়ে বলা সম্ভব নয়। তবে— শান্তিপাদ, শান্তিদেব ও শান্তদেব —তিনজন ভিন্ন ব্যক্তি ছিলেন; এঁরা তিনজনেই সিদ্ধাচার্য ছিলেন। তাঁদের মধ্যে শান্তিপাদ রত্নাকর-শান্তি ছিলেন, তিনি ১৮টি তান্ত্রিক গ্রন্থ এবং ‘সুখদুঃখদ্বয়-পরিত্যাগ দৃষ্টি’ নামের অন্য একটি গ্রন্থও রচনা করেছিলেন বলে জানা যায়। বৌদ্ধ তারানাথের মতে তিনি মগধের বাসিন্দা ও বিক্রমশিলা বিহারের আচার্য ছিলেন এবং সিংহলে কিছুদিন ধরে ধর্মপ্রচারকের কাজ করেছিলেন। অন্যদের মতে— ভুসুকুপাদ ও শান্তিপাদ আসলে একই ব্যক্তি ছিলেন। সরহপাদের জন্ম সম্বন্ধে কিংবদন্তী ছিল যে, তিনি ব্রাহ্মণের ঔরসে একজন ডাকিনীর গর্ভে প্রাচ্যদেশের রক্তী নামক শহরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। কুক্কুরীপাদ তাঁর প্রথম জীবনে ব্রাহ্মণ থাকলেও পরে বৌদ্ধ হয়েছিলেন।

কম্বলপাদ, কাহ্নপাদ প্রমুখের জীবন সম্বন্ধে ইতিহাস থেকে বিশেষ কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। তবে সিদ্ধাচার্য শবরপাদ সম্বন্ধে গবেষকরা অনুমান করেন যে, তিনি জাতিতে শবর ছিলেন। তাঁর পদে সেযুগের শবর-জীবনের বর্ণনা থাকবার জন্যই এইধরণের অনুমান করা হয়ে থাকে। লুইপাদ দ্বারিকপাদের শিষ্য ছিলেন। আর জয়নন্দী, বীনাপাদ, চাটিলপাদ প্রমুখের সঠিক পরিচয় সম্বন্ধে গবেষকরা এখনও অবগত নন। তবে এসব সিদ্ধাচার্যের সম্বন্ধে সাধারণভাবে যেকথা বলা যেতে পারে, সেটা হল যে— তাঁরা সকলেই পণ্ডিত এবং শাস্ত্রজ্ঞ ছিলেন। তাঁরা সকলেই বজ্রযান, সহজযান, কালচক্রযান ইত্যাদি বৌদ্ধ সাধন-পদ্ধতির সঙ্গে অত্যন্ত ঘনিষ্টভাবে পরিচিত ছিলেন। সাধারণভাবে খৃষ্টীয় অষ্টম থেকে দশম শতাব্দীর মধ্যে তাঁদের জন্ম হয়েছিল বলে অনুমান করা হয়ে থাকে।

অতীতে মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী সিদ্ধান্ত করেছিলেন যে, চর্যাপদগুলি আসলে বৌদ্ধ সহজিয়া মতের বাংলা গান। তাঁর সেই মতের সমর্থন করে পরবর্তীসময়ে অধ্যাপক মণীন্দ্রমোহন বসুও জানিয়েছিলেন যে— চর্যাপদের ৩, ৯, ১৯, ২৮, ৩০, ৩৭, ৩৯, ৪২, ৪৩ সংখ্যক গানগুলিতে সহজযানী বৌদ্ধ মতের উল্লেখ পাওয়া যায়। এছাড়া অধ্যাপক বসু এই অভিমতও প্রকাশ করেছিলেন যে, অনেকগুলি চর্যাতে মহাযানী বৌদ্ধ মতেরও প্রত্যক্ষ আলোচনা রয়েছে। একটু আগেই বলা হয়েছে যে, চর্যাচর্যবিনিশ্চয় কোন একজন কবির লেখা কাব্যসঙ্কলন নয়। তাতে মোট তেইশ জন সিদ্ধাচার্যের রচনা একত্রে গ্রথিত রয়েছে; সেই সিদ্ধাচার্যরা সকলে বৌদ্ধধর্মের অনুসারী হলেও বৌদ্ধধর্মের নানা শাখা-প্রশাখা এবং নানা মত ও যানের সাধক ছিলেন। তাঁদের মধ্যে কোন কোন সিদ্ধাচার্য যেহেতু মহাযান, হীনযান, সহজযান, বজ্রযান ইত্যাদি নানা যান এবং তন্ত্রের সাধনা করেছিলেন— সেহেতু সহজিয়া মত, তান্ত্রিক মত, বিভিন্ন যৌগিক সাধনার চর্যাও চর্যাপদের সংগ্রহ-গ্রন্থে সঙ্কলিত হয়েছে বলে দেখতে পাওয়া যায়। বৌদ্ধ ধর্মের নানা অভিব্যক্তির পরিচয় চর্যাপদের মধ্যে ছড়ানো রয়েছে বলে, প্রাচীন ভারতের ধর্মবিষয়ে যাঁরা গবেষণাকারী— তাঁদের কাছেও চর্যাপদের ঐতিহাসিক মূল্য অপরিসীম।

