অপভ্রংশ
পালি→ প্রাকৃত→অপভ্রংশ। প্রাচীন ভারতীয় ভাষার (অনেক গবেষকের মতে আর্য ভাষার) ক্রমপরিণতির শেষ স্তরটির ঐতিহাসিক নাম হল— অপভ্রংশ। প্রাকৃত ভাষার আরো সরল সহজ লৌকিক রূপটি অপভ্রংশের মধ্যে পাওয়া গিয়েছিল। গবেষকদের মতে আনুমানিক খৃষ্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দী থেকে শুরু করে দশম শতাব্দীর মধ্যেই এই স্তরটি একটি সুস্পষ্ট পরিণতি লাভ করেছিল। অতীতের পণ্ডিতদের মধ্যে গ্রীয়ার্সন জানিয়েছিলেন যে, মধ্যন্তরের প্রাকৃতের শেষ অবস্থাটিই ছিল অপভ্রংশ। অপভ্রংশ কোনোদিনই প্রাচীন ভারতীয় সমাজের উচ্চকোটির মানুষের মুখের বা সেযুগের জ্ঞান-বিজ্ঞানমূলক সাহিত্যের ভাষা হিসাবে গৃহীত হয়নি; কিন্তু— তৎকালীন সমাজের নিম্নস্তরে, যেটাকে এখন আর্যেতর ‘Substratum’ বলা হয়— সেখানকার মানুষের প্রাণের ভাষা ও লোকসাহিত্যের প্রধান বাহক হিসাবে অপভ্রংশের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করেছিল।
গবেষকদের মতে এই অপভ্রংশই পরে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশে কালগত ও স্থানগত রূপান্তরের মাধ্যমে আধুনিক ভারতীয়-আর্য ভাষার অন্তর্গত— বাংলা, পাঞ্জাবি, হিন্দি, মারাঠি, গুজরাটি —প্রভৃতিতে পরিণত হয়েছিল। অপভ্রংশের এবং নব্য ভারতীয়-আর্য ভাষার ঠিক মাঝামাঝি আবার— ‘অবহট্ট’ —ভাষার অবস্থান দেখতে পাওয়া যায়। অতীতের গবেষকদের মধ্যে ডঃ সুকুমার সেন— অপভ্রংশের শেষ স্তর এবং নব্য ভারতীয়-আর্য ভাষার আদি স্তরটিকে— অবহট্ঠ —বলেছিলেন। তবে খুব সূক্ষ্ম বিচার ছাড়া এই পার্থক্য সাধারণ চোখে ধরা পড়েনা। ডঃ সেন এর কারণ হিসাবে সেযুগের সাহিত্যিক ভাষায় রক্ষণশীলতা এবং নব্য ভারতীয় সাহিত্যে লৌকিকের স্থায়ী প্রভাবের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করেছিলেন।
গবেষকদের মতে আনুমানিক ৮০০-১১০০ খৃষ্টাব্দের মধ্যেই নব্য ভারতীয়-আর্য ভাষার অন্যতম প্রধান ভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তখনও পর্যন্ত বাংলায়— সংস্কৃত, প্রাকৃত ও শৌরসেনী অপভ্রংশ —এই তিন রকমের ভাষাই প্রচলিত ছিল। এই তিনটি ভাষাই তখন তিন ধরণের সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হত। তখনকার শিক্ষিত বাঙালিরা জ্ঞান-বিজ্ঞান, দর্শন, চিকিৎসাশাস্ত্র ও সাহিত্য রচনা করবার জন্য সংস্কৃত ভাষা ব্যবহার করতেন। সেকাজের জন্য কোনো কোনো সময়ে তাঁরা প্রাকৃত ভাষায় রচিত উপরোক্ত ধরণের গ্রন্থকেও সংস্কৃত করে নিতেন। প্রাকৃত মিশ্রিত সংস্কৃত ভাষায় বা