ইতিহাস

ভারত নামের উৎস

ভারতবর্ষ নামে যে ভূখণ্ড, সেটিকে প্রাচীনকাল থেকে নানা নামে চিহ্নিত করা হয়ে এসেছে। এর মধ্যে রয়েছে জম্মুদ্বীপ, ভারতখণ্ড, হিমবর্ষ, অজনাভবর্ষ, আর্যাবর্ত, হিন্দ, হিন্দুস্তান আর ইন্ডিয়া নামগুলি। সংস্কৃত বর্ষ শব্দটির অর্থ ভূখণ্ড।

সম্রাট অশোকের শিলালিপিতে জম্মুদ্বীপের অস্তিত্ব পাওয়া যায়।

আবার বিষ্ণুপুরাণে পাওয়া যায় ভারতের সীমারেখার বর্ণনা :

‘উত্তরং যৎ সমুদ্রস্য’ হিমাদ্রেশ্চৈব দক্ষিণম্

বর্ষং তদভারতং নাম ভারতী যত্র সন্ততিঃ

অর্থাৎ, সমুদ্রের উত্তরে এবং হিমালয় পর্বতের দক্ষিণে অবস্থিত অঞ্চলের নাম হল ভারত, যেখানে ভরতের সন্ততিরা বসবাস করে।

তবে এই সব নামগুলির মধ্যে ভারত নামটিই সবথেকে বেশি প্রচলিত।

আবার এই নামটি নিয়েই রয়েছে সবথেকে বেশি মতবিরোধ।

ভাষাবিদ অজিত ওয়াডনের্কর বলছেন, “হিন্দ, হিন্দুস্তান বা ইন্ডিয়া – এই নামগুলির সঙ্গে সিন্ধু নদের যোগ আছে। কিন্তু সিন্ধু শুধু একটি নদ নয়, এর অর্থ যেমন নদ বা নদী হয়, তেমনই সাগরও এর আরেকটি অর্থ। সেদিক থেকে বিচার করলে দেশের উত্তর-পশ্চিম অংশটি কোনও এক সময়ে সপ্তসিন্ধু বা পাঞ্জাব বলা হত। ওই অঞ্চলটি খুবই উর্বর ছিল তাই সেখান দিয়ে বহমান সাত অথবা পাঁচটি নদীই ছিল এলাকার পরিচয়।“

তার কথায়, “প্রাচীন ফার্সি ভাষায় সপ্তসিন্ধুকে ‘হফ্তহিন্দু’ বলা হত।“

আবার ইন্ডিয়া এবং ইন্ডাস নাম পাওয়া যায় গ্রীক ইতিহাসবিদ মেগাস্থিনিসের বর্ণনায়।

পুরাণে একাধিক ভরত

বলা হয়ে থাকে যে পৌরাণিক চরিত্র ভরতের নাম থেকেই ভারত শব্দটি এসেছে। আবার ইতিহাসে ভরত নামে একাধিক চরিত্র পাওয়া যায়।

এঁদের মধ্যে একজন যেমন ছিলেন রামচন্দ্রের ভাই, আরেক ভরতের খোঁজ পাওয়া যায় যিনি শকুন্তলা ও দুষ্মন্তের পুত্র ছিলেন। অন্য আরেক ভরত ছিলেন নাট্যশাস্ত্র বিশারদ।

আবার মগধের রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের রাজসভাতেও একজন ভরত ঋষির কথা জানা যায়।

পদ্ম পুরাণ ও মৎস পুরাণেও ভরতের উল্লেখ পাওয়া যায়।

ভাষাবিদ অজিত ওয়াডনের্করের মতে ঋগ্বেদের একটি শাখা ‘এতরেয় ব্রাহ্মণ’ গ্রন্থ অনুযায়ী শকুন্তলা-দুষ্মন্তের পুত্র ভরতের নামানুসারেই ভারত নাম এসেছে বলে মনে করা হয়।

