ইউরোপীয়দের ভারতে আগমন
সপ্তম শতক থেকে এ অঞ্চলের সঙ্গে আরব বণিকদের ব্যবসায়-বাণিজ্য ছিল একচেটিয়া । তারা বাণিজ্য করত মূলত সমুদ্রপথে। ১৪৫৩ সালে কন্সস্টান্টিনোপোল উসমানীয় তুর্কিরা দখল করে নেয় । ফলে উপমহাদেশের সাথে জলপথে ব্যবসায়-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যায় । সুতরাং প্রাচ্যের সাথে পাশ্চাত্যের ব্যবসায় – বাণিজ্যের জন্য ভিন্ন জলপথ আবিষ্কারের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। মূলত এ কারণেই ইউরোপীয় শক্তিগুলো সমুদ্রপথে উপমহাদেশে আসার অভিযান শুরু করে ।
পর্তুগিজ:
পর্তুগিজদের মধ্যে যে দুঃসাহসী নাবিক প্রথম সমুদ্রপথে এদেশে আসেন, তাঁর নাম ভাস্কো-ডা-গামা । তিনি ১৪৯৮ সালের ২৭শে মে ভারতের পশ্চিম-উপকূলের কালিকট বন্দরে এসে উপস্থিত হন। উপমহাদেশে তাঁর এ আগমন ব্যবসা-বাণিজ্য এবং যোগাযোগ ক্ষেত্রে এক নতুন যুগের সূচনা করে । পর্তুগিজরা ব্যবসায়-বাণিজ্যের উদ্দেশে এদেশে আসে কিন্তু ক্রমে তারা সাম্রাজ্য বিস্তারের দিকে ঝুঁকে পড়ে । স্বল্প সময়ের মধ্যে এই ইউরোপীয় বণিকরা উপমহাদেশের পশ্চিম উপকূলের কালিকট, চৌল, বোম্বাই, সালসেটি, বেসিন, কোচিন, গোয়া, দমন, দিউ প্রভৃতি বন্দরে কুঠি স্থাপন করতে সক্ষম হয় ।
১৫৩৮ সালে তারা চট্টগ্রাম ও সাতগাঁওয়ে বাণিজ্যঘাঁটি নির্মাণের অনুমতি লাভ করে। ১৫৭৯ সালে হুগলী নামক স্থানে তারা উপনিবেশ গড়ে তোলে। এরপর তারা উড়িষ্যা এবং বাংলার কিছু অঞ্চলে বসতি সম্প্রসারণ করতে সক্ষম হয় । বাংলাসহ উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বাণিজ্য কুঠি নির্মাণের ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা থাকলেও পর্তুগিজদের বিভিন্ন অপকর্ম ও দস্যুতার কারণে বাংলার সুবাদার শায়েস্তা খান তাদের চট্টগ্রাম ও সন্দ্বীপের ঘাঁটি দখল করে বাংলা থেকে বিতাড়ন করেন। তাছাড়া পর্তুগিজরা এদেশে আগত অন্যান্য ইউরোপীয় শক্তির সঙ্গেও প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পরাজিত হয় । ফলে এরা এ দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয় ।
ইউরোপীয়দের মধ্যে পর্তুগিজরাই প্রথম বাংলায় আগমন করে। পনেরো শতকের শুরু থেকেই তারা বাণিজ্যের জন্য দুঃসাহসিক সমুদ্রযাত্রা শুরু করে। ১৪৯৮ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে ভাস্কো ডা গামার কালিকটে পৌঁছার কয়েক দশক পরে বাংলায় পর্তুগিজদের আগমন ঘটে। পনেরো শতকের শেষ দিক হতেই এশিয়া থেকে মসলা আহরণের উদ্দেশ্যে ভেনিস ও আরব বণিকদের এড়িয়ে বিকল্প পথ অনুসরণের ফলেই এদেশে পর্তুগিজদের অনুপ্রবেশ ঘটে। ১৪৪৫ খ্রিস্টাব্দের দিকে হালকা দ্রুতগামী জাহাজের ব্যবহার এবং ১৪৫৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে অক্ষাংশ নির্ণয়ে কৌণিক উচ্চতা পরিমাপক যন্ত্র ব্যবহারে পর্তুগিজদের দক্ষতা তাদের সমুদ্রযাত্রায় যথেষ্ট সহায়তা করে এবং তাতে পৃষ্ঠপোষকতা করেন প্রিন্স হেনরি এবং পরবর্তীকালে রাজা দ্বিতীয় যোয়াও।
মালাক্কা অধিকারের পর (১৫১১) পর্তুগিজদের বঙ্গোপসাগরের অভ্যন্তরে প্রবেশের চেষ্টা সফল হয় এবং সেখান থেকে চাল ও বস্ত্রের সরবরাহ নিশ্চিত হয়। বাংলার সঙ্গে প্রথম পরোক্ষ যোগাযোগ স্থাপিত হয় ১৫১২-১৩ খ্রিস্টাব্দে। ১৫১৬ খ্রিস্টাব্দে দিয়েগো রেনেল কর্তৃক অংকিত এশিয়ার মানচিত্রে শুধু উপকূলীয় অঞ্চলের রূপরেখা চিহ্নিত করা ছিল; তাতে দ্বীপ ও বন্দরের উল্লেখ ছিল না। কাজেই এগুলি সম্পর্কে সম্ভবত পর্তুগিজদের কোন ধারণাই ছিল না। আলবুকার্কের মৃত্যুর পর লোপো সোয়ারেসের নিয়োগের ফলে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত বাণিজ্যিক কার্যক্রমের সমাপ্তি ঘটে এবং এক্ষেত্রে উদার নীতি অনুসরণের ফলে বাংলায় পর্তুগিজদের আগমন ঘটে।
পর্তুগিজ ব্যবসায়ী মার্টিন লুসেনা যখন বাংলার রাজধানী গৌড়ে বাস করছিলেন তখন ফ্লোরেন্সের বণিক গিওভান্নি ডি এম্পলি কর্তৃক প্রেরিত প্রথম পর্তুগিজ বণিক যোয়াও কোয়েলহো ১৫১৬ খ্রিস্টাব্দের দিকে গঙ্গায় এসে পৌঁছেন। সোয়ারেস চারটি জাহাজের একটি বহর যোয়াও ডি সিলভেরিয়ার নেতৃত্বে প্রেরণ করেন। সিলভেরিয়া বাংলার জাহাজগুলি লুণ্ঠন করে ১৫১৮ খ্রিস্টাব্দের ৯ মে চট্টগ্রামে নোঙ্গর করেন। চট্টগ্রামের মুসলিম শাসনকর্তার সৈন্যদের সঙ্গে পর্তুগিজদের কখনও যুদ্ধ এবং কখনও বা শান্তির অবস্থা চলতে থাকে। আরাকানের রাজা বাংলার সুলতানের নিকট থেকে চট্টগ্রাম উদ্ধারের জন্য সিলভেরিয়ার নিকট সাহায্য চাইলে অবস্থা আরও জটিল হয়ে ওঠে। কিন্তু সিলভেরিয়া চট্টগ্রাম ছেড়ে সিংহলের দিকে রওনা হন এবং এভাবেই বাংলার সঙ্গে পর্তুগিজদের প্রথম সরকারি যোগাযোগের পরিসমাপ্তি ঘটে।
সোয়ারেসের স্থলাভিষিক্ত দিয়েগো লোপেস করমন্ডল ও পেগুর প্রতি অনেক বেশি আগ্রহী ছিলেন। তিনি এন্টোনিও ডি ব্রিট্টোর অধীনে বাংলায় তিনটি জাহাজ প্রেরণ করেন। ব্রিট্টোর চট্টগ্রাম থেকে গৌড়ে আগমনের (অক্টোবর, ১৫২১) উপর তাঁর অজ্ঞাতনামা দোভাষী একটি মূল্যবান বিবরণ রেখে গেছেন। ব্রিট্টো ভারতের পর্তুগিজ গভর্নরের নিকট থেকে কিছু উপঢৌকনসহ একটি পত্র বাংলার সুলতানের জন্য নিয়ে আসেন এবং সেই সঙ্গে নিয়ে আসেন বিক্রয়ের জন্য কিছু পণ্যসামগ্রী। তার আগমনের কয়েকদিন পূর্বে রাফায়েল প্রেস্টেলোর নেতৃত্বে অপর একটি পর্তুগিজ মিশনের উপস্থিতি তার কাজকে কঠিন করে তোলে। রাফায়েলের প্রতিনিধি ও বাংলায় অবস্থানরত একজন অভিজ্ঞ ব্যক্তি ক্রিস্টোভাও জুসার্তে আমদানি-রপ্তানি শুল্ক ১০%-এ হ্রাস করার অনুমতি লাভের জন্য গৌড়ে গিয়েছিলেন। ব্রিট্টো বাংলায় পর্তুগিজদের আমদানি-রপ্তানি শুল্ক প্রদান থেকে অব্যাহতি দানের প্রস্তাবসহ গনজালভেস ট্র্যাভার্সকে সুলতানের কাছে প্রেরণ করেন। সরকারি পদমর্যাদার দাবিদার দুই দূতের আগমন বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে এবং পরিণামে দুই পক্ষ চট্টগ্রামে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এ যুদ্ধে তুর্কী বণিক আগা খান রাফায়েলের পক্ষে অবস্থান নেন।
জুসার্তে গৌড় দরবারের পারিষদবর্গকে প্ররোচিত করে ব্রিট্টোর দোভাষীকে গুপ্তচর হিসেবে চিহ্নিত করার ব্যবস্থা করেন। পর্তুগিজদের আমদানি রপ্তানি শুল্ক প্রদান থেকে অব্যাহতি দানের প্রতিশ্রুতিসহ দোভাষীকে শেষ পর্যন্ত বাংলা ছেড়ে যাবার অনুমতি দেওয়া হয়। এ ব্যবস্থাই হয়ত নিয়মিতভাবে বাংলায় জাহাজ প্রেরণে পর্তুগিজদের উদ্বুদ্ধ করে। ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে রাই ভায্ পার্সিরা চট্টগ্রাম আসে এবং পারস্যের বণিক খাজা শাহাবুদ্দীনের জাহাজ লুণ্ঠন করে। চট্টগ্রামের গভর্নরের সঙ্গে খাজা শাহাবুদ্দীনের বন্ধুত্বের ফলে এ লুণ্ঠনের প্রতিশোধ গ্রহণ করা হয়। এভাবে ষোলো শতকের শুরু থেকে ব্যক্তি খাতের পর্তুগিজ বণিক এবং তার পাশাপাশি সরকারি পর্যায়ের পর্তুগিজরা নিয়মিতভাবে বাংলায় আসতে শুরু করে। ফলে তাদের নিজেদের মধ্যে প্রায়শই প্রচন্ড সংঘর্ষ বাধত। লিসবনে কিছুকালের জন্য পরস্পর বিরোধী বাদানুবাদের ঘটনা ঘটে। পরবর্তী সময়ে আগত ইউরোপীয়রা তাদের আগমনের পরপরই স্থানীয় রাজনৈতিক কর্মকান্ডে লিপ্ত হয়ে পড়েছিল। তবে পর্তুগিজরা ইউরোপীয়দের তুলনায় বিলম্বে স্থানীয় রাজনীতিতে জড়িত হলেও তারা বেশি জটিলতার সৃষ্টি করে। ১৫২৮ খ্রিস্টাব্দে একটি ঝড়ের পর চট্টগ্রাম জেলার চকরিয়ায় আটকে পড়া পর্তুগিজদের সাহায্য পাবার পর খুদা বখশ খান তাদের বন্দি করেন। তাদের মুক্তির জন্য মার্টিন আলফন্সো জুসার্ত ডি মেলোর আলোচনা ব্যর্থ হলে বন্দিরা পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু ধরা পড়ে যায়। ডি মেলোর তরুণ ভ্রাতৃস্পুত্রের হত্যাকান্ডের পর, বাংলার সুলতান নুসরত শাহ এর বিরুদ্ধে ব্যবসায়ী শাহাবুদ্দীনের অভিযানে গোয়া থেকে সাহায্য পাওয়ার শর্তে শাহাবুদ্দীন বন্দিদের মুক্তিপণের অর্থ প্রদান করেন।
নুসরত শাহের মৃত্যুর পর গোয়া থেকে পাঁচটি জাহাজের বহর নিয়ে জুসার্ত চট্টগ্রাম পৌঁছেন। সন্ধি স্থাপনের উদ্দেশ্যে জুসার্ত গৌড় সুলতান গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহ এর দরবারে একটি প্রতিনিধিদল প্রেরণ করেন। কিন্তু মুসলমানদের একটি জাহাজ লুণ্ঠনের দায়ে সুলতান পর্তুগিজ প্রতিনিধিদলের সদস্যদের বন্দি করেন। চট্টগ্রামেও জুসার্ত ও অপরাপর পর্তুগিজকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের মধ্যে পাঁচ জনকে হত্যা করা হয় এবং অবশিষ্টদের অন্তরীণ রাখা হয়। বন্দিদের মুক্তির জন্য গোয়া থেকে এক শক্তিশালী সৈন্যদল প্রেরণ করা হয়। গৌড়ে আপোস আলোচনা ব্যর্থ হয় এবং জর্জ আলকোকোরেডো সংলাপ বন্ধ রেখে নগরীতে অগ্নি সংযোজনের পর কোন রকমে পালিয়ে যান। বাংলায় শেরশাহের আবির্ভাবের ফলে অবশ্য পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটে।
নতুন সংকটের মুখে গিয়াসউদ্দীন মাহমুদ দিয়েগো র্যাবেলোর সাথে আলোচনায় বসেন। সম্ভবত দিয়েগো র্যাবেলো ছিলেন প্রথম পর্তুগিজ যিনি গঙ্গা নদী পথে গৌড়ে পৌঁছেন। শেরশাহের বিরুদ্ধে পর্তুগিজদের সাহায্যের আশ্বাস পেয়ে মাহমুদ বন্দিদের মুক্তি দেন। পর্তুগিজদের সাহায্য সত্ত্বেও শেরশাহের সঙ্গে যুদ্ধে মাহমুদ শাহ পরাজিত হন। পর্তুগিজদের নিষেধ সত্ত্বেও মাহমুদ কর্তৃক প্রদত্ত ১৩ লক্ষ স্বর্ণমুদ্রা প্রাপ্তির অব্যবহিত পরেই শেরশাহ গৌড় ছেড়ে যান। বাংলায় শুল্ক অফিসসহ কুঠি স্থাপনের জন্য সুলতান এবার পর্তুগিজদের অনুমতি দেন। নুনো ফার্ণান্দেজ ফ্রেইরকে বাড়ির কর আদায়ের বিশেষ ক্ষমতা প্রদান পূর্বক চট্টগ্রামে নিয়োগ করা হয়। যোয়াও কোরিয়া সাতগাঁও-এর শুল্ক অফিসের দায়িত্ব গ্রহণ করে। পর্তুগিজ বন্দিদের মুক্তি দেওয়া হয়। শেরশাহ গৌড়ে প্রত্যাবর্তনকালে মাহমুদের বাহিনী কর্তৃক সামান্য বাধাপ্রাপ্ত হন। পতনোন্মুখ সুলতানকে রক্ষার জন্য গোয়া থেকে প্রত্যাশিত সাহায্য অনেক বিলম্বে এসে পৌঁছায়। মাহমুদের মৃত্যুর ফলে হোসেন শাহী বংশের অবসান ঘটে। সাতগাঁও ও চট্টগ্রামের শুল্ক অফিস পর্তুগিজদের নিয়ন্ত্রণে থেকে যায়।
চট্টগ্রাম বন্দরের উপর পর্তুগিজদের নিয়ন্ত্রণ ছিল স্বল্পস্থায়ী, কারণ পনেরো শতকের মধ্যভাগ থেকেই এটি আরাকান, ত্রিপুরা, বাংলা ও বার্মার মধ্যে বিরোধের কেন্দ্রে পরিণত হয়। ১৫৫৯ খ্রিস্টাব্দে গোয়ার পর্তুগিজ ভাইসরয় বাকলার পরমানন্দ রায়ের সঙ্গে একটি বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদন করেন এবং এ চুক্তির ফলে পর্তুগিজরা শুল্ক প্রদান করে পণ্য ক্রয়ের অধিকার লাভ করে। সফরকারী পর্তুগিজ জাহাজগুলিতে খাদ্যদ্রব্য সরবরাহের বিনিময়ে তারা বাকলাকে সামরিক সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেয়। পর্তুগিজরা সম্ভবত বাকলার একচেটিয়া বাণিজ্য সুবিধা লাভের উদ্দেশ্যে চট্টগ্রামের ব্যবসা বাকলায় স্থানান্তর করতে চেয়েছিল। চট্টগ্রামে পর্তুগিজদের নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত থাকে। ১৫৬৯ খ্রিস্টাব্দে সীজার ফ্রেডারিক চট্টগ্রাম বন্দরে আঠারোটি পর্তুগিজ জাহাজ নোঙ্গর করা অবস্থায় দেখতে পান।