বৌদ্ধসংস্কৃতে তখনকার মহাযানী বৌদ্ধসিদ্ধাচার্যরা তাঁদের ধর্ম দর্শন আলোচনা করতেন। আর, সেযুগের সমাজের নিম্নস্তরের লোক-কবিরা লৌকিক সাহিত্য রচনা করবার জন্য অপভ্রংশ ব্যবহার করতেন। তৎকালীন বাংলায়— মাগধী ও শৌরসেনী —এই দুটো প্রাকৃতের অপভ্রংশ মূলতঃ কাব্যরচনা করবার জন্য ব্যবহৃত হত; এবং দুটোতে খুব বেশি পার্থক্যও ছিল না। তৎকালীন বাংলার জনসমাজে বহুজন ব্যবহৃত এই অপভ্রংশ দুটির প্রভাব ব্যাপক ও গভীর ছিল। তবে শৌরসেনী প্রাকৃতের অপভ্রংশ শুধু বাংলায় নয়, সমকালীন সমগ্র উত্তর-ভারতেই ব্যাপকভাবে প্রচারিত ও ব্যবহৃত হত। সেই কারণেই অতীতের বাংলার সহজযানী সিদ্ধাচার্যরা এবং ব্রাহ্মণ কবিদের মধ্যে কেউ কেউ অপংভ্রশে কাব্য রচনা করেছিলেন বলে দেখতে পাওয়া যায়। কাহ্নপাদ, সরহপাদ প্রমুখ সিদ্ধাচার্যরা মূলতঃ শৌরসেনী অপভ্রংশেই তাঁদের দোহাগুলি রচনা করেছিলেন। খৃষ্টীয় পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে মিথিলার কবি বিদ্যাপতি তাঁর ‘কীর্তিলতা’ কাব্যটিও শৌরসেনী অপভ্রংশে রচনা করেছিলেন। এমনকি অতীতের কোন কোন পণ্ডিত একথাও জানিয়েছিলেন যে— কবি জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দ’ও প্রথমে শৌরসেনী অপভ্রংশেই রচিত হয়েছিল। তাঁদের এই কথাটি ইতিহাসগতভাবে সত্যি হোক বা না হোক, কবি জয়দেব যে অপভ্রংশে গীতিকবিতা রচনা করতেন— একথার প্রমান কিন্তু ইতিহাস থেকে পাওয়া যায়। অতীতে গবেষকরা গুর্জরী ও মারূ রাগে গেয় জয়দেবের দুটি গান শিখদের শ্রীগুরুগ্রন্থে পেয়েছিলেন, অবশ্য কিছুটা বিকৃতরূপে। আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় সেই গান দুটি উদ্ধার করেছিলেন।
অতীতে অপভ্রংশে কাব্যসাহিত্য রচনা করবার পিছনে কতগুলি বাস্তব কারণ কাজ করেছিল। তখকার সাধারণ মানুষের কাছে মাগধী, শৌরসেনী ইত্যাদি অপভ্রংশের ভাষা খুবই সহজে বোঝবার এবং নিরক্ষর জনসাধারণের জন্য অধিগম্য ছিল। সেযুগের সাধারণ মানুষের চিত্তের দোরগোড়ায় সৃষ্টি, অনুভূতি ও দর্শনের কথাগুলি পৌঁছে দেওয়াই তখকার কবি, শিল্পী ও সহজযানী সিদ্ধাচার্যদের মূল উদ্দেশ্য ছিল। তাই তাঁরা সকলে ভালো সংস্কৃত জেনেও সংস্কৃত ভাষার মাধ্যমে নিজেদের বক্তব্যকে উপস্থিত করবার চেষ্টা করেননি; কারণ— তাতে তাঁদের বক্তব্যের আবেদন অতি অল্প সংখ্যক মানুষের মনেই আঘাত করতে পারত। কিন্তু তখনকার জ্ঞান-বিজ্ঞানের গ্রন্থগুলি জনসাধারণের মধ্যে সেভাবে আদৃত ছিল না বলে, শুধুমাত্র সেইসব গ্রন্থই সংস্কৃতে লেখা হয়েছিল, এবং কাব্যচর্চার বেশিরভাগই অপভ্রংশে হয়েছিল। বিশেষ করে তখনকার বাঙালি কবিদের মধ্যে এবিষয়ে আশ্চর্য উদারতা এবং বাস্তববোধ দেখা গিয়েছিল। অপভ্রংশ এবং নতুন-সৃষ্ট বাংলা ভাষা তখনও পর্যন্ত এমনতর শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারেনি, যাতে কবিতার সূক্ষ্মভাব ও দর্শনের গভীর তত্ত্বগুলি এই ভাষায় সঠিকভাবে বাহিত হতে পারত। কিন্তু তবুও সবকিছু জেনেও— শিক্ষিত, বিদগ্ধ ও সংস্কৃতিপূত চিত্ত হওয়া সত্ত্বেও— যেহেতু সেযুগের বাঙালি কবিরা প্রাগ্রসরবুদ্ধি ও গণচেতনাসম্পন্ন ছিলেন, সেহেতু তখনকার পণ্ডিত সমাজে অনাদৃত ও উপেক্ষিত অপভ্রংশকে তাঁরা অবহেলা না করে সেটাকে সানন্দে নিজের মনোভাব ব্যক্ত করবার বাহন হিসাবে গ্রহণ করে নিয়েছিলেন। এই সৎসাহস এবং উদারতা তখনকার কিছু কিছু বাঙালি পণ্ডিত ও কবিদের মধ্যে ছিল বলেই তাঁদের কারও কারও রচনায় সেই সময়কার বৃহত্তর জনসমাজের নানা সুখ-দুঃখ, আনন্দ-ভাবনা, বেদনা-কল্পনা— বস্তুময় কাব্যময় রূপ নিয়েছিল বলে ইতিহাসে দেখা যায়। গবেষকদের মতে সাধারণ জনতার ভাষা হিসাবে প্রায় পাঁচশো বছর ধরে অপভ্রংশ ও অবহট্ট সমগ্র উত্তরভারতে অপ্রতিদ্বন্দ্বী ছিল।
খৃষ্টীয় চতুর্দশ শতকের শেষেরদিকে ‘প্রাকৃতপৈঙ্গল’ নামে অবহট্ঠে বা অপভ্রংশে রচিত একটি গীতি-কবিতার সঙ্কলন গ্রথিত হয়েছিল। প্রাকৃত ছন্দের বিভিন্ন রূপ ও প্রকৃতির নমুনা সঙ্কলন করাই সম্ভবতঃ সেই গ্রন্থের অজ্ঞাতনামা গ্রন্থকারের উদ্দেশ্য ছিল। উক্ত সঙ্কলন গ্রন্থটিতে আনুমানিক ১১০০-১৪০০ খৃষ্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ের শৌরসেনী অপভ্রংশে রচিত এমন কতগুলি শ্লোক পাওয়া যায়, যেগুলির মধ্যে কিছু কিছু বাংলা শব্দ, বাঙালি ধরন-ধারণ রীতি প্রকৃতি সুস্পষ্টভাবে দেখতে পাওয়া যায়। ভাষার দিক থেকেও এগুলির সঙ্গে গীতগোবিন্দের মিল উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। গবেষকদের মতে এগুলির রূপ, রস, ভাব, আবহ ইত্যাদি সবই বাংলার; বস্তুত ছন্দে, রসে, ভাবে ও ক্ষুদ্র-পরিসরে ঘনীভূত এমন অপূর্ব কাব্য প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যের ইতিহাসে খুব একটা বেশি পাওয়া যায় না। প্রাকৃতপৈঙ্গলে শুধু যে প্রেম বা ভক্তি রসের কবিতা রয়েছে— সেটা কিন্তু নয়; অতীতে ডঃ সুকুমার সেন অনেকগুলি বীররসের কবিতাও সেই গ্রন্থটির মধ্যে থেকে উদ্ধার করেছিলেন। গ্রন্থটিতে লৌকিক রাধাকৃষ্ণের কথা, রামচন্দ্রের কথা নিয়েও ছোট ছোট কিছু কবিতা রয়েছে। এছাড়া শিবপার্বতীর লৌকিক গার্হস্থ্য জীবনের