হিন্দু পুরাণের বর্ণনা অনুযায়ী, সেই ভরত ‘চক্রবর্তী সম্রাট’ ছিলেন, অর্থাৎ যিনি চার দিকের জমি দখলে নিয়ে বিশাল এক সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনিই অশ্বমেধ যজ্ঞ করেছিলেন বলে জানা যায়। সেই থেকেই তার সাম্রাজ্যের নাম ভারতবর্ষ।“

অন্যদিকে জৈন ধর্মের বিশ্বাস অনুযায়ী, প্রথম তীর্থঙ্কর ভগবান ঋষভদেবের জ্যেষ্ঠপুত্র মহাযোগী ভরতের প্রসঙ্গও রয়েছে।

এখন কোন ভরতের নামে গড়ে উঠেছিল ভারত? তা কি আদৌ কোনও এক ব্যক্তি ‘ভরত’-এর সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল না কি ভরত আসলে একটি জনগোষ্ঠী?

ভরত কি ব্যক্তি না জনগোষ্ঠী?

অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির সংস্কৃতের দিকপাল অধ্যাপক মনিয়র উইলিয়ামস, যিনি সংস্কৃত-ইংরেজি অভিধান লিখেছিলেন, তার মতে বেদে ভরত বা ভরথ শব্দটির অর্থ অগ্নি, লোকপাল বা বিশ্ব-রক্ষক, এক অর্থে রাজা।

এই রাজা ‘ভরত’ প্রাচীন সরস্বতী-ঘগ্গর নদী অঞ্চলে রাজত্ব করতেন।

মি. ওয়াডনের্কর বলছেন, “বৈদিক যুগের এক প্রসিদ্ধ জনগোষ্ঠী ভরতের উল্লেখ অনেক প্রাচীন পুঁথিতে রয়েছে। এই গোষ্ঠী সরস্বতী নদী তট, যেটি বর্তমানের ঘগ্গর, ওই অঞ্চলে বসবাস করত। এদের নাম অনুসারেই ওই ভূখণ্ডের নাম হয় ভারতবর্ষ।“

তিনি যে সরস্বতী, বর্তমানে ঘগ্গর নদী অঞ্চলের কথা বলছিলেন, সেই অঞ্চলটি আবার হরপ্পা সভ্যতা যেখানে গড়ে উঠেছিল, সেই সরস্বতী-ঘগ্গর নদী অববাহিকা, এমনটাই মনে করেন কোনও কোনও পণ্ডিত।

শকুন্তলা-দুষ্মন্ত পুত্র ভরত

ভাষাবিদ পবিত্র সরকার বলছেন, শকুন্তলা ও দুষ্মন্তের পুত্র ভরতের নাম থেকেই তার রাজ্যের নাম হয় ভারত, এটাই প্রচলিত ধারণা।

এই ধারণার পিছনে রয়েছে মহাভারতের আদিপর্বের একটি কাহিনী।

মহর্ষি বিশ্বামিত্র এবং অপ্সরা মেনকার কন্যা শকুন্তলা এবং পুরুবংশীয় রাজা দুষ্মন্তের মধ্যে গান্ধর্বমতে বিবাহ হয়। তাদের ছেলের নাম ছিল ভরত।

মহাভারতের বর্ণনা অনুযায়ী, ঋষি কণ্ব আশীর্বাদ করেছিলেন যে ভরত পরবর্তীকালে ‘চক্রবর্তী সম্রাট’ হবেন এবং সেই ভূমিখণ্ডের নাম ভারত হিসাবে বিখ্যাত হবে।

ভারত নামের উৎপত্তির এই কাহিনীটি অত্যন্ত জনপ্রিয়।

মহাভারতে বর্ণিত এই ঘটনা নিয়েই পরবর্তীকালে কবি কালিদাস অভিজ্ঞান শকুন্তলম নামের মহাকাব্য রচনা করেন।