এই প্রসঙ্গে এখানে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত চর্যাপদগুলি প্রকাশিত হওয়ার পরে সেগুলির ঐতিহাসিক প্রামাণিকতা, ভাষাতত্ত্বঘটিত বিশেষত্ব, বিষয়গত অর্থের গুরুত্ব ইত্যাদি নিয়ে যেসব আলোচনা অতীতের বিভিন্ন গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছিল, সেগুলিকে তালিকাবদ্ধ করা যেতে পারে। অতীতের গবেষকদের মধ্যে সর্বপ্রথম বিজয়চন্দ্র মজুমদার ১৯২০ সালে তাঁর ‘History of the Bengali Language’ গ্রন্থে চর্যাপদের ভাষা নিয়ে ইতিহাসগত আলোচনার সূত্রপাত করেছিলেন। এরপরে ১৯২৬ সালে ডঃ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় চর্যাগীতিগুলির ভাষাতাত্ত্বিক স্বরূপ বিশ্লেষণ করে সেগুলি যে আসলে বাংলা ভাষারই আদিরূপ— সেকথা নিঃসংশয়ে প্রমাণ করে দিয়েছিলেন। এর পরের বছরই, অর্থাৎ— ১৯২৭ সালে ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহর লেখা— ‘Les Chants Mystiques de Kanha et de Saraha’ —নামক গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছিল; তাতে তিনি চর্যাপদের ধর্মতত্ত্ব নিয়ে সর্বপ্রথম আলোচনার সূত্রপাত করেছিলেন। এরপরে ১৯৪৬ সালে ডঃ শশিভূষণ দাশগুপ্ত লিখিত— ‘Obscure Religious Cults and Background of Bengali Literature’ —নামক গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছিল। উক্ত গ্রন্থে তিনি সহজযান প্রসঙ্গে চর্যাপদের অন্তর্নিহিত তত্ত্বের ব্যাখ্যা করেছিলেন। এর আগে ডঃ প্রবোধচন্দ্র বাগচী কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২৮খণ্ডে প্রকাশিত— ‘Journal of the Department of Letters’ নামক রচনাবলীতে ‘দোহাকোষ’ প্রকাশ করে চর্যাপদের কয়েকজন কবি ও দোহাকোষের পরিচয় দিয়েছিলেন।

১৯৩৮ সালে তিনি উক্ত জার্নালের ৩০তম খণ্ডে— ‘Materials for Critical Edition of the Old Bengali Charyapada’ —সংকলনে বাংলা অক্ষরে সংগৃহীত চর্যাপদ, সেগুলির সংস্কৃত অনুবাদ এবং তিব্বতী অনুবাদের উল্লেখ করেছিলেন। অতীতের পণ্ডিতদের মধ্যে রাহুল সংকৃত্যায়নও চর্যাপদ বিষয়ে বিশেষ গবেষণা করেছিলেন এবং তিনি তাঁর বহু প্রবন্ধে চর্যাগীতি সম্পর্কে বহু নতুন তথ্য এবং তত্ত্ব প্রকাশ করেছিলেন। পরে তাঁর করা সেইসব গবেষণার কিছু অংশ ফরাসি ভাষায় অনূদিত হয়ে ‘Journal Asiatic’–এর ১৯৩৪ সালের অক্টোবর সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। এছাড়া ডঃ শহীদুল্লাহ লিখিত— ‘Buddhist Mystic Songs’, ডঃ সুকুমার সেন লিখিত— ‘চর্যাগীতি পদাবলী’ এবং মণীন্দ্রমোহন বসু লিখিত— ‘চর্যাপদ’ নামের গ্রন্থগুলিও চর্যাগীতিগুলির পাঠান্তর এবং অর্থ-নির্দেশ পাওয়ার জন্য অত্যন্ত মূল্যবান গ্রন্থ। এঁদের পরে ডঃ তারাপদ মুখোপাধ্যায় তাঁর — ‘Old Bengali Language and Text’ —গ্রন্থে চর্যাপদের ভাষার শব্দতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা করেছিলেন।

এখানে চর্যাপদ সংক্রান্ত যে গ্রন্থগুলির কথা বলা হল, সেগুলি মুখ্যতঃ চর্যাপদের ভাষা, ব্যাকরণ, পাঠান্তর, অর্থ, ধর্মতত্ত্ব ইত্যাদি বিষয় নিয়ে রচিত হয়েছিল। কিন্তু চর্যাপদের সাহিত্যমূল্য নিয়ে, অর্থাৎ— একটা কাব্যগ্রন্থ হিসাবে চর্যাপদকে ধরে নিয়ে সেটার সাহিত্যমূল্যের সমীক্ষা তেমনভাবে কেউ করেননি বলেই দেখা যায়।
গবেষকদের মতে খৃষ্টীয় দশম শতাব্দীর অনেক আগে থেকেই বাংলায় ধর্মসংক্রান্ত পদাবলী জনসমাজে গীত হত। তখনও পর্যন্ত আধুনিক সময়ের মত সেগুলি গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ হয়ে পঠিত হত না। খৃষ্টীয় অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত বাংলা কাব্যের ক্ষেত্রে এই রীতিই প্রচলিত ছিল। খৃষ্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীতে বন্দ্যঘটীয় সর্বানন্দ জানিয়েছিলেন যে, তখন— মন্দিরা, মৃদঙ্গ, নুপূর ও চামর সহযোগে একাকী বা দলবদ্ধভাবে সমস্ত কাব্য-কবিতাই গীত হত। বস্তুতঃ বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন থেকে দু’শো বছর আগে পর্যন্ত রচিত কবিতা— পাঠ বা আবৃত্তি করা —প্রচলিত ছিল না। এপ্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, অতীতের বৈদিক সূক্তগুলি— ত্রিষ্ঠভ, গায়ত্রী, জগতী, অনুষ্টুভ, বিরাজ —ইত্যাদি নানা ছন্দে রচিত হলেও সেগুলি কিন্তু কখনও পাঠ করে শোনানো হত না, সেগুলিকে গান করে শোনানো হত।

সেকাজের জন্য— উদাত্ত, অনুদান্ত, স্বরিত— ইত্যাদি নানা পাঠভঙ্গি, অর্থাৎ— গীতিভঙ্গি ব্যবহার করা হত। অতীতের সংস্কৃত কাব্যগুলিও গান করে শোনানো হত, কিংবা সেগুলি নাটক আকারে অভিনীত হত। অতি প্রাচীনকাল থেকেই এই ভারতীয় ধারাটি বিশেষভাবে বাংলায় অভিব্যক্ত হয়েছিল। কৃষ্ণরাধার লীলারসময় পদবন্ধ, কিংবা ভক্তিরসময় আত্মনিবেদনের গভীরতাময় পদাবলী— সবই কিন্তু গানেই রচিত হয়েছিল। প্রেমে, নামে, শ্রমে, ধর্মে— সবকিছুতেই অতীতের বাঙালিরা গীতপ্রেমিক ছিলেন। এই কারণেই অতিদের বাঙালি কবিদের রচিত বৈষ্ণব পদাবলীতে এই গীতধর্মী মন সবথেকে বেশি বিকশিত হয়েছিল বলে ইতিহাসে দেখতে পাওয়া যায়। গবেষকদের মতে ভাব এবং বাহ্যিকরূপ— এই দু’দিক থেকেই চর্যাপদেও সেই আদি লক্ষণ সুস্পষ্টভাবে দেখা যায়। এই প্রসঙ্গে মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বলেছিলেন—
“(চর্যাপদের) গানগুলি বৈষ্ণবদের কীর্তনের মতো, গানের নাম চর্যাপদ। সেকালেও সংকীর্তন ছিল এবং কীর্তনের গানগুলিকে পদই বলিত। তবে এখনকার কীর্তনের পদকে শুধু পদ বলে, তখন চর্যাপদ বলিত।”