সুখ দুঃখের প্রাচীন নিদর্শনও এই গ্রন্থে পাওয়া যায়। ‘সদুক্তিকর্ণামৃত’ গ্রন্থের অনেক শ্লোকেও শিবপার্বতীর লৌকিক সুখদুঃখময় দাম্পত্য-জীবনের পরিচয় পাওয়া যায়। মধ্যযুগের বাংলা মঙ্গলকাব্যগুলিতেও সেই একই চিত্র কিছুটা পরিণতরূপে পাওয়া যায়। এই কবিতাগুলি সবই বাংলায় তুর্কি আক্রমণের আগে রচিত হয়েছিল। ‘শেক-শুভোদয়া’ গ্রন্থের ১৯তম অধ্যায়ের একটি শ্লোক প্রাক-তুর্কি আমলের বলে গবেষকরা মনে করে থাকেন। অতীতে ডঃ সুকুমার সেন দেখিয়ে দিয়েছিলেন যে, শেক-শুভোদয়ার কোনো কোনো শ্লোক অপভ্রংশে রচিত। এসব ছাড়াও ডাক ও খনার বচন নামে প্রচলিত প্রবাদ সংগ্রহ এবং শুভঙ্করের নামে প্রচলিত গণিত-আর্যার শ্লোকগুলিতে অপভ্রংশের এত ঐতিহাসিক প্রত্যক্ষ প্রমাণ রয়েছে যে, সেগুলি মূলে যে অপভ্রংশে রচিত হয়েছিল— সেকথা কাউকে বুঝিয়ে বলবার প্রয়োজন হয় না।
পরিশেষে অপভ্রংশের বিশেষত্ব সম্পর্কেও জানিয়ে রাখা যাক। অপভ্রংশের ব্যাকরণে যদি কিছু বিশেষত্ব থাকে, সেটা হচ্ছে সম্পূর্ণ নিয়মশৃঙ্খলাহীনতা! পালি বা প্রাকৃতের ব্যাকরণে কিছুটা নিয়মের বাঁধন থাকলেও অপভ্রংশে কিন্তু তেমন কোন বাধ্যবাধকতা ছিল না। এপ্রসঙ্গে অপভ্রংশের ধ্বনি পরিবর্তনের রীতিটি লক্ষ্যণীয়। অপভ্রংশের ক্ষেত্রে স্বরবর্ণের পরে ক, খ, ত, থ, প, ফ থাকলে সেসব বহুক্ষেত্রে গ, ঘ, দ, ধ, ব, ভ—তে পরিণত হয়ে গিয়েছিল।
দীর্ঘস্বর প্রায়ই হ্রস্বস্বর হয়েছিল। যথা— স্ত্রী→ইত্থি।
য-ফলার পরিবর্তন হয়েছিল পূর্ববর্ণের দ্বিত্বে। যথা— বাণিজ্য→বণিজ্জ।
শব্দের শেষের ই, উ অনুনাসিক হয়েছিল।
স্বরবর্ণের ‘ম’ বহুক্ষেত্রে ‘বঁ’–তে পরিণত হয়েছিল। যথা— কমলম→ গবঁলু।
আবার কখনও কখনও অনুরূপ স্বরধ্বনির সমীকরণ হয়েছিল; যথা— প্রিয়তর→পিঅঅর।
আবার কোথাও যুক্ত ব্যঞ্জন বর্ণের একটি লোপ পেয়েছিল এবং পূর্বস্বর বা পরবর্তী স্বর দ্বিত্ব হয়েছিল। যেমন— জন্ম→জম্ম, পুত্র→পুত্ত।
এছাড়া আ কিংবা উ–এর আগের ‘ম’ লুপ্ত হয়েছিল; যেমন— যমুনা→জউনা।
অপভ্রংশে লিঙ্গ পরিবর্তনের কোনো নিয়ম ছিল না। এতে পুংলিঙ্গ ও স্ত্রীলিঙ্গ— স্ত্রী, পুরুষ ও জীবজন্ত নির্বিশেষে নির্বিচারে ব্যবহৃত হতে পারত।
গবেষকদের মতে পালি ও প্রাকৃতের সঙ্গে শব্দরূপ ও ধাতুরূপের দিক থেকে অপভ্রংশের কিছুটা মিল ছিল। অপভ্রংশে— ‘মত’ —এই অর্থে আল, আলু, ইল্ল, উল্ল প্রত্যয় ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। যেমন— শিখাবৎ→ শিখা + আল → সিহাল; নিদ্রালু→ নিন্দালু; গোহাল→ গোহিল; দর্প + উল্ল→ দপ পুল্ল→ দপপুল।