ইন্ডিয়া নাম যেভাবে হয়েছিল

মুঘল আমলে তাদের শাসনাধীন অঞ্চলকে হিন্দুস্তান বলা হত, তবে ঐতিহাসিক ইয়ান জে ব্যারো লিখছেন যে অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে ব্রিটিশ মানচিত্রগুলিতে ইন্ডিয়া নামটির প্রচলন হতে থাকে। তার আগে, মুঘল আমলে তাদের শাসনাধীন এলাকাটিকে হিন্দুস্তান বলে চিহ্নিত করা হত।

মি. ব্যারো জার্নাল অফ সাউথ এশিয়ান স্টাডিসে প্রকাশিত তার প্রবন্ধ ‘ফ্রম হিন্দুস্তান টু ইন্ডিয়া’-তে লিখেছেন “ইন্ডিয়া শব্দটির প্রতি আকর্ষণের কারণ সম্ভবত ছিল তাদের গ্রীক-রোমানদের সঙ্গে নৈকট্য, ইউরোপে এটির দীর্ঘ ব্যবহার এবং সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার মতো বৈজ্ঞানিক ও সরকারি সংস্থাগুলির কাছে এই নামটির গ্রহণযোগ্যতা।“

আবার ভারতের সংবিধান রচনার সময়েও বিতর্ক হয়েছিল যে ইন্ডিয়া নামটা আদৌ রাখা হবে কী না তা নিয়ে। এ নিয়েও মতবিরোধ হয়েছিল যে সংবিধানে দেশের নামকরনের ক্ষেত্রে আগে ভারত, যেটিকে বিদেশি ভাষায় ইন্ডিয়া বলা হয়- এইভাবে রাখা হবে না কি এখন সংবিধানে যেভাবে আছে, অর্থাৎ ‘ইন্ডিয়া, দ্যাট ইজ ভারত’ সেভাবে রাখা হবে।

কালে কালে দেশের নাম বারবার বদলেছে। মেলুহা, হিন্দ, আর্যাবর্ত – নামের অভাব নেই।

মেলুহা

প্রায় ৪৫০০ বছর আগের কথা। ব্রোঞ্জ যুগে সুমেরীয় সভ্যতার এক বিশিষ্ট ব্যবসায়িক অংশীদার ছিল মেলুহা। সুমেরীয় সভ্যতার বিভিন্ন লেখতে মেলুহা থেকে জাহাজ আসার উল্লেখ রয়েছে। অধিকাংশ ইতিহাসবিদের মতে, মেলুহা বলতে সিন্ধু উপত্যকায় গড়ে ওঠা সভ্যতা, অর্থাৎ, আমাদের দেশের কথাই বলা হয়েছে।

হিন্দ বা হিন্দুস্তান

২৫০০ বছর আগে ইরান-মিশরের সঙ্গেও বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল সিন্ধু সভ্যতার। পারস্য ভাষায় ‘স’-এর উচ্চারণ ছিল ‘হ’-এর মতো। তাই সিন্ধু উচ্চারণ ভুলে হয়ে গিয়েছিল হিন্দু। পারস্য সভ্যতার মানুষ, এই সভ্যতাকে বলত আল-হিন্দ। পরবর্তীকালে এই এলাকা হিন্দু-হিন্দ-হিন্দুস্থান নামে পরিচিতি লাভ করে।

ইন্ডিয়া

হিন্দুস্তান বা হিন্দ শব্দই পরবর্তীকালে অপভ্রংশে ইন্ডিয়া হয়ে যায়। বর্তমানে অনেকেই ইন্ডিয়া নামটি ব্রিটিশদের দেওয়া বলে দাবি করলেও, ইন্ডিয়া শব্দটির প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ২৩০০ বছর আগে, গ্রিক পর্যটক মেগাস্থিনিসের বর্ণনায়। পরবর্তীকালে, ব্রিটিশরাও ভারতে এসে সিন্ধু উপত্যকাকে উচ্চারণের সুবিধার জন্য ভারত বা হিন্দুস্তানের পরিবর্তে ইন্ডিয়া শব্দটি ব্যবহার শুরু করেছিল।