বাংলায় অবস্থান সংহত করার জন্য যখন সরকারিভাবে পর্তুগিজ প্রয়াস চলছিল সোনা রূপার বার ও বারুদের কারবারের মাধ্যমে, সে সময় পর্তুগিজ ভাড়াটে সৈন্যরা বাংলা ও আরাকান উপকূলে দস্যুবৃত্তি চালিয়ে যাচ্ছিল। জলদস্যুরা লবণের জন্য বিখ্যাত সন্দীপ দ্বীপটিকে সহজেই ঘাঁটি হিসেবে পেয়ে যায় এবং সেখানে ব্যক্তি খাতের পর্তুগিজ বণিকরাও কর্মকান্ড শুরু করে। সেখানে বসবাসকারী আফগান পরিবারগুলি দস্যুতা অথবা দ্বীপটি নিয়ন্ত্রণে পর্তুগিজদের প্রচেষ্টা এর কোনটিই সুনজরে দেখে নি। মূল ভূখন্ড আক্রমণের জন্য দ্বীপটিকে সুবিধাজনক ঘাঁটি হিসেবে প্রস্তুত আরাকানিদের উচ্চাভিলাষ দ্বীপটির ঘাতপ্রতিঘাতময় ইতিহাসের সাথে ক্রমান্বয়ে সম্পৃক্ত হয়ে উঠছিল।
এভাবে বাংলায় পর্তুগিজ সম্প্রদায় ধীরে ধীরে সরকারি ও ব্যক্তিখাতের বণিক, অভিযাত্রী ও জলদস্যু প্রভৃতি অংশে বিভক্ত হয়ে পড়ে। তবে এই স্বাতন্ত্র্য তেমন সুনির্দিষ্ট ছিল না; সুযোগ প্রায়শই তাতে ব্যতিক্রম ঘটাত। হোসেন শাহী বংশের ক্রমাবনতির ফলে বাংলার উপকূলীয় এলাকায় আরাকান ও উড়িষ্যা শক্তির অনুপ্রবেশ ঘটে এবং প্রায়শই তারা দেশের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ে। কোন কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণবিহীন পর্তুগিজ দলগুলি দাস ব্যবসার মাধ্যমে স্ব স্ব আধিপত্য প্রতিষ্ঠা শুরু করে।
এফন্সো ডি মেলো কর্তৃক ভাগীরথীর তীরে স্থাপিত প্রথম পর্তুগিজ বসতি ছিল সাতগাঁওয়ে, বান্ডেলে নয়। মনে হয়, সাতগাঁওয়ে পর্তুগিজদের কুঠি স্থাপনের জন্য অনুমতি দেওয়া হয় নি, প্রকৃতপক্ষে এটি ছিল শুল্ক আদায়ের ছাউনি। ১৫৫৪ খ্রিস্টাব্দের দিকে পোর্টো গ্রান্ডো নামে অভিহিত চট্টগ্রামের সাথে তুলনা করে পর্তুগিজরা সাতগাঁওয়ের নাম দেয় পোর্টো পিকুইনো (ছোট বন্দর)। আব্দুল হামিদ লাহোরীর মতে সতেরো শতকে কিছুসংখ্যক পর্তুগিজ সন্দ্বীপ থেকে সাতগাঁওয়ে এসে দুর্গবেষ্টিত কিছু ভবন নির্মাণ করেছিল। সাতগাঁয়ের গুরুত্ব হ্রাস পাওয়ার পর তারা হুগলির আশেপাশে কম খাজনায় কিছু জমি পেয়েছিল। ত্রিবেণী বা সম্ভবত বাঁশবাড়িয়ায় তাদের বসতি ১৫৭৯ খ্রিস্টাব্দে আকবরের ফরমানের পূর্বেকার বলে প্রতিপন্ন হয়। সেখানকার আঠারো শতকের মন্দির, প্রাচীরের ভাস্কর্য এখনও পর্তুগিজদের স্মৃতি বহন করে। ফ্রেডারিকের বর্ণনায় দেখানো হয়েছে যে, পর্তুগিজদের বসতি সাতগাঁও সদরে ছিল না, বরং তা দিল আদি সপ্তগ্রাম স্টেশন এবং বর্তমানে শুকিয়ে যাওয়া সরস্বতী নদীর তলদেশের মধ্যবর্তী স্থানে। হুগলিতে অর্থাৎ ভাগীরথীর তীরে ১৫৬৫ খ্রিস্টাব্দের আগে কোন পর্তুগিজ বসতি ছিল না, কেননা তখন পর্তুগিজরা ছোট ছোট নৌকায় করে বেত্তোর (হাওড়ার বিপরীতে) থেকে সাতগাঁওয়ে পণ্যসামগ্রী পারাপার করত। ভাগীরথীর তীরে অবস্থিত ত্রিবেণীর বদলে পর্তুগিজদের বেত্তোর ব্যবহারের অন্যতম কারণ ছিল সম্ভবত ১৫৬০ থেকে ১৫৬৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে উড়িষ্যার রাজা কর্তৃক ত্রিবেণী অধিকার।
১৫৭৯ খ্রিস্টাব্দের পর বেত্তোরে পর্তুগিজদের মৌসুমী বসতির পরিবর্তে হুগলিতে তাদের বসতি সুনির্দ্দিষ্ট রূপ পরিগ্রহ করতে শুরু করে। আকবরের দরবারে ফিরিঙ্গিদের উপস্থিতি সম্পর্কে আবুল ফজলের বর্ণনায় বোঝা যায় যে, সাতগাঁও মুগলদেরই নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল, যদিও তিনি সুনির্দ্দিষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন যে, সাতগাঁও ও হুগলি উভয় বন্দরই পর্তুগিজদের অধীনে ছিল। সমকালীন ফরাসি পরিব্রাজক ভিন্সেন্ট লি ব্রাংকের দেখা সাতগাঁওয়ের যে ভবনটির কথা আব্দুল হামিদ লাহোরী উল্লেখ করেছেন সেটি অবশ্যই কিছুকাল পর বিধ্বস্ত হয়ে থাকবে। আপাতদৃষ্টিতে এটি যুক্তিসঙ্গত বলে মনে হয় যে, একবার সরস্বতী নদীতে পলি জমতে শুরু করলে হুগলি নদী দিয়ে অধিক পানি প্রবাহিত হতে থাকে। হুগলির ক্রমোন্নতি সত্ত্বেও ভ্যান লিন্শোটেন (ষোলো শতকের শেষভাগ) দেখতে পান যে, পর্তুগিজরা বন্য লোক ও জংলী ঘোড়ার ন্যায় বাস করছে যেন প্রতিটি মানুষই এক একজন রাজা।
পূর্ব উপকূলে পর্তুগিজ জলদস্যুরা প্রায়শ তাদের পৃষ্ঠপোষকদের যুদ্ধ জয়ে সাহায্য করত। ১৫৮৬ খ্রিস্টাব্দে পর্তুগিজদের সহায়তায় ত্রিপুরা আরাকানিদের কাছ থেকে চট্টগ্রাম ছিনিয়ে নেয়; কিন্তু অচিরেই তারা আরাকানের পক্ষ অবলম্বন করে এবং আরাকানের রাজা সিকান্দর শাহ শেষ পর্যন্ত ১৫৮৮ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম অধিকার করেন। প্রায় এক শতাব্দীকাল চট্টগ্রাম আরাকানিদের দখলে ছিল।
১৫৯০ খ্রিস্টাব্দে এন্টোনিও ডি সউসা গডিনহোর নেতৃত্বে সন্দ্বীপ দখলকারী পর্তুগিজরা আরাকানের ক্রমবর্ধমান ক্ষমতাবৃদ্ধিকে পছন্দ করে নি। সন্দ্বীপের উপর তাদের কর্তৃত্ব ছিল ক্ষণস্থায়ী। সতেরো শতকের ইতিহাস সংকলনকারী পিয়েরে ডু জারিক থেকে আমরা জানতে পারি যে, বিক্রমপুরের কেদার রায় সম্ভবত অপর একটি ভাড়াটিয়া পর্তুগিজ সৈন্যদলের সাহায্যে গডিনহোর নিকট থেকে দ্বীপটি দখল করে নেন। কেদার রায়ের পরাজয় ও অকাল মৃত্যুর ফলে দ্বীপটি ডোমিঙ্গো কার্ভালহোর হাতে চলে যায়। এ কার্ভালহোকে পরবর্তীকালে বাংলা সাহিত্যে অমর করে রাখা হয়েছে। সন্দ্বীপে যাতে অপর্তুগিজ জনসংখ্যা বাড়তে না পারে তার জন্য নৃশংস ব্যবস্থা নেয়া হয়। অপর এক পর্তুগীজের সাথে ক্ষমতা ভাগাভাগিকারী কার্ভালহোকে পর্তুগালের রাজা কি কারণে সম্ভ্রান্ত শ্রেণীতে উন্নীত করেন পরিস্কার নয়।
এবারও পর্তুগিজ আধিপত্য ছিল স্বল্পস্থায়ী। কার্ভালহো আরাকানের একটি আক্রমণকে প্রতিহত করলেও শেষ পর্যন্ত তাকে ও তার সমমনা পর্তুগিজদের দ্বীপটি ছেড়ে যেতে হয়েছিল। এরা আধা-স্বায়ত্বশাসিত উপকূলীয় রাজ্য শ্রীপুর বাকলা ও যশোরে জায়গিরসহ গোলন্দাজ বাহিনীতে ও নৌবাহিনীর নাবিক হিসেবে চাকরি এবং বেশ লাভজনক ব্যবসার সুযোগ পেয়েছিল। মুগলদের বিরুদ্ধে এক যুদ্ধে কার্ভালহো আহত হন এবং তাকে হুগলিতে চলে যেতে হয়। সেখানে তিনি আরোগ্য লাভ করেন।
রেভারেন্ড লং বর্ণনা করেছেন যে, পর্তুগিজরা হুগলিতে চারটি বুরুজ ও একটি পরিখাসহ একটি দুর্গ নির্মাণ করেছিল। ফাদার হোস্টেন এ ধরনের কোন দুর্গের অস্তিত্বের কথা অস্বীকার করেছেন। কাফী খান অবশ্য একটি দুর্গের উল্লেখ করেছেন, যদিও সমকালীন পরিব্রাজকরা এ সম্পর্কে নীরব ছিলেন। পিয়ারে ডু জ্যারিকের মতে, নদীর অপর তীরে মুগলদের নির্মিত একটি দুর্গ কার্ভালহো দখল করে নিয়েছিল। চট্টগ্রামে আরাকানিরা একটি দুর্গ নির্মাণ করেছিল এবং এর চারপাশে বসতি স্থাপনের জন্য পর্তুগিজদের অনুমতি দিয়েছিল।
পশ্চিমবঙ্গের অভ্যন্তরভাগেও পর্তুগিজরা বসতি স্থাপন করেছিল। ষোড়শ শতকের শেষভাগ এবং সতেরো শতকের শুরুতে পর্যটক জেসুইট ফাদাস-র্এর লেখা চিঠিতে হুগলি নদীর মুখে এধরনের বসতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। রেভারেন্ড লং একটি মানচিত্রের ভিত্তিতে ডায়মন্ড হারবারে একটি পর্তুগিজ বসতির কথা উল্লেখ করেছেন। মানচিত্রটির অস্তিত্ব এখন আর নেই। জেসুইট ফাদারদের বিবরণে শতাব্দীর শেষে পূর্ব বাংলায় বিশেষত শ্রীপুর ও যশোরে পর্তুগিজ বসতির উল্লেখ রয়েছে যেখানে যশোরের জমিদার প্রতাপাদিত্য কিছুসংখ্যক পর্তুগিজসহ কার্ভালহোকে অন্তরীণ করে রেখেছিলেন। পর্তুগিজরা ঈশ্বরীপুর ও ধুমঘাটের মধ্যবর্তী স্থানে বসতি স্থাপন করেছিল বলে মনে হয়। ফলে যশোরের জনগণের মধ্যে উদ্বেগ ও উত্তেজনার সৃষ্টি হয় যার পরিণতিতে পর্তুগিজ পুলিশ প্রধান খুন হন। পরবর্তী সময়ে জেসুইটরা কিছুসংখ্যক পর্তুগিজ বন্দিকে মুক্তিপণের বিনিময়ে ছাড়িয়ে নেয়।
পর্তুগিজদের অসংযত জীবনযাপন পদ্ধতি ছাড়াও কিছু কিছু পর্তুগিজ জলদস্যু কর্তৃক আরাকানিদের সঙ্গে যুক্তভাবে দ্রুতগামী নৌকাযোগে হামলা চালিয়ে উপকূলীয় লোকদের ধরে নিয়ে দাস বানানোই পর্তুগিজদের প্রতি স্থানীয় জনগণের ঘৃণার মনোভাবের অন্যতম কারণ। শিহাবুদ্দীন তালিশের বিবরণে এ ধরনের তথ্য বিধৃত রয়েছে। ফ্রাঁসোয়া বার্নিয়ের জলদস্যুদের প্রধান হিসেবে জনৈক ব্যাস্টিয়ান গনজালভেসের (সেবাস্টিয়ান গনজালভেস টিবিউ) উল্লেখ করেছেন। প্রাথমিক অবস্থার উষ্ণ অভ্যর্থনা এবং গির্জা নির্মাণ ও ধর্মান্তরিত করার অনুমতি দানের অবস্থার পরিবর্তে ১৬০৫ খ্রিস্টাব্দের পর পর্তুগিজদের প্রতি এবং একই সাথে জেসুইটদের প্রতি উপকূলীয় অঞ্চলের জমিদারদের পরিপূর্ণ শত্রুতার মনোভাব কেবল এ ধরনের দস্যুতা ও মানুষকে দাসত্বে বাধ্য করার পটভূমিতে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে।
কার্ভালহোর প্রস্থানের পর সন্দ্বীপ ম্যানোয়েল ডি ম্যাট্টু কর্তৃক শাসিত হয়। তার মৃত্যুর পরই ফতেহ খান পর্তুগিজদের হত্যা করে সন্দীপ দখল করেন। গনজালভেস টিবিউ তাকে হত্যা করে সন্দীপ দখল করেন এবং তথাকার সকল মুসলমান পুরুষকে হত্যা করেন। কিন্তু প্রথম অবস্থায় একজন ব্যবসায়ী হওয়ায় টিবিউ সন্দ্বীপকে একটি বাণিজ্যকেন্দ্র বিশেষত লবণের ব্যবসাকেন্দ্রে উন্নীত করেন এবং তা বাংলা ও করমন্ডলের বণিকদের আকৃষ্ট করে। টিবিউ তখন বাকলার নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য দক্ষিণ শাহবাজপুর দখল করেন। এতকাল তিনি বাকলার অধীনে থেকে তার কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছিলেন।
মুগলরা যখন উপকূলের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল তখন টিবিউ আরাকানের পলাতক রাজার কন্যা অনুপোরমকে (কোন কোন ভাষ্যমতে বোন) বিয়ে করেন এবং আরাকানের রাজার সাথে জোটবদ্ধ হয়ে ভুলুয়া দখল করেন। কিন্তু মুগলরা কৌশলে টিবিউকে জোটমুক্ত করে এবং আরাকানিদের সম্পূর্ণভাবে পরাজিত করে। টিবিউ আরাকানি জাহাজগুলি দখল করে নেন। আরাকান ছেড়ে এসে টিবিউ ১৬১৫ খ্রিস্টাব্দে গোয়া কর্তৃপক্ষের কাছে আরাকান দখল করার প্রস্তাব পাঠান। আরাকানের সমর্থক ওলন্দাজ নৌবহর গোয়ার ষোলটি জাহাজের বহরকে পরাজিত করে। টিবিউ সন্দ্বীপে পশ্চাদপসরণ করেন এবং ১৬১৬ খ্রিস্টাব্দে আরাকানিদের নিকট পরাজিত হন।
পশ্চিম উপকূলের বসতির তুলনায় পূর্ব উপকূলের পর্তুগিজ বসতিগুলির অরাজক অবস্থার কারণ হয়ত এই ছিল যে, পূর্ব উপকূলের উপনিবেশগুলি বৈধভাবে পর্তুগাল রাজার রাজ্যের অংশ ছিল না। এগুলি ছিল ব্যক্তিখাতের পর্তুগিজ বণিক ও ফটকাবাজদের বসতি যেগুলি প্রায়শই অস্পষ্ট স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করত, স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে কর প্রদান করত এবং কিছু বিশেষ সুবিধা ভোগ করত। সতেরো শতকের মধ্যভাগ থেকে বাংলায় স্থাপিত অপরাপর ইউরোপীয় কুঠি থেকে এগুলি ছিল ভিন্ন ধরনের।
১৫৮০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ কিছু পর্তুগিজ ব্যবসায়ী ঢাকা ও শ্রীপুরে বসতি স্থাপন করে। এখান থেকে তারা মসলিন, তুলা ও রেশমি দ্রব্য ইউরোপ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় রপ্তানি করতে শুরু করে। দেশের অভ্যন্তরভাগে অবস্থিত স্থাপনাগুলিতে দুর্গ ছিল না এবং খ্রিস্টধর্মীয় দলিলপত্র থেকে প্রমাণিত হয় যে, আঠারো শতকের প্রথম দিক পর্যন্ত কোথাও কোথাও পর্তুগিজ অগাস্টাইন ফাদার্স কর্তৃক স্থাপিত গির্জাগুলির পাশাপাশি পর্তুগিজ বসতিগুলি ভালভাবেই পরিচালিত হচ্ছিল। ঢাকা, বরিশাল, নোয়াখালী এবং বিশেষত ঢাকার ২৮ মাইল দক্ষিণে অবস্থিত লড়িকলে এ ধরনের গির্জা দেখা যেত এবং অগাস্টাইন যাজকরা ষোলো শতকের শেষভাগে লড়িকলে একটি গির্জা নির্মাণ করেছিলেন।
সতেরো শতকের শেষদিকে নিকোলো ডি পইভার মতো ধনবান পর্তুগিজ বণিক বাংলায় ব্যবসা করছিল। ভুলুয়ায় বহু লোক পর্তুগিজ ধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করে। ১৬৩৫ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত একটি গির্জাসহ পর্তুগিজরা তামলুকে বসতি স্থাপন করে। সতেরো শতকে তামলুকে বর্ধিষ্ণু দাস ব্যবসার উল্লেখ করেছেন শিহাবুদ্দীন তালিশ। ১৭২৪ খ্রিস্টাব্দে তামলুকে মোমের কারবারের কথা উল্লেখ করেছেন ভ্যালিন্টাইন। ক্যারেরি ১৬৯৫ খ্রিস্টাব্দে তামলুক পর্তুগিজদের নিয়ন্ত্রণাধীন দেখতে পান।
চট্টগ্রাম আরাকানিদের হাতে চলে যাবার পর পর্তুগিজদের প্রধান বসতি গড়ে ওঠে হুগলিতে। পর্তুগিজ ঐতিহাসিক ক্যাব্রাল এ বসতির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। পর্তুগিজরা লবণ ব্যবসার জন্য মুগলদেরকে বার্ষিক এক লক্ষ টাকা আমদানি-রপ্তানি শুল্ক প্রদান করেছিল বলে তিনি উল্লেখ করেছেন। শুল্কের এ অর্থের পরিমাণ অত্যুক্তি বলেই মনে হয়। হুগলিতে জমজমাট ব্যবসা সত্ত্বেও সতেরো শতকের তৃতীয় দশক নাগাদ স্পেনের অন্তর্ভুক্ত হওয়া পর্তুগিজ সাম্রাজ্য তখন পতনের পথে। সিংহলের পর্তুগিজ গভর্নর পর্তুগিজ অধিকৃত পূর্বাঞ্চল শাসন করছিলেন এবং ওলন্দাজদের কাছে একটির পর একটি স্থানের অধিকার হারাচ্ছিলেন। পর্তুগিজদের না ছিল কোন সঞ্চিত অর্থ, না ছিল কোন সুসংবদ্ধ নীতিমালা।
পর্তুগালের রাজা হুগলিতে পর্তুগিজ বসতির প্রশাসন কাজে ক্যাপ্টেন নিয়োগ করতেন। এই ক্যাপ্টেনের চার জন প্রশাসনিক সহকারি ছিলেন; প্রতি বছর এঁরা পর্তুগিজ বাসিন্দাদের দ্বারা নির্বাচিত হতেন। এরাঁ সবাই নামেমাত্র সিংহলের গভর্নরের অধীন ছিলেন। গোয়ার মতোই হুগলি শহরের অভ্যন্তরে ধনবান পর্তুগিজরা সচরাচর একজন ধনাঢ্য মুসলমানের ন্যায় হারেমসহ জীবন যাপন করত। তাদের অধীনে বহুসংখ্যক পর্তুগিজ বর্ণসংকর (মেস্তিকো) লোক ক্রীতদাস ও ভারতীয় কৃষি শ্রমিকদের কাজকর্ম তদারকি করত। পর্তুগিজ ধর্মযাজকরা ছিল সমাজে সর্বোচ্চ স্তরের লোক যদিও ধর্মগত অপরাধ তদন্তের জন্য যাজকদের বিচারসভার কোন নজির সেখানে ছিল না যেমনটি সতেরো শতকের গোয়ায় দেখা গেছে। বাঙালি কারিগর ও শ্রমিকরা (পর্তুগিজদের কথায় গরিবো) পর্তুগিজ শাসন টিকে থাকুক আর না থাকুক এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিরাসক্ত ছিল।
হুগলি নদী থেকে পর্তুগিজদের তাড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে মুগলরা ১৬৩২ খ্রিস্টাব্দে হুগলির সন্নিকটে পৌঁছে। মির্জা নাথান ও শিহাবুদ্দীন তালিশের মতে পর্তুগিজ ও মগ হানাদারদের দস্যুবৃত্তি এবং হুগলিকে একটি বর্ধিষ্ণু দাস বেচাকেনার বাজারে পরিণত করাই ছিল মুগলদের হুগলি আক্রমণের কারণ। পক্ষান্তরে ক্যাবরাল অভিযোগ করেছেন যে, শাহজাহানের প্রয়োজনের সময় পর্তুগিজ নৌবহর মুগলদের পক্ষ ত্যাগ করার কারণেই তারা হুগলি আক্রমণ করে।
শহরতলিতে বসবাসকারী বাঙালি পরিবারগুলি সম্পূর্ণভাবে এলাকা ছেড়ে যাওয়ায় এবং মার্টিন আলফন্সো ডি মেলোর সহায়তার ফলে মুগলরা ১৬৩২ খ্রিস্টাব্দের ১৩ সেপ্টেম্বর হুগলি দখল করে। কিছুসংখ্যক পর্তুগিজ সাগর দ্বীপে পালিয়ে যায়। মুগলদের কামানের গোলায় এক শত পর্তুগিজের মৃত্যুর কথা ক্যাব্রাল উল্লেখ করেছেন যা প্রায় সঠিক বলেই প্রতীয়মান হয়। পরবর্তীকালের ইংরেজ ও ওলন্দাজ দলিলপত্র থেকে জানা যায় যে, পর্তুগিজরা হুগলিতে প্রত্যাবর্তন করেছিল। আঠারো শতকের শেষভাগ এবং উনিশ শতকের প্রথম দিকের ইউরোপীয় দলিলপত্রে সম্রাট শাহজাহানের একটি ফরমানের উল্লেখ রয়েছে যাতে পর্তুগিজদের হুগলিতে ৭৭৭ বিঘা জমি প্রদান করা হয়েছিল। ফরমানটির কোন অস্তিত্ব এখন আর নেই। বান্ডেল গির্জার একজন যাজককে যে দায়িত্বপত্রের দ্বারা পর্তুগিজ বসতির বিশেষত বান্ডেলের বসতির দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছিল, সেটি ১৬৪১ খ্রিস্টাব্দে সুবাহদার শাহ সুজার একটি পরওয়ানা দ্বারা অনুমোদন করা হয়েছিল বলে প্রতীয়মান হয়। যশোরে গির্জা নির্মাণের প্রায় একই সময়ে যে অগাস্টাইন যাজকরা ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে বান্ডেলে একটি গির্জা নির্মাণ করেন, তারা ১৬৩২ খ্রিস্টাব্দে গোয়ার জেসুইটদের সঙ্গে একটি শান্তিচুক্তির ফর্মুলা তৈরি করেছিলেন।
নিকোলো মানুচ্চি ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দে অনেক ধনী পর্তুগিজ বণিককে হুগলিতে লবণ ব্যবসায়ে একচেটিয়া সুবিধা ভোগ করতে দেখেছেন। এর কয়েক বছর পর বার্নিয়ার বাংলায় নয় হাজার পর্তুগিজ এবং তাদের বংশজাত বর্ণসংকর (মেস্তিকো) লোকদের দারিদ্রে্যর মধ্যে জীবন যাপনের কথা উল্লেখ করেছেন। ১৬৭০ খ্রিস্টাব্দে টমাস বাউরি সমগ্র বাংলায় অবস্থানরত বিশ হাজার পর্তুগিজের মধ্যে দশ হাজারকে হুগলিতে প্রধানত জাহাজে কাজ করতে দেখেছেন। ধনবান পর্তুগিজদের কেউ কেউ গির্জায় মোটা অঙ্কের অনুদান প্রদান করতেন। ১৭৬১ খ্রিস্টাব্দে বান্ডেল গির্জা পুনর্নির্মাণ কাজে এক ধনী পর্তুগিজ কর্তৃক প্রদত্ত অনুদান থেকেই তা বোঝা যায়।
এমনকি গনজালভেস টিবিউর চলে যাওয়ার পরও চট্টগ্রামের উপকূলীয় অঞ্চল পর্তুগিজদের দস্যুবৃত্তির জন্য অবারিত থেকে যায়। এরা সন্দ্বীপকে ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করে এবং প্রায়শ আরাকানিদের সাথে জোটবদ্ধ হয়ে দস্যুবৃত্তি চালিয়ে যেত। সাধারণত পর্তুগিজ-আরাকানি মৈত্রী ছিল সাময়িক এবং মুগল অভিযানে অপরাপর পর্তুগিজদের অংশগ্রহণ অনেকাংশে ১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জানুয়ারি মুগলদের চট্টগ্রাম বিজয়কে সম্ভব করে তুলেছিল। এরা ১৬৮১ খ্রিস্টাব্দেও সন্দ্বীপ থেকে আরাকানিদের বিতাড়নকালে মুগলদের সমর্থন করে এবং ফলে উপকূলীয় অঞ্চলে দস্যুতা বহুলাংশে হ্রাস পায়। চট্টগ্রাম বিজয়ের পর শায়েস্তা খান পর্তুগিজদের অনেককে হত্যা করেন এবং অনেক পর্তুগিজকে ঢাকার আশেপাশে বসতি গড়ার জন্য প্রেরণ করেন বলে মানুচি যে মন্তব্য করেছেন তা সমর্থনযোগ্য নয়। আঠারো শতকের শেষ নাগাদ পর্তুগিজদের মধ্যে কেউ কেউ বিশিষ্ট ব্যবসায়ী হয়ে ওঠেন। এদের মধ্যে জনৈক কস্মো গোমেজের উল্লেখ পাওয়া যায় যিনি সতেরো শতকের শেষভাগ থেকে আঠারো শতকের তৃতীয় দশক পর্যন্ত ব্যবসায়ে নিয়োজিত ছিলেন। বিদ্রোহী শোভা সিংহ ও রহিম খান হুগলির পথে বান্ডেল অভিমুখে অগ্রসর হলে বান্ডেলের পর্তুগিজ বাসিন্দারা সাফল্যের সাথে তাদের অগ্রযাত্রা প্রতিহত করে মুগল কর্তৃপক্ষের কৃতজ্ঞতাভাজন হয়। আঠারো শতকের গোড়ার দিক থেকে দক্ষিণ-পুর্ব উপকূলের পর্তুগিজ বসতিগুলি দিয়াঙ্গা, চট্টগ্রাম জেলার ফিরিঙ্গি বাজার এবং চট্টগ্রাম শহরের জামাল খান পৌর এলাকায় অবস্থিত ছিল।
ফরাসিদের বাণিজ্য বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পর্তুগিজ বণিকরা হুগলি থেকে ফরাসি অধিকৃত চন্দননগরে চলে যায়। চন্দননগরে আঠারো শতকের পৌর নথিপত্রে দেখা যায় যে, বিপুল সংখ্যক ধনবান পর্তুগিজ বণিক তাদের দাসদাসীদের নিয়ে নিজেদের বাড়িতে বসবাস করত। কিছুসংখ্যক পর্তুগিজ কলকাতায় বসতি স্থাপন করলেও ১৭৩৩ সালে ইংরেজরা পর্তুগিজদের সঙ্গে ব্যবসায়িক যোগাযোগ না রাখার জন্য তাদের কর্মচারীদের নির্দেশ দেয়। তখনও যে হুগলি পরিত্যক্ত হয় নি তার প্রমাণ ১৭৪০ সালে সেখানে একটি পর্তুগিজ জাহাজের আগমন সম্পর্কিত তথ্য। সেসময় থেকেই পর্তুগিজরা স্থানীয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণের উচ্চাভিলাষ এবং প্রয়োজনীয় অর্থ ব্যয়ের সঙ্গতি হারিয়ে ফেলে। নবাবদের সেনাবাহিনীতে কিছু কিছু বর্ণসংকর লোকদের অল্প বেতনে চাকরি প্রদান করা হয়। সংস্কৃতির ক্ষেত্রে কিন্তু পর্তুগিজরা স্থায়ী প্রভাব রেখে যায়।
পর্তুগিজরা বিদেশি ফল, ফুল এবং গাছের চারা নিয়ে এসেছিল যেগুলি বাঙালি সভ্যতা ও সংস্কৃতির অংশ হয়ে ওঠে। তাদের নিয়ে আসা অন্যান্য ফলের মধ্যে রয়েছে গোল আলু, কাজু বাদাম, পেঁপে, আনারস, কামরাঙ্গা, পেয়ারা। এসবই কৃষি-উদ্যান পালনের প্রতি তাদের আগ্রহের পরিচয় বহন করে। তাদের নিয়ে আসা এসব ফল ও আলফন্সো আম বাঙালি জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে আছে। এমনকি নানা রঙের কৃষ্ণকলির চারাও পর্তুগিজদেরই অবদান।
তাদের আগমনের প্রথম দিক থেকেই পর্তুগিজরা স্থানীয় মহিলাদের সাথে বিয়েতে আপত্তি করে নি, যদিও উচ্চপদের চাকরিগুলি পর্তুগাল থেকে আগত শ্বেতাঙ্গ পর্তুগিজদের জন্য সংরক্ষিত ছিল। চাবি, বালতি, পেরেক, আলপিন, তোয়ালিয়া এবং আরও অনেক পর্তুগিজ শব্দ বাংলা শব্দ তালিকায় যোগ হয়েছে। গদ্য রীতিতে বাংলা ভাষার প্রথম মুদ্রিত পুস্তক পর্তুগিজদের দ্বারা মুদ্রিত হওয়ায় সম্ভবত কাজটি সহজ হয়েছিল। প্রথম বাংলা ব্যাকরণ ও বাঙলা অভিধান লিখেছিলেন একজন পর্তুগিজ। ১৫৯৯ খ্রিস্টাব্দে ফাদার সোসা একটি ক্ষুদ্রাকৃতির ধর্মীয় পুস্তিকা বাংলায় অনুবাদ করেন। পুস্তিকাটির কোন কপি এখন আর নেই। কিন্তু বাংলায় অপর একটি ধর্মীয় পুস্তক লিখেছিলেন যশোরের এক বাঙালি যুবরাজ যাকে দাসত্বে আবদ্ধ করে খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত করা হয়। তার নতুন নাম দেয়া হয় ডম এন্টোনিও। তার মনিব ম্যানসেল ডি রোজারিও একটি বাংলা ব্যাকরণ ও অভিধানসহ বাংলায় একটি নাটিকা লেখেন এবং তা ১৭৪৩ সালে লিসবনে মুদ্রিত হয়। পর্তুগিজরা ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে গোয়ায় প্রথম ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করলেও বাংলায় তাদের স্থাপনার অস্থিতিশীল অবস্থার কারণে তারা এর ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পারে নি।
ওলন্দাজ বা ডাচ:
হল্যান্ডের অধিবাসী ওলন্দাজ বা ডাচরা ‘ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’ গঠন করে বাণিজ্যিক উদ্দেশে ১৬০২ সালে এই উপমহাদেশে আসে । ভারতবর্ষে তারা কোম্পানির সনদ অনুযায়ী কালিকট, নাগাপট্টম, বাংলার চুঁচুড়া ও বাঁকুড়ায় বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করে। তাছাড়া বালাসোর, কাশিমবাজার এবং বরানগরেও তারা কুঠি স্থাপন করে । ওলন্দাজ ও অপর ইউরোপীয় শক্তি ইংরেজদের মধ্যে ব্যবসায়-বাণিজ্য নিয়ে বিরোধ শুরু হয় এবং একই সঙ্গে বাংলার শাসকদের সঙ্গে তারা বিরোধে জড়িয়ে পড়ে। ১৭৫৯ সালে সংঘটিত বিদারার যুদ্ধে তারা ইংরেজদের কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। ফলে ১৮০৫ সালে তারা সকল বাণিজ্য কেন্দ্র গুটিয়ে ভারতবর্ষ ত্যাগ করতে বাধ্য হয় । প্রথমে পর্তুগিজ পরে ওলন্দাজ শক্তির পতন, ভারতে ইংরেজ শক্তির উত্থানের পথ সুগম করে।
ওলন্দাজ উত্তমাশা অন্তরীপের পথ আবিষ্কার এবং ইউরোপ ও এশিয়ার মধ্যে সরাসরি সামুদ্রিক বাণিজ্যের পথ উন্মুক্ত করে ষোল শতকে পর্তুগিজরা এশিয়া থেকে ইউরোপে ব্যাপকহারে ও সরাসরি মশলা-বাণিজ্যের নতুন ধারার সূচনা করে। ইউরোপের বিশাল বাজার প্রতিষ্ঠা এবং মশলার বাণিজ্যে প্রভূত মুনাফায় আকৃষ্ট হয়ে এশিয়ায় বাণিজ্যের মুখ্য উদ্দেশ্যে সতেরো শতকের প্রথম দিকে ইংরেজ ও ওলন্দাজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি (ইংরেজ কোম্পানি ১৬০০ এবং ওলন্দাজ কোম্পানি ১৬০২ খ্রিস্টাব্দে) গঠিত হয়। সতেরো শতকের মধ্যভাগ নাগাদ ওলন্দাজ ও ইংরেজরা বাণিজ্য ক্ষেত্রে পর্তুগিজদের নিষ্প্রভ করে দেয়। হুগলিতে বাণিজ্যকুঠি স্থাপনের পর মোটামুটি সতেরো শতকের মাঝামাঝি থেকে ওলন্দাজ ও ইংরেজরা বাংলায় তাদের বাণিজ্য শুরু করে।
কোম্পানিগুলি ‘নতুন বিশ্ব’ থেকে সংগ্রহ করা রুপার বিনিময়ে মশলা কেনার জন্য পূর্ব দ্বীপপুঞ্জের তথাকথিত মশলা দ্বীপগুলিতে যায়। কিন্তু তারা লক্ষ্য করে যে, এ সব দ্বীপে রুপার চেয়ে মোটা ও সস্তা ভারতীয় বস্ত্রের চাহিদাই বেশি। ফলে তারা ইন্দোনেশীয় দ্বীপপুঞ্জে মশলার বিনিময়যোগ্য বস্ত্রের সন্ধানে ভারতের দিকে দৃষ্টি ফেরায়। প্রথমে মশলা দ্বীপপুঞ্জে বহুল চাহিদা রয়েছে এমন বিপুল পরিমাণ সস্তা ও মোটা বস্ত্র উৎপাদনকারী করমন্ডল উপকূলের প্রতি তাদের মনোযোগ আকৃষ্ট হয়। কিন্তু অচিরেই যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা করমন্ডলের বাণিজ্যকে ঝুঁকিপূর্ণ, অনিশ্চিত ও ব্যয়বহুল করে তোলে। ফলে কোম্পানিগুলি শেষ পর্যন্ত বাংলার দিকে মনোযোগ দেয়।
বাংলায় কোম্পানিগুলি বেশ কিছু সুবিধা পেয়েছিলো। বাংলা ছিল সস্তা ও মোটা সুতি বস্ত্রের সর্ববৃহৎ উৎপাদনকারী অঞ্চল। এগুলি ছিল বাজারে লভ্য সুতি বস্ত্রের চেয়ে অনেক সস্তা ও ভাল মানসম্পন্ন। দ্বিতীয়ত, তুলনামূলক কম দাম ও উন্নত মানের জন্য ইতালীয় ও পারস্যদেশীয় রেশমের পরিবর্তে বাংলার রেশমের ছিল ক্রমবর্ধমান চাহিদা এবং এ কারণে বাংলার রেশম ছিল কোম্পানিগুলির জন্য অত্যন্ত লোভনীয় ও লাভজনক পণ্য। তাছাড়া, কোম্পানিগুলির বাণিজ্যের তৃতীয় লাভজনক পণ্য ছিল সোরা। ইউরোপে এর প্রচুর চাহিদা ছিল এবং তা ইউরোপগামী জাহাজগুলির ভারসাম্য রক্ষার কাজে ব্যবহার করা হতো।
ওলন্দাজরা ১৬৩০ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় আসে এবং পিপলিতে বসতি স্থাপন করে। রপ্তানি পণ্যের ওপর ৩% হারে বাণিজ্য শুল্ক প্রদানের শর্তে তারা মুগল সরকারের কাছ থেকে বাণিজ্যিক অধিকার লাভ করে। ১৬৩২ খ্রিস্টাব্দে পর্তুগিজরা হুগলি ছেড়ে চলে গেলে ওলন্দাজরা ১৬৩৪ খ্রিস্টাব্দে সুবাদার আজম খান এর কাছ থেকে হুগলিতে বাণিজ্যকুঠি স্থাপনের জন্য একটি নতুন পরওয়ানা লাভ করে। অবশ্য কোম্পানি হুগলিতে বাণিজ্য কুঠিটি স্থাপন করেছিল ১৬৪৫ থেকে ১৬৪৭ এর মধ্যবর্তী কোনো এক সময়ে। ওয়েস্টজানেন নামের ওলন্দাজ জাহাজটিই প্রথম সেখানে পৌঁছে। পরওয়ানায় শুল্ক হারের যথার্থ উল্লেখ না থাকায় তাদের সঙ্গে প্রায়শ বিবাদের সৃষ্টি হতো। ১৬৪২ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বরের একটি ফরমান বাংলার মধ্য দিয়ে পিপলি-আগ্রা পথে চলাচলকারী পণ্যাদির ওপর ট্রানজিট শুল্ক থেকে ওলন্দাজদের অব্যাহতি দেয়। ১৬৫১ খ্রিস্টাব্দে হুগলিতে ইংরেজ বাণিজ্যকুঠি স্থাপিত হয়।
ঔরঙ্গজেব তাঁর রাজত্বের প্রথম বছরগুলিতে সমগ্র বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যায় চলাচলকারী পণ্যাদির ওপর ট্রানজিট শুল্ক থেকে ওলন্দাজদের অব্যাহতি দেন। হুগলিতে ৪% এবং পিপলি ও বালাসোরে ৩% হারে বাণিজ্য শুল্ক নির্ধারণ করা হয়। শুল্ক হারে এ ধরনের পার্থক্য সরকারের সঙ্গে প্রায়ই বিবাদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ওলন্দাজরা সব সময়ই শুল্ক ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করত। এটাও ছিল বিবাদের আরেকটি কারণ। ১৬৭১ খ্রিস্টাব্দে হুগলির কুঠিয়ালরা বাটাভিয়াস্থ (ইন্দোনেশিয়া) ওলন্দাজ কোম্পানির পূর্বাঞ্চলীয় সদর দফতরকে জানিয়েছিল, গত ষোল বছরে তারা কমপক্ষে ২৫% শুল্ক প্রদান কৌশলে এড়িয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটি ফাঁস হয়ে যায় এবং ওলন্দাজরা দেড় লক্ষ টাকা দিতে বাধ্য হয়। বাটাভিয়া কর্তৃপক্ষ যখনই সম্ভব এধরনের শুল্ক ফাঁকি দিতে হুগলির কুঠিয়ালদের উৎসাহিত করেছিল। ১৬৭৮ খ্রিস্টাব্দে ওলন্দাজরা হুগলিতে ৪% হারে বাণিজ্য শুল্ক প্রদানের জন্য শাহজাদা মহম্মদ আজিম-এর কাছ থেকে একটি নিশান সংগ্রহ করে। ১৬৭৯ খ্রিস্টাব্দে এ হার ৩.৫%-এ হ্রাস করা হয় এবং ১৭০৯ খ্রিস্টাব্দে শাহ আলমের ফরমানের মাধ্যমে এটাকে আরও কমিয়ে ২.৫% করা হয়। ১৭১২ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট জাহান্দর শাহের ফরমান দ্বারা এটি অনুমোদন করা হয়। তিনি সমগ্র মুগল সাম্রাজ্যে চলাচলকারী পণ্যের উপর ট্রানজিট শুল্ক থেকেও ওলন্দাজদের অব্যাহতি দেন।
১৬৩৩ থেকে ১৬৩৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে ওলন্দাজরা উড়িষ্যা ও পাটনায় বাণিজ্যকুঠি স্থাপন করে। কিন্তু অচিরেই সেগুলি বন্ধ হয়ে যায়। বাংলার প্রথম ওলন্দাজ ডিরেক্টর ছিলেন পিটার স্টারথেমিন্স। তিনি হুগলি কুঠি চুঁচুড়ায় স্থানান্তরিত করেন। কোম্পানি চুঁচুড়া, বরানগর ও বাজার মির্জাপুর গ্রামগুলি বার্ষিক ১৫৭৪ টাকা রাজস্বের বিনিময়ে ইজারা নেয়। এর মধ্যে বরানগরের রাজস্বই ছিল সবচেয়ে বেশি (৭৯৩ টাকা)। শীঘ্রই চুঁচুড়ার বাণিজ্যকুঠির প্রাধান্য দেখা যায় এবং বালাসোর তাদের বড় জাহাজগুলির নঙ্গর বাঁধার স্থান হিসেবে থাকলেও ১৬৭৫ খ্রিস্টাব্দে পিপলি বাণিজ্যকুঠি পরিত্যক্ত হয়। সতেরো শতকের পঞ্চাশের দশকের প্রথম দিকে ওলন্দাজরা ঢাকায় একটি বাণিজ্যকুঠি স্থাপন করেছিল। বর্তমান মিটফোর্ড হাসপাতাল স্থলে তাদের ঢাকা বাণিজ্যকুঠি অবস্থিত ছিল এবং তেজগাঁয়ে তাদের একটি বাগানবাড়ি ছিল।
বাংলা থেকে কাঁচা রেশম রপ্তানি ব্যাপক বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে সতেরো শতকের সত্তরের দশকের দিকে বাংলায় কোম্পানিগুলির বাণিজ্য বেশ চাঙ্গা হয়ে ওঠে। তবে বাস্তবে আশির দশকের প্রথম দিকে বাংলার বস্ত্র রপ্তানির ব্যাপক বৃদ্ধি কোম্পানিগুলির এশীয় বাণিজ্যের ধরনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটায়। বস্ত্তত, ইংল্যান্ড ও ইউরোপে ভোগ্যপণ্য ব্যবহারকারীদের রুচির বৈপ্লবিক পরিবর্তনের ফলেই এটা ঘটেছিল। সেখানে ভারতীয় বস্ত্র, বিশেষত বাংলার বস্ত্রের ব্যবহার ফ্যাশনে পরিণত হয়েছিল এবং ফলে বাংলার বস্ত্রের চাহিদা অভূতপূর্বভাবে বৃদ্ধি পায়। এর ফলে কোম্পানিগুলির এশীয় বাণিজ্যে বাংলা সর্বাধিক প্রভাবশালী অংশীদার হয়ে ওঠে এবং সতেরো শতকের আশির দশক থেকে আঠারো শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত ওলন্দাজ ও ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার সামুদ্রিক ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অবশ্য ১৭৫৭ সালে পলাশীতে ইংরেজদের জয়লাভের পর অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। ইংরেজ কোম্পানি ও এর কর্মচারীরা বাংলার প্রশাসন ও অর্থনীতির ওপর তাদের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের বদৌলতে বাংলার বাণিজ্য থেকে অপরাপর সকল ইউরোপীয় ও এশীয় প্রতিদ্বন্দ্বীদের উৎখাত করে নিজেদের একচেটিয়া বাণিজ্যাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে শুরু করে।
আঠারো শতকের প্রথম দিকে ওলন্দাজ কোম্পানি কর্তৃক হল্যান্ডে রপ্তানিকৃত এশীয় পণ্যের গড় বার্ষিক মূল্যের প্রায় ৪০% মূল্য ছিল বাংলার পণ্যের। এর থেকে কোম্পানিগুলির এশীয় বাণিজ্যে বাংলার গুরুত্ব অনুধাবন করা যায়। আবার এশিয়া থেকে ওলন্দাজদের রপ্তানিকৃত বস্ত্রের মোট মূল্যের ৫০%-এরও বেশি মূল্য ছিল বাংলার বস্ত্রের। এরূপে বাংলা শুধু ভারতেই নয়, সমগ্র এশিয়াতেই ওলন্দাজ কোম্পানির কর্মকান্ডের গুরুত্বপূর্ণ কর্মক্ষেত্রে পরিণত হয়। ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ক্ষেত্রেও তেমন ব্যতিক্রম ছিল না। ইংরেজ কুঠিয়ালরা বাংলাকে ‘কোম্পানির বাগানের ফুল’ এবং ‘সবচেয়ে পছন্দের রত্ন’ রূপে বিবেচনা করত।
এশিয়ার অন্যান্য অংশ ও ইউরোপের জন্য রপ্তানিযোগ্য পণ্য সংগ্রহ করা ছিল বাংলায় ওলন্দাজ কোম্পানির কর্মকান্ডের মূল লক্ষ্য। এ অঞ্চলে ইউরোপ ও এশিয়ার অন্যান্য অঞ্চল থেকে আমদানিকৃত মূল্যবান ধাতু ও পণ্যের প্রধান ভূমিকা ছিল রপ্তানিযোগ্য পণ্য ক্রয়ের জন্য প্রয়োজনীয় ক্রয়-ক্ষমতা যোগানো। এসব আমদানিকৃত পণ্যের অধিকাংশই ছিল মূল্যবান ধাতু, কারণ তুলনামূলক মূল্য-কাঠামোয় আমদানিকৃত পণ্যের স্থানীয় চাহিদা অপেক্ষাকৃত কম ছিল। ওলন্দাজদের বাংলায় আমদানিকৃত পণ্যের বেশিরভাগই ছিল ইউরোপের রুপা, যদিও তাদের আমদানিকৃত মূল্যবান ধাতুর কিছু পরিমাণ এশিয়া থেকেই সংগ্রহ করা হতো। এগুলির মধ্যে ছিল জাপান থেকে রুপা ও সোনা এবং পেগু, আরাকান ও পারস্য থেকে রুপা।
ইউরোপ থেকে সীসা, লোহা ইত্যাদির মতো সামান্য পরিমাণ ধাতু এবং কিছু পশমি কাপড় ছাড়া ওলন্দাজ কোম্পানির বাংলায় আমদানিকৃত প্রায় সব পণ্যেরই উৎস ছিল এশিয়া। এশীয় দেশগুলি থেকে সে সব পণ্য আমদানি করা হতো সেগুলির মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সামগ্রী ছিল গোলমরিচ ও অন্যান্য মশলা। প্রধানত সুমাত্রা এবং মালয় উপদ্বীপ থেকে গোলমরিচ সংগ্রহ করা হতো। অন্যান্য মশলা, বিশেষ করে লবঙ্গ, জায়ফল এবং জৈত্রি সংগ্রহ করা হতো ইন্দোনেশীয় দ্বীপপুঞ্জের পূর্বাঞ্চল থেকে। এ অঞ্চল থেকে কোম্পানির রপ্তানিকৃত পণ্যের মধ্যে প্রধান ছিল বস্ত্র, কাঁচা রেশম ও শোরা। প্রধানত এশীয় বাজারগুলিতে রপ্তানির জন্য তুলনামূলকভাবে কম গুরুত্বপূর্ণ পণ্যের মধ্যে ছিল চিনি, চাল, গম, পরিশোধিত মাখন ও সরিষার তেলের মতো খাদ্যসামগ্রী এবং আফিম, মোম, সোহাগা, কড়ি, চটের থলে ইত্যাদি। কাঁচা রেশম প্রথমে কোম্পানির এশিয়ার অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যে ও পরবর্তীসময়ে ইউরোপের সঙ্গে বাণিজ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও সতেরো শতকের শেষ ভাগে এবং আঠারো শতকের প্রথমার্ধে ইউরোপীয় কোম্পানিগুলির বাংলা থেকে রপ্তানিকৃত পণ্যের মধ্যে বস্ত্রই সর্বপ্রধান হয়ে ওঠে।
দিনেমার:
দিনেমার বা ডেনমার্কের অধিবাসী একদল বণিক বাণিজ্য করার উদ্দেশে ‘ডেনিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’ গঠন করেন । ১৬২০ সালে তারা দক্ষিণ ভারতের তাঞ্জোর জেলায় ত্রিবাঙ্কুর এবং ১৬৭৬ সালে বাংলার শ্রীরামপুরে বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করে। কিন্তু এদেশে তারা লাভজনক ব্যবসায় করতে ব্যর্থ হয় । ১৮৪৫ সালে ইংরেজদের কাছে বাণিজ্য কুঠি বিক্রি করে কোনো রকম বাণিজ্যিক সফলতা ছাড়াই দিনেমাররা এদেশ ত্যাগ করে ।
সতেরো শতকের প্রথম দিকে দিনেমাররা পূর্বাঞ্চলে তাদের বাণিজ্যিক কর্মকান্ড শুরু করে। ডেনমার্কের রাজা চতুর্থ ক্রিশ্চিয়ান ১৬১৬ খ্রিস্টাব্দের ১৭ মার্চ একচেটিয়া বাণিজ্যিক অধিকার সম্বলিত একটি অনুমতিপত্রের মাধ্যমে ভারতে বাণিজ্যের জন্য দিনেমার কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৬৪০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মাত্র ১৮টি দিনেমার জাহাজ ভারতে পাঠানো হয়েছিল। এ জাহাজগুলি মশলা, চীনামাটির বাসন-কোসন, হীরা ইত্যাদি নিয়ে দেশে ফিরে। কোম্পানি-প্রধান রোনাল্ড গ্র্যাপ ১৬২৫ খ্রিস্টাব্দে পিপলিতে একটি এবং পরে বালেশ্বরে অপর একটি বাণিজ্যকুঠি স্থাপন করেন। দিনেমারদের কোনো শাহী ফরমান না থাকায় ব্যবসা সংক্রান্ত কর্মকান্ডকে কেন্দ্র করে অচিরেই স্থানীয় সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের অবনতি ঘটতে থাকে। ১৬৪২ খ্রিস্টাব্দে স্থানীয় বাসিন্দারা পিপলি বাণিজ্যকুঠি বিধ্বস্ত ও লুট করে এবং দিনেমাররা পিপলি ও বালেশ্বর ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। দিনেমারদের ’সেন্ট জ্যাকব’ নামীয় জাহাজটি প্রচন্ড ঝড়ে পড়ে পিপলিতে নোঙর করতে চাইলে পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। ফৌজদার অনুমতি দিতে অস্বীকৃতি জানান এবং জাহাজটি ডুবিয়ে দেওয়া হলে ১৬ ব্যক্তির প্রাণহানি ঘটে। ফৌজদার ক্ষতিপূরণের দাবি প্রত্যাখ্যান করলে দিনেমাররা বাংলার উপকূলে জাহাজ ও নৌকা দখল করতে শুরু করে। ১৬৩৮ থেকে ১৬৪৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে তারা সাতটি জাহাজ দখল করে। ১৮০ টনি একটি জাহাজ ছাড়া বাকি সবগুলিই ছিল সাম্পান এবং এতে করে দিনেমারদের প্রত্যাশিত কোনো ফললাভ হয় নি। অন্যান্য ইউরোপীয় বিশেষত ওলন্দাজরা এ ধরনের আক্রমণের বিরোধী ছিল।
১৬৪৫ খ্রিস্টাব্দে বাংলার সুবাহদার শাহ সুজা ক্ষতিপূরণ বাবদ ৮০,০০০ টাকা দিতে চাইলে দিনেমাররা তা প্রত্যাখ্যান করে এবং ১৬৪৬ খ্রিস্টাব্দের শেষ নাগাদ তারা জলদস্যুতা ও আলাপ-আলোচনা দুইই চালাতে থাকে। সম্ভবত ১৬৪৭ খ্রিস্টাব্দের শেষ দিকে একটা আপোসরফা হয়। ১৬৪৮ খ্রিস্টাব্দে রাজা চতুর্থ ক্রিশ্চিয়ানের মৃত্যু হলে ডেনমার্কে কোম্পানিটি নতুন পরিস্থিতিতে অসুবিধার সম্মুখীন হয়।
ইতোমধ্যে বাংলার উপকূলীয় অঞ্চলে দিনেমারদের দস্যুতা অব্যাহত থাকে। ১৬৬১ খ্রিস্টাব্দে তারা মূল্যবান পণ্যসহ বাংলার একটি জাহাজ দখল করে। জাহাজের নাবিক ও যাত্রীদের এচেনে ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রি করা হয়। ওলন্দাজদের মধ্যস্থতাও কোনো মীমাংসা করতে পারে নি। ১৬৭০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে দিনেমাররা বাংলার ত্রিশটি জাহাজ দখল করে। ১৬৭৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে দিনেমারদের পিপলি, বালেশ্বর ও হুগলি এলাকায় বাণিজ্যকুঠি স্থাপনের অনুমতি দিলে সমঝোতা হয়। মুগল সম্রাট তা অনুমোদন করে ২.৫% বাণিজ্য শুল্ক নির্ধারণ করেন। দিনেমাররা তখন বাংলা থেকে রেশম, আফিম ও শোরা কেনার পরিকল্পনা করে। তারা বাংলায় ট্র্যাঙ্কুবারের লবণ, ইউরোপীয় তামা, লোহা ও সুরা বিক্রি করত। কিন্তু সমঝোতা দীর্ঘস্থায়ী হয় নি এবং বালেশ্বর ত্যাগ করার পর দিনেমাররা আবার দস্যুতা শুরু করে।
ডেনমার্কে বাংলার চিনি, শোরা ও বস্ত্রের চাহিদা বাড়তে থাকলে ১৬৯০ খ্রিস্টাব্দ থেকে কোম্পানি বাংলার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা শুরু করে। এন্ড্রে এন্ড্রাস ১৬৯৮ খ্রিস্টাব্দে একটি চুক্তি সম্পাদনে সক্ষম হন এবং এর ফলে কোম্পানি ক্ষতিপূরণের সব দাবি ত্যাগ করে পূর্বতন বাণিজ্য সুবিধাভোগের অধিকার লাভ করে। চন্দননগরের নিকটে তাদেরকে একটি বাণিজ্যকুঠি স্থাপনের অনুমতি দেওয়া হয়। স্থানটি ডেনমার্কনগর নামে অভিহিত হতো। গুদাম ও অন্যান্য ইমারতগুলি ছিল প্রাচীরবেষ্টিত এবং সেখানে কর্মচারীর সংখ্যা ছিল প্রায় চল্লিশ জন। কোম্পানি অবশ্য কোনোদিনই প্রতিশ্রুত ফরমান পায় নি।
মনে হয়, বাংলা থেকে ট্র্যাঙ্কুবারে জাহাজে পণ্য-পরিবহণ ব্যবসা লাভজনক হয় নি। বাংলার বাণিজ্যকুঠির প্রতিনিধি জাঁ জঁচিম বড় একটি জাহাজ কিনেন, কিন্তু তার এ প্রকল্প ব্যর্থ হয়। বাণিজ্যকুঠির কিছুসংখ্যক প্রতিনিধি স্থানীয় অধিবাসীদের সঙ্গে উদ্ধত ব্যবহার এবং বাঙালি কর্মচারীদের প্রতি প্রায়শ নির্দয় আচরণ করতেন। এর ফলে দুজন কর্মচারী মারা যায় এবং এতে করে সমস্যার সৃষ্টি হয়। কোম্পানি বাণিজ্যকুঠির এক কুঠিয়াল উল্ফ র্যাভনকে বিচারে দোষী সাব্যস্ত করে যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত করে। ১৭১১ খ্রিস্টাব্দে গভর্নর হিসেবে আগত ইরাসমাস হ্যানসেন এট্রুপের প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে, তখন একদিকে বাণিজ্যকুঠি ছিল পণ্যশূন্য ও অর্থশূন্য এবং অন্যদিকে স্থানীয় অধিবাসীরা দিনেমারদের বিতাড়ন করতে বদ্ধপরিকর ছিল।
দিনেমারগণ চন্দননগর থেকে প্রায় দেড় মাইল দূরে অবস্থিত তাদের বসতিতে অভিবাসীদের আশ্রয় দেয় এবং সুবাহদারের কোনো অনুমতি লাভের আগেই নিকটবর্তী গ্রামগুলিতে তাদের পুনর্বাসন করতে থাকে। বেশ কয়েক বছর পর বাংলার সুবাহদার এ গ্রামগুলির বকেয়াসহ খাজনা দাবি করেন। দিনেমাররা খাজনা প্রদানে অস্বীকৃতি জানালে ১৭১৪ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবরে ক্রোড়ি রামকৃষ্ণ রায় তাদের বসতি আক্রমণ করেন। কিন্তু দিনেমাররা সহজেই তা প্রতিহত করে। ডিসেম্বর মাসে তার অপর একটি আক্রমণও ব্যর্থ হয়। কয়েক বছর কোনো জাহাজ না আসায় দিনেমারদের তহবিল শূন্য হয়ে পড়ে। মুর্শিদকুলি খান এর কাছে তাদের অভিযোগ প্রত্যাখ্যাত হয়। দিনেমাররা তখন তাদের বসতি ত্যাগ করে এবং বড়নগরের কাছে মূল্যবান পণ্যসহ মুসলমানদের একটি বড় জাহাজ দখল করে নেয়। এরপর তারা প্রায় ৩৫০ জন ভাড়াটে খ্রিস্টান সৈনিক সংগ্রহ করে নদীর মোহনার দিকে অগ্রসর হয়।ইংরেজ ও ফরাসিদের মধ্যস্থতার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।
এর ফলে হুগলির ফৌজদার কর্তৃক ডেনমার্কনগরের বসতি লুণ্ঠিত হয়। গঙ্গা ত্যাগ করার আগে এট্রুপ মুগলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন এবং রামকৃষ্ণ ক্রোড়ির বিরুদ্ধে ফরমানের জন্য ৩০,০০০ টাকা গ্রহণের অভিযোগ করেন, যদিও এ টাকা কোনোদিনই তিনি দেন নি। ১৭১৬ খ্রিস্টাব্দের শেষের দিকে শান্তি স্থাপিত হয় এবং দিনেমাররা আবার তাদের বসতিতে ফিরে আসে। সেখানে তখন কোনো ব্যবসাই ছিল না। কোনো তহবিল ও ব্যবসা না থাকায় কুঠিয়ালদের সেখানে থাকা না থাকার মধ্যে র্পাথক্য ছিল না। ১৭২১ খ্রিস্টাব্দে দিনেমাররা পর্তুগিজদের নিকট তাদের বাণিজ্যকুঠি বিক্রি করে দেয়। অবশ্য প্রয়োজনীয় অর্থ পরিশোধ করা হয় নি এ অজুহাতে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ বাণিজ্যকুঠিটি দখল করে নেন।
১৭৪৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দিনেমাররা ডেনমার্কনগরে তাদের বসতি পুনঃপ্রতিষ্ঠার ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়েছিল, কিন্তু নওয়াব আলিবর্দী খান ছিলেন এ ব্যাপারে দ্বিধাগ্রস্ত। ১৭৫৫ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজদের মধ্যস্থতার কারণে আলীবর্দী দিনেমারদের শ্রীরামপুরে বসতি স্থাপন করার অনুমতি দান করেন। ইংরেজদের স্বার্থ ছিল দিনেমারদের মাধ্যমে তাদের ব্যক্তিগত ব্যবসালব্ধ অর্থ ইউরোপে পাঠানো। রবার্ট ক্লাইভ, রবার্ট ওর্ম, ওয়ারেন হেস্টিংস ও অন্যান্যরা প্রাক-পলাশী আমলে ট্র্যাঙ্কুবারে তৈরি দিনেমার হুন্ডি ইউরোপে পাঠিয়ে দেশিয় বাণিজ্যে দিনেমারদের সহযোগিতা করেছিলেন। ফলে বাংলায় তাদের বাণিজ্য-উদ্যোগের জন্য দিনেমারদের কখনও নগদ অর্থের অভাব হয় নি।
১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের পর ইংরেজরা শোরা ও আফিম ব্যবসায়ে একচেটিয়া অধিকার লাভ করলে অন্যান্য অ-ইংরেজ ইউরোপীয়দের মতো দিনেমাররাও অ-ইংরেজ জাহাজে পণ্য পরিবহণে অসুবিধার সম্মুখীন হয়। ১৭৭৭ খ্রিস্টাব্দে ডেনমার্কের রাজা কোম্পানির মালিকানা গ্রহণ করেন এবং বেসরকারি খাতের দিনেমার বণিকদের এশিয়ায় বাণিজ্য করার অনুমতি দান করেন। আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় নিরপেক্ষ দেশ হিসেবে দিনেমার কোম্পানি বাংলা থেকে তাদের রপ্তানি বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়। ১৭৮৩ খ্রিস্টাব্দে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হলে পরিস্থিতি বদলে যায় এবং দিনেমাররা অপরাপর ইউরোপীয় বণিকদের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্মুখীন হয়। ১৭৮৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে শ্রীরামপুরে মার্কিন জাহাজ ও ধর্মপ্রচারকগণ আসতে থাকেন। আঠারো শতকের নববইয়ের দশক থেকে শ্রীরামপুর ধর্মান্তরণ ও সাহিত্যচর্চার কেন্দ্র হয়ে ওঠে। শ্রীরামপুর মিশন ও কলেজ বাংলার সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক জীবনে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছিল।
ইংরেজ:
সমুদ্রপথে ইউরোপীয় বণিকদের সাফল্য, প্রাচ্যের ধন-সম্পদের প্রাচুর্য, ইংরেজ বণিকদেরকেও এ অঞ্চলে ব্যবসায়-বাণিজ্যে উৎসাহিত করে । এই উদ্দেশে ইংল্যান্ডের একদল বণিক ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নামে একটি বণিক সংঘ গড়ে তোলে । বণিক সংঘটি ১৬০০ সালে রানি এলিজাবেথের কাছ থেকে ১৫ বছর মেয়াদি প্রাচ্যে একচেটিয়া বাণিজ্য করার সনদপত্র লাভ করে । এই সনদপত্র নিয়ে কোম্পানির প্রতিনিধি বাণিজ্যিক সুবিধা লাভের আশায় আকবরের দরবারে হাজির হন । এরপর ক্যাপ্টেন হকিন্স ১৬০৮ সালে রাজা প্রথম জেমসের সুপারিশপত্র নিয়ে বাণিজ্য সম্প্রসারণের লক্ষ্যে সম্রাট জাহাঙ্গীরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তাঁর অনুমতি নিয়ে ১৬১২ সালে সুরাটে বাণিজ্য কুঠি স্থাপিত হয়। পরবর্তীকালে ১৬১৫ সালে প্রথম জেমসের দূত হয়ে জাহাঙ্গীরের দরবারে আসেন স্যার টমাস রো । সম্রাটের কাছ থেকে তিনি ইংরেজদের জন্য বাণিজ্যিক সুবিধা আদায় করে নেন । ১৬১৯ সালে তিনি ভারতবর্ষ ত্যাগ করেন । ইতোমধ্যে কোম্পানি সুরাট, আগ্রা, আহমেদাবাদ প্রভৃতি স্থানে বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করে তাদের ভিত্তি মজবুত করে।
কোম্পানি দ্বিতীয় বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করে মসলিপট্টমে। এরপর বাংলার বালাসোরে আরেকটি বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করে। তাদের শক্তি ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকলে এরা করমণ্ডল (মাদ্রাজ শহর) উপকূলে একটি দুর্গ নির্মাণ করতে সক্ষম হয় । বাংলার সুবাদার শাহ সুজার অনুমোদন লাভ করে তারা ১৬৫৮ সালে হুগলিতে বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করে । এভাবে কোম্পানি কাশিমবাজার, ঢাকা, মালদহেও বাণিজ্য কুঠি নির্মাণ করে ।
১৬৬৮ সালে ইংল্যান্ডের রাজা দ্বিতীয় চার্লস পর্তুগিজ রাজকন্যা ক্যাথারিনের সঙ্গে বিয়ের যৌতুক হিসেবে লাভ করেন বোম্বাই (বর্তমানে মুম্বাই) শহর । অর্থাভাবে চার্লস ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে পঞ্চাশ হাজার পাউন্ডের বিনিময়ে শহরটি বিক্রি করে দেন। পরবর্তীকালে এই বোম্বাই শহরই কোম্পানির প্রধান বাণিজ্য কেন্দ্রে পরিণত হয় ।
জব চার্নক নামে আরেকজন ইংরেজ ১৬৯০ সালে ১২০০ টাকার বিনিময়ে কোলকাতা, সুতানটি ও গোবিন্দপুর নামে তিনটি গ্রামের জমিদারিস্বত্ব লাভ করেন । ভাগীরথী নদীর তীরের এই তিনটি গ্রামকে কেন্দ্র করেই পরবর্তীকালে কোলকাতা নগরীর জন্ম হয়। এখানেই কোম্পানি ১৭০০ সালে ইংল্যান্ডের রাজা তৃতীয় উইলিয়ামের নাম অনুসারে ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ নির্মাণ করে। ধীরে ধীরে এটি ইংরেজদের বাণিজ্যিক স্বার্থ রক্ষা এবং রাজনৈতিক স্বার্থ বিস্তারের শক্তিশালী কেন্দ্রে পরিণত হয় ।
ইংরেজ কোম্পানির ক্ষমতা আরো বৃদ্ধি পায় যখন দিল্লির সম্রাট ফাররুখশিয়ার তাদের বাংলা, বোম্বাই ও মাদ্রাজে বিনা শুল্কে বাণিজ্যের অধিকার প্রদান করেন। একই সঙ্গে নিজস্ব মুদ্রা প্রচলনের অধিকারও কোম্পানি লাভ করে । সম্রাটের এই ফরমানকে ইংরেজ ঐতিহাসিক ওরমে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মহা সনদ বা ম্যাগনা কার্টা বলে উল্লেখ করেন । এই অধিকার লাভ করে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি অপ্রতিরোধ্য গতিতে অগ্রসর হতে থাকে ।
রানী প্রথম এলিজাবেথ প্রদত্ত সনদের (১৬০০ সাল) মাধ্যমে সৃষ্ট ব্রিটিশ নৌ-সংগঠনটি প্রাচ্যের জলপথে একচেটিয়া বাণিজ্য করার অধিকার লাভ করে এবং পরবর্তীসময়ে ভারতে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। পনেরো ও ষোল শতকে আন্তঃমহাসাগরীয় যোগাযোগ উন্মক্ত হওয়ার পর পশ্চিম ইউরোপের নৌ-জাতিসমূহ বহির্দেশে উপনিবেশ স্থাপনের সুযোগ পায়।
প্রতিষ্ঠা ও বিকাশ ১৬০০ সালে রানী এলিজাবেথ প্রদত্ত সনদের মাধ্যমে সৃষ্ট কোম্পানির প্রাথমিক নাম ছিল ‘The Governor and Company of Merchants of London Trading into the East Indies ’ . অনেক বছর পর্যন্ত কেবল ব্যক্তিগতভাবে বিনিয়োগকারীরা নিজেরাই প্রাচ্যে সমুদ্রযাত্রার আয়োজন করত। ১৬০৮ সালে কোম্পানির এমনি একটি সমুদ্র যাত্রা সুরাটে পৌঁছালেও কোনো পণ্য আদান-প্রদান হয়নি। ভারত মহাসাগর নিয়ন্ত্রণকারী পর্তুগিজেরা তাদেরকে এলাকা থেকে তাড়িয়ে দেয়। ১৬১২ সালে কোম্পানি মুগল প্রশাসন থেকে সুরাটে বাণিজ্য করার অধিকার লাভ করলে পর্তুগিজদের মোকাবেলা করার জন্য কোম্পানি তাদের সমশক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। রাজা প্রথম জেমস্ ১৬১৫ সালে স্যার টমাস রো’কে সম্রাট জাহাঙ্গীরের দরবারে দূত হিসেবে প্রেরণ করেন। রো কর্তৃক রাজার পক্ষ থেকে সম্রাটকে উপঢৌকন প্রদান এবং তাঁর ব্যক্তিগত ব্যবহার সম্রাটকে সন্তুষ্ট করে। ফলশ্রুতিতে সম্রাট এর নিকট দূত এর সব প্রার্থনা মঞ্জুর হয় এবং কোম্পানি দক্ষিণ ভারতের পশ্চিম ও পূর্ব উপকূলে ‘ফ্যাক্টরি’ বা বাণিজ্যকুঠি নামে বাণিজ্য কেন্দ্র স্থাপন করার সুযোগ লাভ করে। ১৬৩৯ সালে কোম্পানি ওয়ান্ডিওয়াশ এর স্থানীয় প্রশাসকের কাছ থেকে মাদ্রাজে একটি দুর্গ প্রতিষ্ঠার ক্ষমতা লাভ করে এবং এর মাধ্যমে কোম্পানি এ স্থান নিজেদের ভূখন্ডের ন্যায় শাসন করার অধিকার পায়। কোম্পানি মাদ্রাজে সেন্ট জর্জ ফোর্ট নির্মাণের পর তা ভারতে কোম্পানি বাণিজ্যের সদর দফতরে পরিণত হয়।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৬৩৩ সালে মহানন্দা বদ্বীপের হরিহরপুরে একটি ফ্যাক্টরি স্থাপনের মাধ্যমে বাংলায় ব্যবসা বানিজ্য শুরু করে। একই বছর ফেব্রুয়ারি মাসের দুই তারিখে ইংরেজগণ সম্রাট শাহজাহান থেকে বাংলায় ব্যবসা-বাণিজ্য করার অনুমতি সম্বলিত একটি ফরমান লাভ করে। কোম্পানি বাংলার সুবাহদার শাহ শুজা এর কাছ থেকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সুবিধা পায়। তিনি ইংরেজদেরকে বার্ষিক নামমাত্র তিনহজার টাকার বিনিময়ে বাংলায় বিনাশুল্কে বাণিজ্য করার অধিকার প্রদান করেন। এ সুবিধাটি পরবর্তী সময়ে কোম্পানিকে বাংলার রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারে সাহায্য করে। একই বছরে ইংরেজরা হুগলিতে তাদের ফ্যাক্টরি স্থাপন করে। ১৬৫৮ সালে তারা কাসিমবাজারে এবং ১৬৬৮ সালে বাংলার রাজধানী ঢাকায় একটি করে নতুন ফ্যাক্টরি স্থাপন করে। জব চার্নক কর্তৃক ১৬৯০ সালে কলকাতা শহর পত্তনের মাধ্যমে ফ্যাক্টরি স্থাপন প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হয়। এর পর থেকেই বাংলায় কোম্পানির কর্তৃক আধিপত্য বিস্তারের প্রক্রিয়া শুরু হয়।
বাংলা সুবায় কোম্পানি তাদের দাবিসমূহ ও তার অর্জনকে সব সময় আইনগত অধিকার হিসেবে দেখেছে। ১৬৯৬ সালে শৌভ সিংহ-এর বিদ্রোহ কোম্পানিকে তার কলকাতা বসতির নিজস্ব প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার সুযোগ করে দেয়। বালার সুবাহদার এর সামরিক তাৎপর্য অনুধাবন না করেই কোম্পানিকে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার অনুমতি প্রদান করেন। কলকাতা, সুতানটি ও গোবিন্দপুরের জমিদারি ক্রয় করার মাধ্যমে কোম্পানির এর প্রভাব বিস্তারের পরবর্তী ধাপের সূচনা করে এবং এর ফলে নীরবে বাংলায় কোম্পানির একটি শক্তির ভিত্তি রচিত হয়। ১৬৯৮ সালে কোম্পানির প্রতিদ্বন্দ্বী অপর একটি কোম্পানি গঠিত হয়। এটি ‘General Society Trading to the East Indies’ নামে সংসদীয় ভাবে অঙ্গীভূত হয়। এ ঘটনা সমূহের পথ ধরেই কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ স্থাপিত হয় এবং ১৭০০ সালে এটি একটি স্বাধীন প্রেসিডেন্সিতে রূপান্তরিত হয়। ১৭০২ সালে দুপ্রতিদ্বন্দ্বী ‘East India Companies’ একটি নতুন সনদের মাধ্যমে একীভূত হয় এবং নতুন নাম হয় ‘The United Company of Merchants of England Trading to the East Indies’. যদিও শেষ সময় পর্যন্ত এটির প্রচলিত ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’ নামই বহাল থাকে।
আঠারো শতকের শুরু থেকেই কোম্পানি বাংলায় তাদের বাণিজ্যের প্রসার ঘটাতে থাকে। বাংলায় আগমনকারী জাহাজের সংখ্যা প্রতি বছর বাড়তে থাকে। এ সময়টি ছিল বাংলার বিখ্যাত শাসক মুর্শিদকুলী খানের শাসনামল। তাঁর সময়ে বাংলার ব্যবসা-বাণিজ্যে বিশেষ করে বৈদেশিক বাণিজ্যের ব্যপক উন্নয়ন ঘটে। ১৭০৭ সালে ঔরঙ্গজেব এর মৃত্যুর পর কোম্পানি কেন্দ্রীয় সরকারের দুর্বলতার সুযোগ গ্রহণের চেষ্টা করে। কিন্তু মুর্শিদকুলি খান দৃঢ়ভাবে নতুন সুযোগ সুবিধা প্রদানের বিরোধিতা করেন এবং পুরনো সুবিধাদি কড়াকড়িভাবে নিয়ন্ত্রণ করেন।
চৌকি বা কাস্টম হাউস গুলিতে কোম্পানি কর্মকর্তাদের হয়রানির বিষয়টিতে কোম্পানি ক্ষুব্ধ হয়। তাছাড়া কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত ব্যবসায় কোম্পানির দস্তক এর ব্যবহার এবং বিনা শুল্কে ব্যবসা করার চেষ্টা প্রায়শ উভয় পক্ষের মধ্যে বিরোধের সৃষ্টি করে। সঠিকভাবে মালামাল যাচাই করার অজুহাতে প্রায়ই কোম্পানির বানিজ্য নৌকাসমূহ চৌকীতে থামানো হতো। মুর্শিদকুলি খান নতুন সুবিধা প্রদানে কোম্পানির দাবির প্রতি কখনও নত হন নি। সুযোগ সুবিধা লাভের লক্ষ্যে কলকাতা কাউন্সিল জন সারম্যান এর নেতৃত্বে প্রচুর উপঢৌকনসহ একটি প্রতিনিধি দল সম্রাট ফারুখশিয়ার এর নিকট প্রেরণ করে। সারম্যান প্রতিনিধি দলকে সম্রাট উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান এবং হূষ্টচিত্তে একটি ফরমান প্রদান করেন। এটি সাধারণত ১৭১৭ সালের ফররুখ সিয়ারের ফরমান নামে পরিচিত। (ফরমানে বর্ণিত তারিখটি ছিল- ৩০ ডিসেম্বর, ১৭১৬) বাংলার সুবাহদারকে এ ফরমানের মাধ্যমে কোম্পানিকে নিম্নোক্ত সুবিধা প্রদানের নির্দেশ দেওয়া হয়:
১. কোম্পানির বর্তমান সুবিধাদির অতিরিক্ত হিসেবে কলকাতা বসতির পাশ্ববর্তী ৩৮টি মৌজার জমিদারি দেওয়া হবে।
২. কোম্পানি এবং অন্যান্য ইংরেজদের কোনো পণ্য চুরি গেলে, চুরি হয়ে যাওয়া পণ্যসমূহ উদ্ধারের ব্যবস্থা অবশ্যই নিতে হবে। পণ্য উদ্ধারে ব্যর্থ হলে ক্ষতিপূরণ অবশ্যই প্রদান করতে হবে।
৩. সুরাট মানের মাদ্রাজি টাকার অবমূল্যায়ন না করে একই মানে বাংলায় তা চালু করতে হবে।
৪. মূল সনদ প্রদর্শনের জন্য দাবি করা যাবেনা।
৫. কোম্পানির কাছে দায়বদ্ধ বা ঋণগ্রস্ত এমন সব ব্যক্তিদেরকে ফ্যাক্টরি প্রধানের কাছে হস্তান্তর করতে হবে।
৬. ফ্যাক্টরি প্রধান কর্তৃক প্রদত্ত দস্তকপ্রাপ্ত পণ্য চৌকি দ্বারা থামানো বা পরীক্ষা করা যাবেনা।
৭. সুবাহদার কোম্পানিকে মুর্শীদাবাদ টাকশাল থেকে মুদ্র জারি করার বিষয়ে অনুমতি দিবে।
কোম্পানি ভাল করেই জানত যে, এ সনদ দ্বারা প্রাপ্ত অধিকারসমূহ সুবাহদার মানতে চাইবেন না। কারণ এ সনদটি সম্রাট এর কাছ থেকে অর্থের বিনিময়ে লাভ করা হয়েছিল যা রাজ্যের সার্বভৌমত্বকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ফরমানে দফাসমূহ বিস্তারিত ভাবে বলা হয়নি যা দস্তকের আওতাধীন ছিল। সুতরাং নওয়াবের চৌকিসমূহ এবং কোম্পানির কর্মকর্তাগণ এ বিষয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগেন এবং প্রায়শই বিরোধপূর্ণ পরিবেশ সৃস্টি করে যা কখনো কখনো খন্ড যুদ্ধের রূপ নেয়। যখন কোম্পানির কর্মকর্তাগণ লক্ষ করে যে, নওয়াব নিজেই আইনভঙ্গকারীদের গ্রেফতার ও অন্তরীণ করার জন্য নির্দেশ দিচ্ছেন, তখন তারা পাল্টা ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দেয়। তবে মুর্শিদকুলী খান সচেতনভাবে প্রত্যক্ষ সংঘর্ষ পরিহার করার চেষ্টা করেন।
১৭২৭ সালে মুর্শিদকুলী খানের মৃত্যুর পর সুজাউদ্দীন খান ক্ষমতা দখল করলে কোম্পানি তাদের দাবি সমূহকে পুরোপরি কার্যকরী করার সুযোগ পায়। বিশেষ করে ৩৮টি গ্রামের উপর কোম্পানির জমিদারী কর্তৃত্ব পাওয়ার বিষয়টি এখানে উল্লেখযোগ্য। সুজাউদ্দীন খান তাঁর পূর্বসূরির পদাঙ্ক অনুসরণ করেন এবং অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে রফতানি বাণিজ্য বাধাহীন রাখার চেষ্টা করেন। একই সঙ্গে তিনি কোম্পানির সঙ্গে যে কোনো ধরনের বিরোধ পরিহার করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু লবণ বাণিজ্য নিয়ে অবশেষে কোম্পানি ও সুবাহদারের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হয়। লবণ ব্যবসাকে কোম্পানি শুল্ক মুক্ত পণ্য হিসেবে দাবী করলেও নওয়াব একে শুল্ক মুক্ত পণ্য মনে না করায় দুপক্ষের মধ্যে প্রায় যুদ্ধ শুরু হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়।জগৎ শেঠ এর মধ্যস্থতায় এই দ্বন্দের অবসান ঘটে। প্রশাসন এবং কোম্পানির বিশ্বাসভঙ্গের প্রধান কারণ ছিল দস্তক এর আবরণে কোম্পানি কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত ব্যবসা পরিচালনা। কোম্পানির কর্মকর্তারা তাদের ব্যক্তিগত ব্যবসায় ব্যপকভাবে দস্তকের সুবিধা ভোগ করতে থাকে। কোম্পানি তাদের মালবাহী নৌকাসমূহকে পরীক্ষা করার জন্য চৌকি গুলিকে অনুমতি দিত না। কারণ তারা দাবী করত যে, ১৭১৭ সালের রাজকীয় ফরমান তাদেরকে এ পরীক্ষা থেকে অব্যাহতি দিয়েছিল।
নওয়াবের সঙ্গে ইংরেজদের সম্পর্ক অত্যন্ত ঠান্ডা হওয়া সত্ত্বেও সুজাউদ্দীন খানের আমলে (১৭২৭-১৭৩৯) ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্য ব্যাপক ভাবে বেড়ে যায়। ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে বাংলার প্রতি কোম্পানির আগ্রহও বৃদ্ধি পায়। কোম্পানির প্রতি সহানুভূতিশীল একজন নওয়াব যাতে মুর্শিদাবাদের ক্ষমতায় আসীনাকেন এমন ধরনের নীতি কোম্পানি গ্রহণ করেছিল। কোম্পানি এমন একটি সুযোগ আলীবর্দী খানের শাসনামলেই (১৭৪০-১৭৫৬) পেয়ে যায়। মারাঠাদের দ্বারা বার বার আক্রমণে বিপর্যস্ত আলীবর্দী খান অনুধাবন করেন যে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দুর্নীতি এবং বাড়াবাড়ির বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে আরও সংকট বড়ানো সমীচিন হবেনা। পরবর্তীতে মুর্শিদাবাদের মসনদে সিরাজউদ্দৌলা আসীন হওয়ার পর মারাঠাদের আক্রমণও বন্ধ হয়ে যায়। সিরাজউদ্দৌলা কোম্পানিকে বাংলায় ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করার জন্য তিনটি শর্ত মেনে চলার নির্দেশ দেন। (ক) কলকাতার অবৈধ প্রতিরক্ষা স্থাপনা ভেঙ্গে ফেলতে হবে (খ) ইংরেজগণ অবশ্যই দস্তকের অপব্যবহার বন্ধ করতে হবে এবং (গ) তাঁদের এদেশের আইন মেনে চলতে হবে। ফোর্ট উইলিয়ম কাউন্সিল নওয়াবের নির্দেশ অমান্য করায় নওয়াব কলকাতা অভিযান করেন এবং ইংরেজদের কলকাতা থেকে বিতাড়ন করেন। বিতাড়িত ইংরেজরা হুগলী নদীর ভাটিতে নিরাপদ আশ্রয় নেয়। এ বিজয়কে স্মরণীয় করার জন্য সিরাজউদ্দৌলা তাঁর মাতামহের নামানুসারে কলকাতার নাম রাখেন আলীনগর। ইংরেজদের বিরুদ্ধে সিরাজউদ্দৌলার এ অভিযানের প্রতি ফরাসিদের নৈতিক সমর্থন ছিল।
এ সময় ইউরোপে সপ্তবর্ষীয় যুদ্ধ চলছিল। ব্রিটিশদের কাছে সিরাজউদ্দৌলার আলীনগর পদক্ষেপটি একাধিক পরাজয়ের সমান বলে গণ্য হয়েছিল। প্রথমত স্থানীয় নওয়াবের কাছে এবং দ্বিতীয়ত ফরাসিদের কাছে যারা নওয়াবকে সমর্থন করেছিল। শীঘ্রই মাদ্রাজ থেকে রবার্ট ক্লাইভের নেতৃত্বে নতুন সৈন্যদল আসে। রবার্ট ক্লাইভ ১৭৫৭ সালের ২ জানুয়ারি কলকাতা পুনর্দখল করেন এবং হুগলির মুগল বন্দর ধ্বংস করেন। তরুণ নওয়াবের বিরোধী মুশীর্দাবাদ দরবারের একটি উপদলের সঙ্গে জগত শেঠ এর নেতৃত্বে সংলাপ শুরু হয়। ইংরেজদের সকল সুযোগ-সুবিধা ও ক্ষতিপূরণ প্রদানের নিশ্চয়তা দিয়ে ষড়যন্ত্রকারীগণ একটি গোপন চুক্তি সম্পাদন করে। চুক্তিতে সম্প্রতি বরখাস্তকৃত নওয়াবের বখশী মীরজাফরকে বাংলার ভবিষ্যৎ নওয়াব হিসেবে নির্দিষ্ট করা হয়। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ২৩ জুন ১৭৫৭ সালে পলাশীতে একটি পাতানো যুদ্ধ সংঘটিত হয়। নওয়াবের অধিকাংশ সৈন্য মীরজাফর ও অন্যান্য ষড়যন্ত্রকারীদের পক্ষ নিয়ে নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকে। সিরাজউদ্দৌলা পরাজিত হন এবং মীরজাফরের পুত্র মীরন কর্তৃক নিহত হন।
কোম্পানির অবলুপ্তির সূচনা পাশ্চাত্যের ইতিহাসে ১৮ শতকে বিশ্বব্যাপী যুদ্ধক্ষেত্রের সর্বাধিক বড় দুই শক্তি ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের মধ্যেকার ‘সপ্তবর্ষ ব্যাপী’ যুদ্ধের ফলাফল পলাশীর যুদ্ধের প্রভাবক শক্তি হিসেবে কাজ করেছিল। কারণ একই সময়ে সিরাজউদ্দৌলা এবং তার মিত্র শক্তি ফরাসিদের পরাজয় ঘটেছিল। যুদ্ধে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিজয় একাধারে মুর্শিদাবাদের মসনদে একজন পুতুল নবাবের ক্ষমতা গ্রহণ সহ বাংলা থেকে ফরাসিদের বিতাড়ন ও ইংরেজদের রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে উত্থানের পথ রচিত হয়। পলাশীর যুদ্ধের পরই ইংরেজ শক্তি পুতুল নবাবের কাছ থেকে ২৪ পরগনাকে উপহার হিসেবে আদায় করে নেয়। ১৭৬০ সালের মধ্যে বাংলার তিনটি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ এবং সম্পদশালী জেলা (বর্ধমান, মেদেনীপুর এবং চট্টগ্রাম) কোম্পানি অধিগ্রহন করে নেয়। ১৭৬৫ সালে কোম্পানি বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দীউয়ানী ও রাজস্ব ক্ষমতা গ্রহন করে। ১৭৬৫ থেকে ১৭৭২ সাল পর্যন্ত কোম্পানি বাংলার প্রশাসনের সঙ্গে রাজস্ব ক্ষমতা ভাগাভগি করলেও তারা প্রশাসনিক কোনো দায়-দায়িত্ব সরাসরি গ্রহন করেনি। কোম্পানির পক্ষে সৈয়দ মোহাম্মদ রেজা খান রাজস্ব সংক্রান্ত প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। এ সময়েই কোম্পানী ও তার কর্মচারিদের স্বেচ্ছাচারিতার কারনে বাংলার সম্পদ নির্বিচারে ধ্বংস হয়েছে। ফলে দেশের শুধু অর্থনীতিতেই না, আইন শৃংখলা পরিস্থিতিরও দ্রুত অবনতি ঘটে। কোম্পানির এ ধরনের স্বেচ্ছাচারিতার ফলেই ১৭৬৯-৭০ সালে দুর্ভিক্ষে বাংলার প্রায় তিন ভাগের এক ভাগ মানুষের প্রাণহানী ঘটে। ক্ষমতা দখল করে কোম্পানি কেবল বাংলায় দুর্যোগ ডেকে আনে নি, বরং তা নিজের সর্বনাসের কারন হয়ে দাড়ায়। কোম্পানি ও তার কর্মচারি দুবৃত্তের মত তাদের নিজেদের ব্যক্তিগত উন্নয়নেই ব্যস্ত ছিল। ফলে ক্ষমতা গ্রহণের পর কোম্পানির আয় ব্যায়ের হিসাবে শুধু লোকশানই হতে থাকে। ক্রমাগত লোকশান কোম্পানিকে শেষপর্যন্ত ১৭৭১ সালে ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে ঋণের আবেদন করতে হয়। সরকার ঋণ প্রদানে সম্মত হয় এবং একই সঙ্গে ১৭৭৩ সালে রেগুলেটিং অ্যাক্ট অকার্যকর করার মাধ্যমে কোম্পানির কাজে হস্তক্ষেপ করার ক্ষমতা লাভ করে।
কোম্পানি আমলের সমাপ্তি সংশ্লিষ্ট ঘটনাসমূহ ১৭৭৩ সালের রেগুলেটিং অ্যাক্ট দুটি সমান্তরাল বিষয়ের জন্ম দেয়। (১) কোম্পানি ব্যবস্থাপনায় ধীরে ধীরে সরকারি (ব্রিটিশ) নিয়ন্ত্রণ প্রবেশ করে এবং (২) ১৮৫৮ সালে কোম্পানির সম্পূর্ণ বিলুপ্তি হওয়া পর্যন্ত সময়ে কোম্পানির ক্ষমতা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পায়। কোম্পানির ব্যবস্থাপনা ও নতুন রাষ্ট্রের প্রশাসন পরিচালনা কিভাবে চলবে সে বিষয়ে রেগুলেটিং অ্যাক্টে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়। কোম্পানি ব্যবস্থাপনায় সরকার প্রয়োজনবোধে যে কোনো সময় হস্তক্ষেপ করার অধিকার সংরক্ষণ করে। ১৭৮৪ সালে সরকার ভারতে কোম্পানি ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণের একটি বিশদ আইন তৈরি করে। কোম্পানি ব্যবস্থাপনা তদারকি করার জন্য একটি স্থায়ী সংসদীয় কমিটি বোর্ড অব কন্ট্রোল গঠন করা হয়। বোর্ড অব ডাইরেক্টরদের কোনো সদস্য দ্বারা বাংলার সিভিল সার্ভিসের সদস্য হওয়ার জন্য মনোনীত ক্যাডেটদের কাছ থেকে কোনো উপঢৌকন বা উপহার গ্রহণের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। কর্নওয়ালিসকে বিশেষ কিছু নির্দেশ বাস্তবায়িত করার জন্য একজন গভর্নর জেনারেল হিসেবে সরাসরি নিয়োগ দেওয়া হয়। কোম্পানির অনেক অসুবিধা থাকা সত্ত্বেও কর্ণওয়ালিস একটি ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের শাসন কাঠামো তৈরি করেন। উপঢৌকন গ্রহণ করা এবং ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্য করার বিষয়ে কর্মকর্তাদের ওপর সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।
বেসরকারি ব্রিটিশ ব্যবসায়ীদের চাপে ১৭৯৩ সালের চার্টার অ্যাক্টের মাধ্যমে কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্য করার অধিকার অনেকটা শিথিল করা হয়। কোম্পানির জাহাজসমূহের মধ্যে বেসরকারি ব্যবসায়ীদের মালামাল পরিবহণের সংরক্ষিত জায়গা রাখার ব্যবস্থা হয়। অ্যাক্ট কোম্পানির অবস্থান পুনঃনির্ধারণ করে এবং ভারতে কোম্পানি পরিচালিত রাষ্ট্রকে ব্রিটিশ রাজা বা রাণীর অধীনস্থ করা হয়। এরপর থেকে রাজা বা রানীর পক্ষে কোম্পানি ভারত শাসন করার এবং বোর্ড অব কন্ট্রোল গভর্নর জেনারেল নিয়োগের ক্ষমতা প্রাপ্ত হয়। লর্ড ওয়েলেসলী, যিনি কোম্পানির বাংলা ভিত্তিক রাষ্ট্রকে ভারতীয় সাম্রাজ্যে রূপ দেন তাকে বোর্ড অব কন্ট্রোল নিয়োগ দিয়েছিল। ভারতে কোম্পানির ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র একটি অনিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্রে পরিণত হওয়া এবং মুক্ত বাণিজ্যের ব্যবসায়ীগণের প্রভাব বৃদ্ধি পাওয়ায় পার্লামেন্ট কোম্পানির স্বার্থ হানিকর কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এদের মধ্যে ১৮১৩ সালের চার্টার আইনের মাধ্যমে কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্য করার অধিকার রদ করার সিদ্ধান্তটি ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ভারত তখন মুক্ত বাণিজ্যের জন্য উন্মুক্ত হয়ে যায়। একটি বাণিজ্যিক সংগঠন হিসেবে কোম্পানিকে এরপর থেকে বাজার নিয়ন্ত্রণকারী শক্তিগুলির সঙ্গে কাজ করতে হয়েছে।
ভারতীয় বাজারে প্রতিযোগিতায় অভ্যস্ত না থাকায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাণিজ্যিকভাবে একটি দুর্বল সংগঠনে পরিণত হয়। উপরন্তু, কোম্পানির প্রশাসনিক অংশের কারণে বাণিজ্যিক অংশ ম্লান হয়ে যাওয়ায় কোম্পানির বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপনায় যোগ্য ব্রিটেনবাসী আকৃষ্ট হয়নি। এ পরিস্থিতিতে ১৮৩৩ সালের চার্টার আইনের মাধ্যমে কোম্পানির বাণিজ্যিক তৎপরতা বিলুপ্ত হয়। তবে চীন দেশে বাণিজ্য করার অনুমাতিটি বহাল রাখা হয়।
এরপর থেকে কোম্পানি রাজার পক্ষে একটি প্রশাসনিক প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করে। কোম্পানির কভেনান্টেড সিভিল সার্ভিসে ক্যাডেট মনোনীত করা ছিল কোম্পানির একমাত্র ক্ষমতা। এ সুবিধাটিও ১৮৫৩ সালের চার্টার অ্যাক্টের মাধ্যমে সীমিত করা হয়। কোম্পানির সর্বশেষ সম্মান এবং সুবিধাটি ছিল ডাইরেক্টর কর্তৃক সিভিল সার্ভিসে ক্যাডেট মনোনীত করা। ১৮৫৩ সালের চার্টার অ্যাক্টের অধীনে কোম্পানির এ সুবিধাটিও রদ করা হয় এবং প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে মেধার ভিত্তিতে সিভিলিয়ান নিয়োগের ব্যবস্থা গৃহীত হয়। ভারতে ব্রিটিশ সাম্রজ্যের প্রতিষ্ঠাতা এবং দুশত বছর ধরে ব্রিটেনের সবচেয়ে বড় সংগঠন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এরপর একটি খোলসে পরিণত হয় এবং ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লব এর পর ১৮৫৮ সালে রানীর ঘোষণার মাধ্যমে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আনুষ্ঠানিক ভাবে বিলুপ্ত হয়।
ফরাসি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি:
উপমহাদেশে সর্বশেষে আগত ইউরোপীয় বণিক কোম্পানি হচ্ছে ফরাসি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি । ১৬৬৪ সালে এই বাণিজ্যিক কোম্পানি গঠিত হয়। ১৬৬৮ সালে কোম্পানি সর্বপ্রথম সুরাট এবং পরের বছর মুসলিপট্টমে বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করে। ১৬৭৩ সালে পন্ডিচেরিতে ফরাসি উপনিবেশ গড়ে ওঠে ১৬৭৪ সালের পর থেকে তারা তাদের বাণিজ্যিক কার্যক্রম বাংলায় সম্প্রসারিত করে । কোম্পানি বাংলার সুবাদার শায়েস্তা খানের কাছ থেকে গঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত চন্দননগর নামক স্থানটি কিনে নেয় । ১৬৯০ থেকে ১৬৯২ সালের মধ্যে চন্দননগর একটি শক্তিশালী সুরক্ষিত ফরাসি বাণিজ্য কুঠিতে পরিণত হয় । ১৬৯৬ সালে কোম্পানি এখানে একটি শক্তিশালী দুর্গ স্থাপন করতে সক্ষম হয় । নির্দিষ্ট হারে শুল্ক প্রদানের শর্তে ১৬৯৩ সালে ফরাসিরা বাংলা, বিহার, উড়িষ্যায় বাণিজ্য করার অধিকার লাভ করে । পরবর্তীকালে তারা কাশিমবাজার বালাসোরে কুঠি স্থাপন করতে সক্ষম হয় ।
ইংরেজ বণিকরা যখন ব্যবসায়-বাণিজ্যে দৃঢ় অবস্থানে, তখন ফরাসিরা এদেশে আসে। এ অবস্থায় ইংরেজদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা তাদের জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। কারণ অন্যান্য ইউরোপীয় শক্তির মতো ফরাসিরাও এদেশে সাম্রাজ্য স্থাপনের স্বপ্ন দেখতে থাকে । ফলে দুই ইউরোপীয় শক্তি— ইংরেজ ও ফরাসিদের মধ্যে সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায় । ইংরেজদের ষড়যন্ত্র, কুটকৌশল, উন্নত রণকৌশলের কাছে ফরাসিরা পরাজিত হয়। ১৭৫৭ সালে পলাশির যুদ্ধে ইংরেজদের বিরুদ্ধে ফরাসিরা বাংলার নবাবকে সমর্থন দেয়। কিন্তু এই যুদ্ধে ইংরেজদের সাফল্য ফরাসিদের আরও বিপর্যস্ত করে ফেলে। ফলে বাংলার ফরাসি বাণিজ্য কুঠিগুলো ইংরেজদের দখলে চলে যায়। দাক্ষিণাত্যের কর্ণাটকের যুদ্ধসমূহে ফরাসি কোম্পানি পরাজিত হলে তারা এদেশ ত্যাগ করে। ফলে ইংরেজরা ভারতবর্ষে অপ্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিতে পরিণত হয়।
সেই ১৬০০ শতকে সৃষ্টি হওয়া ফ্রেঞ্চ কলোনি। ফ্রান্স নিয়ে রোমাঞ্চপ্রিয়তা নেই এমন লোক পাওয়া দুষ্কর। এ দেশটা ভালবাসার দেশ, এখানে বাতাসে ছড়ায় মিষ্টি সুগন্ধির ঘ্রাণ, অলিগলি থেকে রুটি আর পনিরের সুবাসের সাথে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে শিল্পীর গাওয়া গানের সুর এখানে একাকার। সুখাদ্য, সুগন্ধি আর শিল্প-সাহিত্যের এ দেশটির খানিক অংশ যেখানে ধরে রাখা যাবে তার কদর সবাই করবে- এটাই তো স্বাভাবিক। তবে ভারতে পন্ডিচেরি ছাড়াও আরো অনেক জায়গা রয়েছে যেখানে ফ্রেঞ্চ কলোনি ছিল। আর তাই ফ্রান্সের খানিকটা আবহ এখনও সেসব জায়গায় লেগে আছে।
বিশাল ভারতবর্ষ কেবল একটু একটু করে নিজেদের চিনতে শিখেছে, রাজা-রাজড়ারা তুমুল দর্পে শাসন করে চলেছে সেখানে। এরই মাঝে বৃটিশরা কী করে যেন এখানে স্বর্ণের খনির মতন বাণিজ্যের একটি অভূতপূর্ব সুযোগের সন্ধান করে ফেলেছে। ভারতের শাসকদের সাথে বনিবনা করে তারা পুরোদমে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিও প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। এদিকে বাণিজ্যের আশায় ব্রিটিশদের দেখাদেখি ওলন্দাজ নাবিকেরা ভারতের তীরে এসে তরী ভেড়াতে লাগলেন। দেখতে দেখতে তারাও বেশ জোরেশোরে ঘাঁটি গেঁড়ে ফেললো এখানে। তাদের কোম্পানির নাম ‘ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’।
এই দুই পরাক্রমশালী শক্তি যখন বাণিজ্যের সাথে সাথে ভারতের ভূমিকেও কব্জা করার পরিকল্পনায় বুঁদ, তখন ব্রিটিশদের প্রায় ৬ যুগ পর ১৬৬৭ সালে ভারতের জাহাজঘাটায় নতুন দুটি জাহাজ এসে ভীড়লো।
ফরাসিদের ভারতবর্ষে আসার মূল কারণ ছিলো ব্রিটিশ আর ওলন্দাজদের সঙ্গে টক্কর দেওয়া। তাই তারা একেবারে খাঁটি বণিকের মতো ব্যবসার সঠিক নথিপত্র নিয়ে আসেন। অনেকের মতে, ফরাসিদের প্রথম ভারতে আগমন আরো আগেই হয়েছিল, সম্ভবত রাজা প্রথম ফ্রান্সিসের রাজত্বকালে। ১৬০৩ সালে ফরাসিরা প্রথমবারের মতো ভারতে পা রাখেন। সেসময় জাহাজের ক্যাপ্টেন ছিলেন পমিয়ের ডি গনভিল।
রাজা চতুর্থ হেনরি Compagnie des Indes Orientales নামক বেণিয়া কোম্পানিকে এই প্রথম অভিযানের অনুমোদন দেন। সেই অনুমোদন বলে কোম্পানিটি টানা ১৫ বছর ধরে ভারতে বাণিজ্য করার সুযোগ পায়। ১৬৬৪ সালে দলিল দস্তাবেজ অনুযায়ী ‘ফ্রান্স ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’ গঠিত হয়েছিল। যা-ই হোক, ভারতের সমুদ্রসীমা পেরিয়ে এলো নতুন জাহাজ, নেতৃত্ব দিলেন ফ্রান্সিস ক্যারন। পরবর্তীতে তিনি ভারতে ফ্রান্সের প্রথম কমিশনারের দায়িত্ব পেয়ে যান।
ভারতে ফরাসি উপনিবেশের কথা মাথায় এলেই সবার প্রথম মাথায় আসে পন্ডিচেরির নাম। কিন্তু ফরাসিরা তাদের সর্বপ্রথম দাপ্তরিক ঘাঁটি এখানে গাড়েনি। ১৬৬৮ সালে ভারতের সুরাটে সর্বপ্রথম একটি ফরাসি ফ্যাক্টরি চালু হয়, মসিয়েঁদের পথ চলা এখান থেকেই শুরু। সুরাটের কারখানাটি চালু হয় ক্যারনের নেতৃত্বে। কর্মজীবনে ঝানু এই ব্যক্তি ৩০ বছর ধরে ওলন্দাজদের কোম্পানিতে কর্মরত ছিলেন। কর্মজীবনের ২০ বছরই তিনি কাটিয়েছিলেন জাপানে।
ক্যারন একা আসেননি, সঙ্গে এসেছিলেন মারাকারা আভানচিন্টোজ। এই ভদ্রলোক ছিলেন পারস্যের এসফাহনের অধিবাসী, শক্তিশালী একজন আর্মেনিয়ান বণিক। তিনিও থেমে থাকলেন না, তার নেতৃত্বে পরের বছরেই ‘মাছিলিপাত্নাম’ (বর্তমান মাসুলিপাতাম) এ একটি কারখানা স্থাপিত হয়। এদিকে আরো কয়েক বছর পর ১৬৭৩ সালে পশ্চিম বাংলার দিকে ফরাসিদের নজর পড়ে। পশ্চিম বাংলার চন্দননগরে নবাব শায়েস্তা খাঁর কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে তারা আরেকটি কারখানা গড়ে তোলেন। তার কিছুদিনের মধ্যেই বিজাপুরের সুলতানের কাছ থেকে ফরাসিরা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপনিবেশ, পন্ডিচেরির দখল নেয়। আস্তে আস্তে ফরাসি উপনিবেশ ছড়িয়ে পড়ে ভারতের বুকে
বিস্তর বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য নিয়ে আসা ফরাসিরা তাদের ব্যবসার জাল ছড়াতে লাগলেন। কিন্তু এক বনে তো দু’তিনটি বাঘ একসাথে বাস করতে পারে না। একটি সংঘর্ষ অনিবার্য। এবারও তার ব্যতিক্রম হলো না। ফরাসিদের এই উড়ে এসে জুড়ে বসাটা ব্রিটিশ আর ওলন্দাজদের গাত্রদাহের বড় একটি কারণ হয়ে দাঁড়াল। আর তাই মসিয়েঁরা একে একে তাদের সৃষ্টি করা উপনিবেশগুলো হারাতে লাগলো, যার শুরু হলো পন্ডিচেরি হাতছাড়া হবার মধ্য দিয়ে।
ডাচরা ফরাসিদের হাত থেকে পন্ডিচেরির শাসনভার কেড়ে নিল। কমিশনার ফ্রান্সিস পন্ডিচেরিকে ছোট গ্রাম থেকে সবেমাত্র বড় পরিসরের বাণিজ্যিক শহর বানানোর পরিকল্পনায় ছিলেন। ওলন্দাজরা মালিকানা হাতে পেয়েই বেশ করে সেখানে দুর্গ গড়ে তুলতে লাগল। ফরাসিরা অবশ্য দমে যাবার পাত্র নয়। তারা ওলন্দাজদের সাথে কয়েক বছরের মাঝেই সমঝোতায় চলে এল। ‘রিজউইক চুক্তি’ নামে একটি দলিলও তৈরি করল তারা। এই চুক্তিতে স্বাক্ষরের মাধ্যমে তারা পন্ডিচেরির মালিকানা আবার ফিরে পেল।
ফরাসিদের রাজনৈতিক অর্জনের ইচ্ছাটা সবসময়ই তাদের বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যের ছায়ায় হারিয়ে যেতো। কাজেই ভারতে তাদের থেকে যাওয়ার মূল উদ্দেশ্য যখন ব্যবসায়িক হয়ে পড়ল, ফরাসি বাণিজ্য অসম্ভব দ্রুতগতিতে এগিয়ে যেতে লাগল। তাদের কোম্পানি ছিল আকারে ব্রিটিশ কোম্পানির অর্ধেক, কিন্তু মুনাফা ছিল তাদের কয়েকগুণ বেশি। মসিয়েঁদের এত সুখ ব্রিটিশদের সহ্য হলো না, কাজেই দুই পক্ষের মাঝে শুরু হয়ে গেল দ্বন্দ-কলহ।
বৃটিশরা ভারতজুড়ে তাদের আধিপত্য বিস্তার করতে উঠেপড়ে লেগে গেল। কোম্পানি ঠিক করে ফেললো ফ্রান্সের কাছ থেকে সুরাট আর মাসুলিপাতামের কর্তৃত্ব গ্রহণ করে নেবে। যেমন কথা তেমন কাজ, মোটামুটি ১৭২০ সালের মধ্যেই ফ্রান্সের তৈরি করা সাম্রাজ্যের বেশিরভাগ অংশ ব্রিটিশরা দখল করে নিল। এতে ফ্রান্সের বাণিজ্যের ভিত হয়ে গেল বেশ দুর্বল। ফরাসিরা তখন অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে ১৭৩৯ সাল পর্যন্ত তাদের ইয়ানাম, মাহে আর কারিকালের কারখানার দখল ফেরত আনলো।
ব্রিটিশদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ থাকার পরও ফরাসিদের মনে মনে সবসময়ই ইচ্ছা ছিল তাদের বাণিজ্যিক পরিসর বাড়ানোর। কিন্তু শক্তিতে তাদের সাথে পেরে ওঠা মোটামুটি অসম্ভব বটে। তাই নিজেদের দুর্বলতার কমতি মেটাতে তারা ঠিক করলো, ভারতবর্ষে মৈত্রীপক্ষ হিসেবে বাংলার নবাব সিরাজ-উদ-দৌলাকে তারা কাজে লাগাবে। ফরাসিরা বেশ বুদ্ধিমান। তাই সরাসরি সাহায্য না চেয়ে তারা নবাবকে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে অনুপ্রাণিত করলো। ফরাসিদের প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল কলকাতার উইলিয়াম দুর্গ দখল করা, কিন্তু ধীরে ধীরে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন দানা বাঁধতে লাগল সেসময়। ফলে ১৭৫৭ সালে ইতিহাসে অবতারণা ঘটে বিখ্যাত ‘পলাশীর যুদ্ধ’ নামক অধ্যায়ের।
পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজদের কাছে নবাব সিরাজের শোচনীয় পরাজয় ঘটে, সঙ্গে ফরাসিদের পরিকল্পনাও একেবারে মাঠে মারা যায়। এতে ইংরেজরা ভারতে আরও পরাক্রমশালী হিসেবে আবির্ভূত হয়ে পড়ে। ফ্রান্স তখন পরাজয়ের জ্বালা মেটাতে ভারতবর্ষে বাঘা জেনারেল ল্যালি-টল্যান্ডালকে পাঠায়। উদ্দেশ্য- হারানো সুদিন ফিরে পাওয়া। জেনারেল ল্যালি এসেই সাফল্যের সঙ্গে কুড্ডালোরে অবস্থিত সেইন্ট ডেভিড দুর্গ ধ্বংস করে দেন। কিন্তু সাফল্যের ধারা বেশিদিন অব্যাহত রাখতে পারলেন না তিনি। কৌশলগত কিছু ভুলের কারণে তিনি ইংরেজদের কাছে পরাজিত হন। পরবর্তীতে তাকে আটক করা হয়, শাস্তি হয় মৃত্যুদন্ডের।১৭৬০ সালে ফরাসিরা দক্ষিণ ভারত ও পন্ডিচেরি ব্রিটিশদের কাছে আবারও হাতছাড়া করে ফেলে। ১৭৬৩ সালে অবশ্য শান্তিচুক্তি হিসেবে তারা আবার পন্ডিচেরিকে ফেরত পায়।
ভারতে প্রবেশের প্রথমদিকে ফরাসিরা একচেটিয়া ব্যবসা করতে পেরেছিল ঠিকই, কিন্তু শেষের দিকে তারা যেন একটু খেই হারিয়ে ফেলল। শূন্যের কাছাকাছি মুনাফা, নিয়মিত লোকসান আর ব্রিটিশদের সাথে অহরহ রেষারেষির দরুণ ব্যবসায় ভাটা পড়ল। শেষে ফরাসি সরকার ১৭৬৯ সালে ফরাসি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি রদ করে দিল। তবে পরবর্তী প্রায় পাঁচ যুগ ধরে ফরাসি ও ব্রিটিশরা যুগ্মভাবে পন্ডিচেরি শাসন করেছিল।
১৯৪৭ এ ভারত, ইংরেজদের থেকে স্বাধীনতা লাভ করে, তখন ভারতে ফ্রান্সের অধিকৃত অংশগুলো পূর্ববর্তী ব্রিটিশ ভারতের অন্তর্গত হয়ে পড়ে। কিন্তু সেসমস্ত অঞ্চলে তখনও রয়ে গেছে ফ্রান্সের তাজা ঘ্রাণ। আর তাই ১৯৪৮ সালে ফ্রান্স আর ভারত সরকার ফ্রান্সের নিয়ন্ত্রণাধীন অঞ্চলগুলোতে নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনৈতিক শাসন জারি করার সিদ্ধান্তে এলো। চন্দননগর সহ ফ্রান্সের অধীন অন্যান্য ভূখন্ড ভারত সরকার ফিরে পেল, কিন্তু ১৯৫৪ সালে পন্ডিচেরি ভারতীয় ইউনিয়নে স্থানান্তরিত হয়ে গেল। এভাবে ভারতে ফরাসি উপনিবেশের অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটল, কিন্তু ফরাসিদের রেশ রয়ে গেল ভারতের আনাচে কানাচে।