প্রত্যেকটি চর্যাপদের মাথায় সিদ্ধাচার্যদের কোনো নির্দেশ থাকুক না থাকুক, সেখানে একটি নির্দেশ কিন্তু অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে দেখতে পাওয়া যায়, সেটি হল— রাগরাগিণীর উল্লেখ। মল্লার, মালশী, বঙ্গালী, পটমঞ্জরী, গবড়া, ধনসী (ধানশ্রী?), কামোদ— ইত্যাদি বহু পরিচিত এবং অপরিচিত রাগের উল্লেখ প্রতিটি চর্যার শুরুতেই সিদ্ধাচার্যরা দিয়ে দিয়েছিলেন। গবেষকদের মতে চর্যাপদে এইধরণের রাগরাগিণীর মোট সংখ্যা হল ষোলটি। সেসবের মধ্যে— পটমঞ্জরী —রাগটি সবথেকে বেশি বারোটি পদে ব্যবহার করা হয়েছিল। বাকি রাগ-রাগিণীগুলিতে গেয় পদসংখ্যা সর্বনিম্ন এক থেকে চার-পাঁচ পর্যন্ত। সেগুলির মধ্যে কতগুলি রাগ আবার হিন্দুস্থানী মার্গ-সংগীতের অন্তর্ভুক্ত। মার্গসংগীতের প্রাচীন শাস্ত্রে সেগুলির উল্লেখ পাওয়া গেলেও, সেগুলির উৎপত্তি সম্বন্ধে এখনও সঠিকভাবে কেউ কিছু জানাতে পারেননি। চর্যাপদের একাধিক গানের সুর হল— গবুড়া। কিন্তু এই নামের কোন রাগ বা রাগিণীর উল্লেখ কোন প্রাচীন সঙ্গীত শাস্ত্রে পাওয়া যায় না।

এটির গায়ন-পদ্ধতি নিয়েও সঠিক কোনো সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব হয়নি। ডঃ নীহাররঞ্জন রায় জানিয়েছিলেন যে, চর্যাগীতিগুলি সমসাময়িক লোচন পণ্ডিতের রাগ-তরঙ্গিণী বা কিছু পরবর্তীকালের শাঙ্গদেবের সংগীতরত্নাকরের পদ্ধতি অনুযায়ী গাওয়া হোত কিনা, সেকথা বলা কঠিন। তবে এটুকু অবশ্যই বলা যেতে পারে যে, চর্যাপদের প্রতিটি গানে ধ্রুবপদ থাকায় অতীতে সেগুলি সম্মেলক বা যৌথগান হিসাবে গীত হত, এবং সেদিক থেকে পরবর্তী সময়ের কীর্তন বা বাউল গানের গায়ন পদ্ধতির সঙ্গে এর মিল হয়ত থাকা সম্ভব। এই কারণেই পণ্ডিতেরা সিদ্ধান্ত করেছেন যে, চর্যাপদগুলিই বাংলা কীর্তনের প্রাচীনতম নিদর্শন। অন্যভাবে বললে— বাংলা গীতিকাব্যের আদি লক্ষণ যদি কোথাও স্পষ্টভাবে দেখতে পাওয়া যায়, তাহলে সেটা চর্যাপদেই দেখা যায়। আর এই কারণেই চর্যাপদ আজও বাংলা কাব্যের উষালগ্নের উজ্জ্বল জ্যোতি বিকিরণ করে চলেছে এবং সেই আলোকেই পরবর্তী সময়ের বাংলা গীতিকাব্যগুলি উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে। এই কারণেই বাংলা সাহিত্যে এই গীতিকাব্যের ধারা আজও অম্লান হয়ে রয়েছে।

(ছবি পরিচয়— চর্যাপদের কবি লুইপাদ, ছবি সৌজন্যে— উইকিমিডিয়া কমন্স)