জম্বুদ্বীপ

২২০০ বছর আগে, সম্রাট অশোকের সময়, আমাদের দেশ জম্বুদ্বীপ নামেও পরিচিত ছিল। অধিকাংশ ইতিহাসবিদের মতে, সেই সময় ভারতে প্রচুর জামগাছ ছিল। তা থেকেই এই নামটির উদ্ভব হয়েছিল। আবার, এর পিছনে একটি লোককথাও রয়েছে। কথিত আছে, অতীতে জম্বু নামে এক গাছ ছিল, যাতে হাতির মতো বিশাল আকারের ফল ধরত। সেই ফল পাহাড়ে পড়ে তাদের রস থেকেই নদীর সৃষ্টি হয়েছে। এই নদীর তীরে অবস্থিত ভূমি বলে নাম হয়েছিল জম্বুদ্বীপ।

ভারতবর্ষ বা ভারতখণ্ড বা ভারত

আমাদের দেশের সর্বকালের সবথেকে জনপ্রিয় নাম হল ভারতবর্ষ বা ভারতখণ্ড বা ভারত। এই নামটি প্রাচীনকাল থেকে ব্যবহার হয়ে আসছে বলে দাবি করা হলেও, ২১০০ বছর আগে কলিঙ্গ রাজ্যের জৈন রাজা খারবেলাই প্রথম এই নামটি ব্যবহার করেছিলেন বলে মনে করেন একাংশের ইতিহাসবিদ। পুরাণেও অবশ্য হিমালয়ের দক্ষিণাংশের ভূমিকে ভারত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এই নামকরণের পিছনে বেশ কয়েকটি কাহিনি রয়েছে। সবথেকে জনপ্রিয় হল, মহারাজা দুষ্মন্ত ও শকুন্তলার পুত্র, ভরতের নামানুসারেই ভারত নামটির উদ্ভব। আবার অনেকে মনে করেন, গুরু ঋষভদেব বনবাসে যাওয়ার আগে, তাঁর রাজ্য তাঁর পুত্র ভরতের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। তাঁর নামানুসারেই দেশের নাম হয় ভারতবর্ষ। দশরথের পুত্র তথা রামের ভাই ভরত কিংবা নাট্যশাস্ত্রের রচয়িতা ভরতমুনির নাম থেকেও এই নামকরণ হয়েছে বলে কথিত আছে।

আর্যাবর্ত বা আর্যদেশ

মনে করা হয়, বহু প্রাচীনকালে আর্যরা আমাদের দেশে এসে বসবাস শুরু করেছিল। আর্যদের ভূখণ্ড হিসেবে, এর নাম হয় আর্যাবর্ত। আর্যাবর্তের সীমানা ছিল কাবুলের কুম্ভা নদী থেকে ভারতের গঙ্গা নদী এবং কাশ্মীর উপত্যকা থেকে নর্মদা নদী পর্যন্ত। তবে, আর্যদের আদি নিবাস নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। ২০০০ বছর আগে রচিত, ধর্মশাস্ত্রে আর্যাবর্ত বা আর্যদেশ কথাটির উল্লেখ পাওয়া যায়।

তবে, এই নামগুলির সবকটিই মূলত উত্তর ভারতের রাজ্যগুলিকে বোঝায়। দক্ষিণ ভারত, অর্থাৎ, বিন্ধ পর্বতের দক্ষিণে দীর্ঘদিন পর্যন্ত পা পড়েনি বিদেশি পর্যটকদের। ফলে, তাদের দেওয়া নামগুলি সবই উত্তর ভারত সম্পর্কিত। মনুস্মৃতিতে বিন্ধ পর্বতের উত্তরের অংশকে আর্যাবর্ত এবং দক্ষিণের অংশকে দ্রাবিড় বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *