চব্বিশে এর নীলাকাশে শকুনের অভয়ারণ্যঃ

শকুনের অভয়ারণ্যঃ

একটি ছবি ও কিছু কথা যা একদা এক সময় আলোড়ন সৃস্টি করে ছিল। কঙ্কালনার শিশু আর ক্ষুধার্ত শকুনের ছবি তুলে পেয়েছিল পুলিৎজার পুরস্কার। অতঃপর অপরাধ বোধ,অবসাদ অবশেষে মৃত্যু।

পোস্টটি আগে একবার করেছিলাম, তখন প্রক্ষাপট ছিল সুদান।মার্চ,১৯৯৩ সাল। দক্ষিন সুদানের উষর প্রান্তর। প্রচন্ড রোদ,গায়ে উত্তপ্ত বাতাস।টলোমলো পায়ে হেঁটে আসছে এক রত্তি জীবন্ত ছোট মেয়ের কঙ্কাল।
মেদ মাংশের বদলে হাড়ের উপর লেপটে থাকা চামড়ার সান্তনা পুরস্কার।দুর্বল পা কাঁপছে থর থর করে।হঠাৎ করে মাটিতে থপ করে বসে পড়লো বছর তিনেকের মেয়েটি।
একটু দুরেই দাঁড়িয়ে এক যুবক।দক্ষিন আফ্রিকার চিত্র সাংবাদিক কেভিন কার্টার। তার হাতে ধরা এস এল আর ক্যামেরা শিশুটির দিকে তাক করলেন তিনি।
অভুক্ত শীর্নকায় আফ্রিকান শিশু তো লোভনীয় “সাবজেক্ট”। কয়েকটি স্নাপ নিয়েছেন,হঠাৎ দেখলেন, শিশুটির ঠিক পিছনে নিঃশব্দে এসে নেমেছে এক শকুন। শকুনটি পায়ে পায়ে মেয়েটির দিকে এগিয়ে আসছে। আবার ক্যামেরা তাক করলেন কেভিন। ক্ষুধার্থ বেপরোয়া শকুন তখন শিশুটির আরও কাছে।

পেশাদার সাংবাদিক আবেগ প্রবন হওয়ার অবকাশ থাকে না। দাঙ্গা,জীবন্ত পুড়িয়ে মারা খুব সামনে থেকে দেখেছেন কেভিন।তবুও ওই ছবিটা তোলার পর গলার কাছে দলা পাকিয়ে উঠলো একটা।চোখে জল।

চব্বিশের অভয়ারণ্যর প্রেক্ষাপট ঃ

এই পোস্টি পড়ে এক সময় আমার ও চোখে জল এসেছিল।কোনদিন ও ভাবিনি আমার প্রিয় এই দেশটি কোন দিন সুদানের মত হতে পারে।অথবা কতক গুলো বিড়াল তাপসী মত সূফি মানুষদের দ্বারা আমার আমাদের সকল মৌলিক চাহিদা বা বেঁচে থাকার রসদ বিড়ালের মত চেটেপুটে খেয়ে ফেলতে পারে।তেইশ সাল থেকে আগাম গন্ধ পাচ্ছি,এদেশ দুর্ভিক্ষের কবলে পড়তে পারে। সুদানের মত দেশে কোন গৃহযুদ্ধ নেই তবুও মানুষের দুর্দশা চরম পর্যায়ে পড়েছে। সব কিছু ক্রয় ক্ষমতার বাইরে।মানুষ দারিদ্র, এবং দুর্ভিক্ষের সাথে লড়াই করে টিকে আছে।বিড়ালেরা যেমন করে শিকার ধরে, দেখলে মনে হয় না বিড়ালেরা এমন করে সব কিছু বাগিয়ে নেই।মানুষের দুর্দশা তাদের পোয়াবারো। তারা এত কোটি মানুষ কে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়ে দিব্যি মহান ধর্ম পালন করে যাচ্ছেন।কখন বা ক্ষুধার্থ মানুষের হকের টাকা মেরে দিয়ে বিদেশে গিয়ে মহান আল্লাহর দরবারে লুটিয়ে পড়ছেন। এ দেখা কে দেখবে? কারন একদল শকুন নীলাকাশে অপেক্ষা করছে, কখন সুদানের ক্ষুধার্থ মেয়েটির মত আমার দেশের মেয়ে মাটিতে মুখ থুবরে পড়বে।আর দেশের প্রথম সারির আলোকচিত্র শিল্পীর ক্যামেরায় তা ফটো বন্দী হবে, আবার হয়তে কেউ পুলিৎজার পুরস্কার পাবেন। আমি শুনেছি শকুন মরা খায় পাখা দিয়ে ঢেকে।তাদের ইজ্জত আছে কিন্তু আমাদের দেশের শকুনের সেই বোধ শক্তিটুকুও নেই।তারা প্রকাশ্যে আমাদের স্বাধীন সারভৌম দেশের মানচিত্র সহ সব ঠোঁটের সাহায্য কুঁড়ে কুঁড়ে খেয়ে ফেলছে।

শকুন ও ক্ষুধার্থ মেয়েটি ঃ

চিত্র সাংবাদিকের বহু “এক্সক্লুসিভ” ঝুলিতে,কিন্তু দুর্ভিক্ষের সঙ্গে সেটাই প্রথম পরিচয় কেভিনের।মানুষের দুর্দশা যে এৎ ভয়াবহ হতে পারে,ধারনা ছিল না তার।সুদান তখন গৃহযুদ্ধে চলছে সঙ্গী দারিদ্র,দুূভিক্ষ।মানুষ কে ওই ভাবে মরতে দেখেনি কেভিন,এতই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন,শিশুটির খোঁজ নেওয়ার কথা মাথায় আসেনি তাঁর। সে কোথায় গেল জানার চেস্টা করেননি।

২৬শে মার্চ,১৯৯৩।নিউ ইয়র্ক টাইমস এ প্রকাশিত হলো কেভিন কার্টারের ছবি, ” দ্য ভালচার অ্যান্ড দ্য লিটিল গার্ল।” চারদিকে তোলপার হাজার হাজার চিঠি আর ফোন আসতে শুরু করল দফতরে। সবার প্রশ্ন শিশুটির কি হল?শকুনেই কি খেল তাকে? না কি নিরাপদ কোন আশ্রয়ে পৌছঁতে পেরেছিল সে? কর্তৃপক্ষ যোগাযোগ করলেন কেভিনের সাথে।কেভিন জানালেন তিনি শকুনটিকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন।মেয়েটি উঠে হাঁটতে আরম্ভ করছিল।কিন্তু ত্রান শিবির পর্যন্ত পৌঁছতে পেরেছিল কি না,তিনি জানেন না। এরপর শুরু হল প্রশ্নের পর প্রশ্ন, পেশা দারি দায়িত্বের অবহেলার প্রশ্ন তুললেন।কেভিন এক সময় অনুতাপের চোর কাঁটায় ভিতরটায় রক্তাক্ত হল।ছটফটে যুবকটি দিনভর অন্যমনস্ক।পরের বছর পুলিৎজার পুরস্কারে ঘোষিত হল তার নাম।চারদিকে অভিনন্দনের বন্যায় ভেসে গেল ৩৩ বছরের যুবকটি। কিন্তু যে দুটি প্রানীর জন্য তাঁর এই পুরস্কার সেই কেলভিন কার্টার এক চিত্র সাংবাদিক—এক সুই সাইড নোট রেখে মৃত্যুকে বরন করেছিলেন। তাতে লেখাঃ “আমি সত্যিই খুব দুঃখিত। জীবন যন্ত্রনার সব আনন্দকে এতটাই ম্লান করে দেয় যে, আনন্দ বল কিছুই অনুভব করা যায় না।আমি অবসাদে ডুবে গিয়েছি।চারপাশে বড় দৈন্য —খুনের পর খুন, লাশের পাহার,মানুষের রাগ-দুঃখ, যন্ত্রনা,অভুক্ত ও জখম শিশু,বন্দুক -পাগল,উন্মাদ, খুনি পুলিশ আর জল্লাদের দল যেন আমাকে তারা করে বেড়াচ্ছে; আমি চললাম বন্ধু কেনের সঙ্গে দেখা করতে যদি ভাগ্য থাকে।” এমন চিত্র আমি দেখার মত আমার শক্তি নেই।

আল্লাহর কাছে প্রার্থনা রইল এই সব শকুনের হাত থেকে আমার আবাস ভুমিকে রক্ষা কর।